কোথায় হারালেন সানে!

ম্যানচেস্টার সিটি থেকে ৬০ মিলিয়ন দিয়ে সানেকে কিনে এনেছিল বায়ার্ন। আশা ছিল তাকে নিয়ে ব্যাক-টু-ব্যাক চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার স্বপ্ন দেখেছিল বাভারিয়ানরা। কিন্তু সানে এক ম্যাচ খেলেই পুরোপুরি হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছেন সানে। পিএসজির বিপক্ষে বাঁচামরার লড়াইয়েও নিষ্প্রভ কেন সানে?

বায়ার্ন মিউনিখ বনাম বেয়ার লেভারকুসেন; ৬৮ মিনিটের খেলা চলছে। এমন সময় চতুর্থ রেফারি আসলেন খেলোয়াড় পরিবর্তনের সংকেত নিয়ে। ১৭ বছর বয়সী জামাল মুসিয়ালাকে মাঠে নামাচ্ছেন হ্যান্সি গ্লিক। অবাক করবার মতন কোনো বিষয় নয়, বায়ার্ন যুবদলে ইতিমধ্যে জামাল মুসিয়ালার সুনাম অনেক। কিন্তু যাকে বদল করে নামানো হলো, সেই নামটাতেই খটকা লেগেছে সকলের। লেরয় সানে। মাত্র আধ ঘন্টা আগেই তাকে সাব করে মাঠে নামানো হয়েছিল।

হ্যান্সি ফ্লিক খুব সুন্দরমতন এক্সপ্লেইন করেছেন বিষয়টা, ‘খেলোয়াড় সাব করার সময় খুব ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করে নামাতে হয়। থমাস মুলারকে ধরার প্রশ্নই আসে না, নাব্রিও ভালো করছিল দ্বিতীয় হাফে। বদলানোর মতন শুধু সানেই ছিল।’

একজন খেলোয়াড়ের জন্য ব্যাপারটা বেশ অপমানজনক।

বায়ার্নে লেরয় সানের আগমনের ঘটনা বেশ সাড়া ফেলবার মতনই ছিল। জার্মানির সেরা খেলোয়াড়দের জায়গা সবসময়ই বায়ার্নে। নতুন কিছু নয় এটা। বরং জার্মান দলে জায়গা নিশ্চিত করতে চাইলে বায়ার্নে খেলাটা জরুরিই মনে করেন জার্মান খেলোয়াড়েরা। সানের সেই দলেই পরতেন।

শালকেতে সেরা ফর্মে থাকার সময়েই সুযোগটা এসেছিল ২০ বছর বয়সী সানের কাছে। জার্মানির সেরা দল নাকি পেপ গার্দিওলা? তখন গার্দিওলাকেই বেছে নিয়েছিলেন সানে। গার্দিওলার অধীনে খেলতে পারা যেকোনো ইয়াং খেলোয়াড়ের জন্যই অনেক বড় কিছু। কেনই বা হবে না? যে খেলোয়াড়ের অধীনে গড়ে উঠেছে বার্সেলোনার ড্রিম টিম, তার অধীনে কে-ই বা খেলতে চাইবে না?

সানেও সেই দলেই ছিলেন, পেপ গার্দিওলার অধীনে সুযোগ ছিল নিজের স্টেপ আপ করার। গার্দিওলা সেটাই করার চেষ্টা করেছেন। স্প্যানিশ কোচের অধীনে তার শুরুটাও মন্দ হয়নি। ৩৭ মিলিয়ন পাউন্ডে সানের শুরুটা ছিল অসাধারণ। উইঙ্গার হিসেবে সানেকে নতুন করে তৈরি করেছেন গার্দিওলা। ম্যানচেস্টার সিটির ব্যাক-টু-ব্যাক প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন সানে।

