ইনজুরি। এই এক প্রবণতাই নেইমারের স্বপ্নের পথে বারবার বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটা হোক ব্রাজিল কিংবা পিএসজি- দুই জার্সি গায়েই। তিনবার বিশ্বকাপ খেলেছেন। কিন্তু তার মধ্যে দুইবারই ইনজুরির কাছে হার মেনেছেন। একই নিয়তি যেন ক্লাবেও বয়ে নিয়ে বেড়ান।
২০১৭ সালে ইউরোপ জয়ের লক্ষ্য সামনে রেখে নেইমারকে এক প্রকার বার্সেলোনা থেকে ছিনিয়ে এনেছিল পিএসজি। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন লিগের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে প্রায় মৌসুমেই নেইমারকে আর পাওয়া যায় না। তাই পিএসজিরও আর স্বপ্ন বাস্তবে এসে ধরা দেয় না। এর পিছনে মূল বাঁধা হয়ে থাকে নেইমারের চোট।
সেই চোট এবার আবার পিছু নিয়েছে নেইমারের। বায়ার্ন মিউনিখের সাথে চ্যাম্পিয়নস লিগের বাঁচা মরার ম্যাচে পাওয়া যাচ্ছে না নেইমারকে।
সপ্তাহ দুয়েক আগে লিলির বিপক্ষে ম্যাচে গোড়ালির ইনজুরিতে পড়েন নেইমার। আর এরপর থেকেই মাঠের বাইরে আছেন তিনি। বায়ার্নের সাথে আগের লেগে ১-০ গোলে হেরেছে পিএসজি। তাই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে হলে ফিরতি লেগে ম্যাচটা জিততেই হবে প্যারিসের এ ক্লাবকে। কিন্তু এমন মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে দু:সংবাদ হয়ে এল সে ম্যাচে নেইমারের না থাকার খবর।
এখন নেইমারবিহীন পিএসজি পরবর্তী ম্যাচ না জিততে পারলে আরেকটি খবরও খুব শীঘ্রই আসতে পারে। সেটি হলো- নেইমারের সাথে পিএসজি’র চূড়ান্ত ইতি। কারণ গুঞ্জন আছে, আগামী গ্রীষ্মের দলবদলের বাজারে নেইমার ক্লাব ছাড়তে পারেন।
পিএসজি’র সাথে ছয় বছরের পথচলার শেষটা হতে পারে এ মৌসুমেই। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, ইউরোপিয়ান দলবদলে নেইমার পরবর্তী কোন ক্লাবের জার্সি গায়ে পরতে পারেন? আপাতত এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো দল আগ্রহ দেখায়নি।
এর কারণ হচ্ছে, পিএসজি’র সাথে নেইমারের এখনও দুই বছরের চুক্তি রয়েছে। আর দলবদলের জন্য নেইমারের উপর কোনো রিলিজ ক্লজও নেই। অর্থাৎ চুক্তি শেষ হওয়ার আগে নেইমারকে কোনো দল পেতে চাইলে সেই দলকে পিএসজি’র ধার্য করা অঙ্ক পরিশোধ করে দলে নিয়ে আসতে হবে।
এখন সে ক্ষেত্রে পিএসজি যে চড়ামূল্যে নেইমারকে বিক্রি করবে, সেটা অনুমিতই। তাই এমন পরিস্থিতিতে আগেই পিছিয়ে পড়ে ইউরোপের বেশ কিছু দল যারা খুব বেশিমূল্যে খেলোয়াড় দলে ভেড়ায় না।
ইউরোপের ক্লাবগুলোর মধ্যে খুব অর্থ প্রতিপত্তি আছে, এমন দলগুলোর মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, জুভেন্টাস, ম্যানসিটি, চেলসি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড অন্যতম। এখন এই ক্লাবগুলোতে নেইমারের আসার সম্ভাব্যতাটা কতটুকু?
