ফাস্ট বোলাররা কেন ইনজুরিপ্রবণ!

একজন বোলারের মধ্যে আগ্রাসনটা থাকতে হয়। জন্মগতভাবে নিজেকে সেরা দাবি করা মানুষদের উইকেটে জানান দিতে হয়, তিনি সেরা। একটা ভালো বল করা বা একটা উইকেট নেয়ার মাধ্যমেই জানান দেয়াকে আগ্রাসন বলে না, কতটুকু জোরে বল করলাম, সেটিও আগ্রাসন নয়।

একজন বোলারের মধ্যে আগ্রাসনটা থাকতে হয়। জন্মগতভাবে নিজেকে সেরা দাবি করা মানুষদের উইকেটে জানান দিতে হয়, তিনি সেরা। একটা ভালো বল করা বা একটা উইকেট নেয়ার মাধ্যমেই জানান দেয়াকে আগ্রাসন বলে না, কতটুকু জোরে বল করলাম, সেটিও আগ্রাসন নয়। নিজের সবটুকু ঢেলে দিয়ে বল ছোড়াটা আগ্রাসন এর একটা অংশ মাত্র। যেমন ভাবে আগ্রাসনের অংশ, ভালো বলটি করার পরে ব্যাটসম্যানকে জানিয়ে দেয়া ‘i was over you’ কিংবা একটা ৪ বা ৬ এর পরে ব্যাটসম্যানকে জানানো যে, আমি পছন্দ করি নি, পরের বলটির জন্য প্রস্তুত হও।

জোরে বল ছুঁড়তে পারাটাই যেমন আগ্রাসন নয়, তেমনি আগ্রাসনই ফাস্ট বোলিংয়ের সবটুকু নয়। ‘there is much more.’  চলুন শুরু করা যাক। । শুরু করা যাক, দ্যা গ্রেটেস্ট ওয়াসিম আকরামের উক্তি দিয়ে, ‘if someone wants to be really good at fast bowler, he will have to bear with the scorching sun and heat. If he does that, only then he can become a good bowler and it’s a continuous process of learning.’

তীব্র রোদ কিংবা তাপের মধ্যে আপনি যখন নিজেকে প্রস্তুত করছেন, আপনার জানা থাকা দরকার, কাজটি আপনি সঠিকভাবে করছেন কিনা। ফাস্ট বোলারদের ক্যারিয়ার সাধারণ অবস্থাতেই অপেক্ষাকৃত ছোট হয়, ফাস্ট বোলিং একজন খেলোয়াড়ের শরীরের শেষবিন্দু পর্যন্ত শুষে নেয়, ভুল প্রশিক্ষণ কিংবা টেকনিক একজন খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার আরো সংক্ষিপ্ত করে দিতে পারে।

একজন ফাস্ট বোলারের বোলিং মূলত রান আপ, জাম্প, ল্যান্ডিং এবং রিলিজ, এই চারটি বিষয়ের উপরে নির্ভর করে গড়ে ওঠে। বলা হয়, একজন বোলারের বোলিং রিদম, বিশেষত গতির ৫০ শতাংশ নির্ভর করে রান আপের উপরে, ২০ শতাংশ জাম্পের উপরে, ২০ শতাংশ ল্যান্ডিং এবং ১০ শতাংশ রিলিজের উপরে।

রান আপের কথা যখন বলছি, সাধারণত ফাস্ট বোলাররা ২১, ২৩ এমন বিজোড় স্টেপ গ্রহণ করেন জাম্প এর সুবিধার জন্য। অর্থাৎ ফ্রন্ট ফুটে যখন আপনি রান আপ শুরু করছেন, সেটি প্রথম স্টেপ এবং বিজোড় সংখ্যা। বোলিং করার জন্য যেহেতু ফ্রন্ট ফুটে জাম্প করবেন, সেটিও বিজোড় সংখ্যাই হবে। এই কারণে রান আপ স্টেপ সাধারণত বিজোড় সংখ্যা হয়। রান আপের শুরুটা হওয়া উচিত স্বাভাবিক কিন্তু ছন্দবদ্ধ।

ধীরে ধীরে আপনি গতি বাড়াবেন এবং জাম্প পর্যন্ত মোমেন্টাম ধরে রাখতে হবে। অর্থাৎ যথেষ্ট গতি নিয়ে শুরু করে মাঝখানে খেই হারিয়ে ফেললে কিংবা যথেষ্ট আস্তে শুরু করে পর্যাপ্ত মোমেন্টাম না পেলে বোলিংয়ে আশানুরূপ গতি কিংবা কন্ট্রোল কোনটাই পাবেন না। রান আপের ক্ষেত্রে আরো যে বিষয়গুলো ঠিক রাখা দরকার, দৌঁড়ানোর সময় আপনার মাথা আপরাইট থাকা উচিত, প্রতিটা স্টেপে ল্যান্ডিং-এর ক্ষেত্রে পায়ের আঙুল কিংবা গোড়ালির উপরে ল্যান্ড করবেন না, ইনজুরির কারণ হতে পারে।