কিন্তু গার্দিওলার নিয়মিত রোটেটিং শাখের করাত হয়ে গিয়েছিল সানের জন্য। দলে থেকে অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার জমছিল ঠিকই, কিন্তু দলে নিয়মিত সুযোগ হতো না। আর জার্মানি দলে সুযোগ পাওয়ার জন্য নিয়মিত মাঠে থাকাটাও জরুরি। সে কারণেই সানে সুযোগ পেয়ে আর ছাড়েননি। ২০১৯ সালেই সানের নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তার বায়ার্নে আসা। কিন্তু সিজনের একদম শেষ ম্যাচে এসে ইঞ্জুরিতে পরে শুধু বায়ার্নে আসার সময়টাই দীর্ঘায়িত হয়। করোনাক্রান্ত ২০২০ সালে সুযোগ পেয়েই ভিড়ে বসেন বায়ার্নে। কিপ্টেমির স্বভাব থাকা বায়ার্নের পকেট থেকে সানে বাবদ পাক্কা ৬০ মিলিয়ন খসিয়ে নিয়েছিল সিটি।

সানে ছিলেন বায়ার্নের অ্যাটাক পাজলের শেষ পিস। কেনই বা থাকবে না, এক মৌসুমের মধ্যেই রিবেরি-রোবেনকে বিদায় বলা বায়ার্নের দুই উইঙ্গেই দরকার ছিল পারফেক্ট রিপ্লেসমেন্টের। এক পাশে কোম্যানকে দিয়ে ভালোই সামলে নিয়েছিল বাভারিয়ানরা, কিন্তু আরেকপাশে দরকার ছিল হেভি রিপ্লেসমেন্টের। প্রথম মৌসুমে চোটের কারণে সানে মিস হয়ে যাওয়ার কারণে জোটাতাল;ই দিয়ে দল সাজাতে হয়েছিল তাদের। এসেছিলেন পেরিসিচ, কুতিনহো। কিন্তু কাউকেই পাকাপাকিভাবে রাখেনি তারা, বরং ৬০ মিলিয়ন দিয়ে নিয়ে এসেছেন সানেকে!

শুরুটা ছিল অসাধারণ ছিল, অভিষেকেই শালকেকে ৮-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে শুরু করেছিল বায়ার্ন। সানের ছিল ১ গোল, ২ এসিস্ট। দিনের শুরুটা দেখেই নাকি পুরো দিনটা কেমন হবে বলে দেওয়া যায়, কিন্তু প্রবাদ বাক্যকে পুরোপুরি ভুল প্রমাণ করেছেন তিনি। পুরো মৌসুমে ঐ একটা ম্যাচেই খেলা দেখিয়েছেন সানে। বাকি মৌসুমে তার গোলসংখ্যা মাত্র ৩, অথচ ২০২১ সালের প্রতি ম্যাচেই মাঠে দেখা গিয়েছে তাকে।

বায়ার্নের জন্য লিগ জেতাটা কখনওই কোনো বড় বিষয় নয়। প্রতি মৌসুমেই বুন্দেসলিগা নিজেদের করে নেয় বায়ার্ন। প্রশ্নটা আসে ইন্টারন্যাশনালে লেভেলে। বায়ার্নের মূল পরীক্ষা দেখা যায় চ্যাম্পিয়নস লিগে। গত মৌসুম ছিল খেলা দেখানোর মৌসুম। হ্যান্সি ফ্লিকের অধীনে রাতারাতি বদলে গিয়েছিল বায়ার্ন। ধারে থাকা খেলোয়াড়দের নিয়েই নিজের সেরা খেলা বের করে এনেছেন ফ্লিক। এই মৌসুমেও সেই সুযোগটা ছিল বায়ার্নের!