পিএসজিতে খেলার আগে বার্সার হয়ে খেলেছেন নেইমার। ক্যারিয়ারের একমাত্র চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা পেয়েছেন এই দলের হয়ে। তবে কি বার্সা-নেইমার যুগলবন্দী হওয়া সম্ভব? সম্ভব। তবে বাস্তবতাটা হচ্ছে, আগামী মৌসুমে অন্তত কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
কারণ, এই মুহূর্তে বার্সা এমন একটা ঝুঁকিতে রয়েছে যে, আগামী মৌসুমের দলবদলেই একটা নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে তাদের উপর। কারণ এখন পর্যন্ত ২০০ মিলিয়ন ইউরোর ঘাটতিতে আছে তারা। তাই আপাতত চাইলেও নেইমারকে দলে ভেড়াতে পারবে না বার্সেলোনা।
বার্সেলোনাতে সম্ভবপর না হলে রিয়াল মাদ্রিদে সম্ভব কি? বার্সার কোনো ফুটবলার পরবর্তীতে রিয়ালের জার্সি চাপিয়েছেন-এমন ঘটনা খুবই নগণ্য। তবে সেই ছোট তালিকায় ব্রাজিলের রোনালদো নাজারিও রয়েছেন।
তাই নেইমার টু রিয়াল ডিল একেবারেই অকল্পনীয় কিছু নয়। তবে রিয়াল মাদ্রিদ এখন জুড বেলিংহ্যাম আর এমবাপ্পেকে দলে ভেড়ানোর জন্য মুখিয়ে আছে। এখন চোট প্রবণ ৩১ বছর বয়সী নেইমার তাদের ভাবনার বাইরেই রয়েছে, বলা যায়।
ইংলিশ ক্লাব ম্যানসিটি কয়েক মৌসুম আগেই নেইমারকে দলে ভেড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। সে ক্ষেত্রে নেইমারের জন্য ক্যারিয়ারের নতুন মোড় এনে দিতে পারে ম্যানসিটি।
কিন্তু ম্যানসিটি এ সময়ে এসে নেইমারকে দলে নিতে চাইবে কিনা তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। কারণ এর মধ্যেই তারা দলটা পুরোপুরি গুছিয়ে নিয়েছে। যদিও আগামী মৌসুমেই কয়েকজন মিডফিল্ডার দল ছাড়বেন। তাই নেইমারের জন্য এখনই ম্যানসিটির দুয়ার বন্ধ হচ্ছে না।
ম্যানসিটির মতোই চেলসিও নেইমারকে পাওয়ার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী ছিল। কিন্তু সে সময় থেকে চেলসি অনেকখানি বদলে গিয়েছে। কোচ পরিবর্তিত হয়েছে। টুখেলের জায়গায় এসেছেন পটার।
চেলসি বোর্ডও বদলে গিয়েছে। তাই নতুন চেলসির ভাবনায় নেইমার আদৌ আছে কিনা তা এখনও অজানা। তবে চেলসির বর্তমান দুরবস্থায় নেইমার হতে পারেন আশার আলো। তাই চেলসির জার্সি গায়ে নেইমারকে দেখার সম্ভাবনাও আপাতত উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
পিএসজির শর্ত মেনে আরেকটি দল নেইমারকে দলে ভেড়াতে পারে। সেটি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। কিন্তু রেড ডেভিলদের ধরনের সাথে নেইমার ঠিক কতটুকু যান, একই সঙ্গে ম্যানইউ কোচ এরিক টেন হ্যাগের ভাবনাতে আছেন কিনা তা অজানা। খুব সম্ভবত নেইমারকে নিজের পরিকল্পনায় রাখবেন না হ্যাগ।
কারণ চলতি মৌসুমে এই দল দিয়ে বেশ সফল তিনি। আর তাছাড়া, বড় তারকা নিয়ে দল পরিচালনায় তাঁর একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। রোনালদো- হ্যাগ ইস্যু কার কাছেই বা অজানা। তাই এই এক কারণেও রেড ডেভিলদের রাডারে নাও থাকতে পারেন নেইমার।
ইংলিশ দলগুলোর ভিড়ে নেইমারকে পেতে চাইতে পারে ইতালিয়ান ক্লাবও। বিশেষত, এই মুহূর্তে জুভেন্টাসের একজন নেইমারের মতোই ক্রিয়েটিভ উইংগার প্রয়োজন। তবে পিএসজির নির্ধারিত ট্রান্সফার ফি জুভেন্টাসের মনঃ-পূত না হলে নেইমার টু জুভেন্টাস ডিলটাও আশঙ্কায় পড়ে যাবে।
ইউরোপিয়ান দলবদলের বাজার এক পাশে রেখে এমএলএস কিংবা সৌদি আরব প্রো লিগের কথা ভাবলে নেইমারকে পাওয়ার জন্য কাড়ি কাড়ি অর্থ নিয়ে বসে আছে এই লিগের দলগুলো। কিন্তু নেইমার নিশ্চয়ই মাত্র ৩১ বছর বয়সে ইউরোপ ছেড়ে ইন্টার মায়ামি, লা গ্যালাক্সি কিংবা আল নাসেরে যোগ দিবেন না।
সাধ আছে, সাধ্য নেই- এমন ক্লাবগুলোর তালিকা করলে অনেক ক্লাবই চলে আসে। যেমন লিভারপুর, আর্সেনালের চাওয়ায় নেইমার অবশ্যই থাকতে পারে। কিন্তু চড়ামূল্য দিয়ে তারা কখনোই নেইমারকে দলে ভেড়াবে না।
এই ক্লাবগুলোর দর্শনই এমন। লিভারপুল এই মুহূর্তে জুড বেলিংহ্যামের উপরে চোখ রাখছে। আর আর্সেনাল আরেক ব্রাজিলিয়ান গ্যাব্রিয়েল মার্টিনেলিকে নিয়েই ইপিএলে শিরোপার দৌড়ে দারুণ ভাবে আছে। তাই এ দুই দলে নেইমারের আসার সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নেইমারের তাহলে পরবর্তী গন্তব্য কোথায়? বাস্তবতা হচ্ছে, দল ছাড়ার এত গুঞ্জন ডালপালা বিস্তার করলেও সামনে বায়ার্ন বাঁধা টপকে গেলে পিএসজির সাথে নেইমারের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতর দিকেই থাকবে। এমন কি পিএসজি এবার ইউসিএলে ব্যর্থ হলেও নেইমারকে খুব সহজে ছাড়তে চাইবে না।
আর পিএসজি’র চাওয়াতেই সবকিছু নির্ধারিত হবে। তাই নেইমার দল ছাড়তে চাইলেও পিএসজি না চাইলে সেটি কখনোই সম্ভবপর হবে না। অন্তত চুক্তি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত নেইমারের ভাগ্য এখন পিএসজির হাতেই রয়েছে।