পায়ের তালুর মাঝখান ফেলে ল্যান্ড করার অনুশীলন করতে হবে, সেক্ষেত্রে ল্যান্ডিং ফোর্স পায়ের একটা অংশের উপরে না পরে, পুরো পায়ে ছড়িয়ে যায়। দৌঁড়ানোর সময় ব্যাকফুটের সাথে শরীর ১৮০ ডিগ্রী এঙ্গেলে থাকা উচিত, অর্থাৎ আপনার পিছনের পা সোজা থাকতে হবে, ভাঙতে পারবেন না। পদার্থ বিজ্ঞানের টার্ম ব্যবহার করে না বুঝিয়ে সহজভাবে বলি। দুই পা স্ট্রেইট রেখে, হাঁটু ভাঁজ না করে স্বাভাবিকভাবে একবার হেঁটে দেখুন, আরেকবারে হাঁটু সামান্য ভাঁজ করে হেঁটে দেখুন।

হাঁটু স্ট্রেইট রেখে হাঁটার সময় যতটুকু মোমেন্টাম নিয়ে পরের স্টেপে যেতে পারছেন, ভাজ করে হাঁটার সময় সেই মোমেন্টাম পাবেন না। রান আপকে আর বেশি জটিল না করে, শেষ আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে বলি। দৌঁড়ানোর সময় শরীরের মোমেন্টামের কারণেই আমরা সরলরেখায় দৌঁড়াতে পারি না, একদিকে সরে যাই, ফলে রান আপে অতিরিক্ত শক্তি খরচ হয়ে যায়। রান আপ অনুশীলনের সময় একটা সরলরেখা টেনে চেক করে দেখতে পারেন। আবার, এই সরলরেখা ধরেই রান আপ স্ট্রেইট রাখার অনুশীলন করতে পারেন।

আমরা মোমেন্টাম নিয়ে যেই আলোচনা করছি, সেটিকে সংঘবদ্ধ করে পরের স্তরে ছুঁড়ে দেয়ার কাজটি ‘জাম্প’ এর। বোলিং এর ‘লোড আপ’ এর কাজটি জাম্প এর সময়েই করতে হয়। বোলিং এর ধরন অনুযায়ী লোড আপ ভিন্ন হয়৷ অর্থাৎ যারা জোরের উপরে নির্ভর করে বোলিং করেন, সাধারণত তাদের লোড আপ হয় শরীরের পাশে, বোলিং হ্যান্ড সামনে থেকে পিছনের দিকে টেনে এনে তারা শক্তি লোড করেন। ব্রেট লি, শোয়েব আখতার, লাসিথ মালিঙ্গা, শন টেইট কিংবা বিলি স্ট্যানলেক এর লোড আপ এমন।

বোলিং হ্যান্ড সোজা করে শরীরের উপর থেকে নিচের দিকে দিকে টেনে এনেও জোরে বোলিং এর জন্য লোড আপ করা যায়, শেন বন্ড, স্টিভ হার্মিসন, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ কিংবা আমাদের তাসকিন এভাবে লোড আপ করেন। যেই বোলাররা সাধারনত সিম এর উপরে নির্ভর করে বোলিং করেন, তাদের লোড আপ হয় শরীরের সামনে, বোলিং হ্যান্ড এবং নন বোলিং হ্যান্ড শরীরের খুব কাছে রেখে। ফলে, তাদের কন্ট্রোল কিংবা সিম পজিশন অপেক্ষাকৃত ভালো হয়।

উদাহরণ হিসেবে ম্যাকগ্রা, বোল্ট, আমাদের মাশরাফিসহ সিম বোলারদের দেখতে পারেন। আপনার বোলিং এর ধরন অনুযায়ী লোড আপ করবেন কিন্ত খেয়াল রাখবেন ল্যান্ডিংয়ের আগেই যেন লোড আপ সম্পন্ন হয়। ল্যান্ডিং এর পরে কেবল নিখুঁত রিলিজ/ডেলিভারির কাজটুকু বাকি থাকা উচিত। রান আপের প্রতি স্টেপে যেমনভাবে পায়ের তালুতে ল্যান্ড হবার কথা বলেছিলাম, ল্যান্ডিংয়ে সেটি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সম্পূর্ণ মোমেন্টাম সহকারে যখন জাম্প করছেন, ল্যান্ডিং ঠিক না হলে ইনজুরির প্রবণতা বেড়ে যাবে।