কিন্তু বায়ার্নের চ্যাম্পিয়নস লিগ স্বপ্ন শেষ হয়ে গিয়েছে পিএসজির কাছে হেরেই। সেখানে সানের দোষটাও কম নয়। সেমি-ফাইনালে পৌঁছাতে এক গোলের প্রয়োজন ছিল বায়ার্নে। এক্সট্রা টাইমের আর বাকি দেড় মিনিট। পিএসজির ডিফেন্স ভেঙ্গে ডি-বক্সে ঢুকে পরেছিলেন সানে। সামনে জামাল মুসিয়ালা, পাশে থমাস মুলার; দুজনেই হাত বাড়িয়ে বল চাইছেন। আর সেখানে সরাসরি শট করে পুরো অ্যাটাকটাই মাটি করে দেন তিনি!

শুধু কী তাই? প্রথম লেগেও ফ্লিকের ভরসা মাটিতে মিশিয়েছেন সানে। ৩১ শট করেও বল মাত্র জালে পৌঁছুতে পেরেছেন ২ বার। তার মধ্যে সানে শট নিয়েছেন ২ বার, একটিও পোস্টের ধারে কাছে ছিল না। এমন কী পুরো ম্যাচে কী পাস মাত্র একটি! দুই দলের অ্যাটাক মিলে তার সবচেয়ে বাজে পারফরম্যান্স ছিল তার।

মৌসুম শেষে ঠিকই বায়ার্ন একটি শিরোপা নিয়ে বাড়ি ফিরবে, কিন্তু ব্যাক-টু-ব্যাক চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার সূবর্ণ সুযোগ হারিয়েছে বায়ার্ন। সেটা পুরো ম্যাচে সানে নিজের ছায়া হয়ে থাকার কারণেই। দোষটা ঠিক সানেকে দিলেও চলে না। লেওয়ান্ডস্কির ইঞ্জুরির পর গোলস্কোরিংয়ের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিতে হতো সকলকে। সে জায়গাতে কেউই স্টেপ-আপ করে উঠতে পারেননি। সানের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটা ভিন্ন।

সানে মূলত আধুনিক উইঙ্গারদের মতন নয়। বর্তমানে উইঙ্গার বলতেই মানুষ বুঝে রোনালদো, রোবেন, সালাহ; যাদেরকে বলা যায় ইনভার্টেড উইঙ্গার। যাদের খেলার স্টাইল একটু ভিন্ন। তারা উইংব্যাক থেকে বল নিয়ে চেষ্টা করে ডি-বক্সে ঢোকার। বল নিয়ে কাট-ইন অথবা মাইনাস করে বল নিয়ে গোল করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সানে ঠিক এই ধাঁচের উইঙ্গার নন, বরং আগেকার উইঙ্গারদের মতন। যার কাজ হলো পুরো উইঙ্গ ধরে রাখা। খেলায় প্লেইস ক্রিয়েট করা। উইঙ্গার বলতে গেলে ওয়াইড অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। যেমনটা এখন আর ফুটবলে দেখাই যায় না বলতে গেলে। কিন্তু পেপ গার্দিওলা তার দলে সানেকে ঠিক সেভাবেই খেলিয়েছেন। পুরাতন উইঙ্গারদের মতন, যাদের মূল কাজ তাদের পেস দিয়ে প্রতিপক্ষ দলকে উলটপালট করে ফেলা।

সানে তার খেলার স্টাইল দিয়ে ঠিকই সফল, কিন্তু যখনই কাট ইন করে বল জালে জড়ানোর প্রশ্ন আসে, সেখানেই সানে ইকুয়েশনের বাইরে চলে যায়। রিবেরি-বোবেনকে নিয়ে এক দশকের কাছাকাছি খেলা বায়ার্ন সানের কাছ থেকেও আশা করে তাদের মতই পারফরম্যান্স। কিন্তু সেখানেই ব্যর্থ টিপিক্যাল উইঙ্গার সানে।

সানের ক্যারিয়ার গড়তে হলে নিজেকে পরিবর্তন করা আবশ্যক। নইলে টিপিক্যাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারদের মতন তার ক্যারিয়ারও সমাপ্ত হয়ে যেতে পারে যেকোন দিন!

 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...