খেয়াল করলে দেখবেন, ফাস্ট বোলারদের যতটুকু ইনজুরি হয়, তার অধিকাংশই ঘটে ল্যান্ডিং ঠিকভাবে না হওয়ার কারনে। আবার, সিম বোলারদের জাম্প সাধারণত বড় না হওয়ার কারনে তাদের ল্যান্ডিংয়ে খুব একটা সমস্যা হয় না। ফলে তাঁদের ইনজুরির পরিমাণও কম থাকে। ল্যান্ডিং দুই ধরনের হয়, ‘ল্যান্ড ইন’ আর ‘ল্যান্ড আউট’। পরবর্তী লেখায় এই অংশ নিয়ে বিস্তারিত জানাবো, আপনারা গুগল করে এ সম্পর্কে দেখে নিতে পারেন, বল সুইং করানোর জন্য এই অংশের দরকার বেশ।

সর্বশেষ আলোচনা বলের রিলিজ নিয়ে। রিলিজের ক্ষেত্রে শরীরের উপরের অংশ এবং নিচের অংশের সমান ভূমিকা। শরীরের উপরের অংশ যখন কন্ট্রোল এর জন্য কাজ করে, নিচের অংশ তখন মোমেন্টামকে গতিতে রূপান্তরিত করার জন্য কাজ করে। বোলিং এর ধরণভেদে বলের রিলিজ পয়েন্টও পরিবর্তন হয়। যাদের রিলিজ পয়েন্ট শরীরের পাশে, বলের উপরে তাদের কন্ট্রোল অপেক্ষাকৃত কম হয়, ফলে সিম মুভমেন্ট কিংবা সুইং তাদের বেশি থাকে না।

অপরদিকে, রিলিজ পয়েন্ট শরীরের যত কাছে থাকে, বলের উপরে কন্ট্রোল তত বেশি পাওয়া যায়। রান আপের ক্ষেত্রে বলেছিলাম, পরের স্টেপে মোমেন্টাম নিয়ে যাওয়ার জন্য পা স্ট্রেইট রাখা , রিলিজের ক্ষেত্রে মোমেন্টামকে গতি শক্তিতে রুপান্তরিত করে ছুঁড়ে দেয়ার জন্য এটি আরো বেশি জরুরী। খেয়াল করলে দেখবেন, বেসবল থ্রোয়ার কিংবা চাকতি বা বর্শা নিক্ষেপের সময়ও থ্রোয়ার সামনের পা  সোজা রেখে ছুঁড়ে দেন।

উপরের আলোচনায় উদাহরণ হিসেবে একবারও ওয়াসিম আকরাম এর নাম রাখি নি। একটা নির্দিষ্ট জনরায় ওয়াসিমকে ফেলা সম্ভব নয়। তার মধ্যে সব কিছুই ছিলো, তার লম্বা রান আপের প্রয়োজন ছিলো না, লোড করার জন্য দীর্ঘ জাম্প এর প্রয়োজন ছিলো না, ইজি অ্যাকশন, শরীরের খুব কাছে লোড আপ এবং রিলিজ করতেন বলে বলের উপরে কন্ট্রোল ছিলো ঈর্ষনীয়, বোলিং কলার প্রায় সবকিছুই জানতেন। কিন্তু সবথেকে চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, এই সবকিছু করার সাথে সাথে তিনি অনেক বেশি গতি জেনারেট করতে পারতেন। এতখানি গিফট নিয়ে ক্রিকেটে সম্ভবত কোন বোলার কখনোই আসেন নি।

আগের লেখায় যখন বলেছিলাম, শরিফুলের ইজি অ্যাকশন আমি পছন্দ করেছি, তার কারণ ছিল তাঁর বোলিংয়ে অনেকাংশেই এই ফিচারগুলো দেখেছিলাম। সহজ একশন, ক্লোজ বল কন্ট্রোলের সাথে রিদম ঠিক রাখতে পারলে গতিও সঞ্চার করতে পারেন। তার রিদমের সমস্যাটা রান আপে। খেয়াল করলে দেখবেন, শরিফুলের রান আপ সাবলীল নয়। অধিকাংশ সময়ে তাকে জাম্পের ঠিক আগ মুহূর্তে গতি কমিয়ে জাম্প ব্যালান্স করতে হয়, ফলে তিনি মোমেন্টাম হারিয়ে ফেলেন এবং সেই বলের গতি নেমে আসে ১৩০-১৩২ কিলোমিটারে।

কিন্তু, যেই বলটিতে তিনি রান আপ সাবলীল রাখতে পারেন, সেই বলের গতি ১৪০ কিলোমিটারের উপরে চলে যায়, অপেক্ষাকৃত কন্ট্রোলও ভালো থাকে। তার রান আপ নিয়ে কাজ করতে হবে। আফসোসের জায়গা হলো, এই কাজটি তাকে জাতীয় দলে এসে করতে হচ্ছে, অথচ আগে থেকেই এই অংশগুলো ঠিক হয়ে আসার কথা ছিল। জাতীয় দলে এই অংশগুলোর পরিশীলন হওয়ার কথা ছিল, নতুন কিছু আবিস্কারের কথা ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link