হোয়াই সো সিরিয়াস!

কিথ মিলারকে একবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চাপের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘দূর, দূর, ক্রিকেট খেলায় আবার চাপ! তোমার পেছনে যদি ফাইটার প্লেন মিসাইল – বোমা নিয়ে শব্দের গতিতে তাড়া করে, সেক্ষেত্রে চাপ কাকে বলে বুঝবে।’

মিলার বুঝেছিলেন কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান এয়ার ফোর্সে তিনি ফাইটার পাইলট হিসেবে বেশ কয়েকটি মিশনে জার্মানি গিয়েছিলেন।

বেশ কিছুদিন আগে অস্কার জয়ী অভিনেতা ডেনজেল ওয়াশিংটন অভিনেতাদের মধ্যে আলোচনার সময় বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘আরে, আমরা তো সিনেমা করছি। এতে অত সিরিয়াস হওয়ার কি আছে? নিজের ছেলেকে ইরাক যুদ্ধে পাঠাবার আগে এত সিরিয়াস হলে তখন না হয় বুঝতাম।’

ওয়াশিংটনের সারা জীবনটাই লড়াই – তিনি নিজের কর্মজীবন আরম্ভ করেছিলেন জঞ্জাল সাফাইয়ের কর্মী হিসেবে। তাই ইনিও জীবনকে সঠিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখতে জানেন।

অ্যালান ডোনাল্ডের ব্রেন ফেডের পর বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টাই করে দক্ষিণ আফ্রিকার বিদায় মনে আছে? যদি মনে থাকে তাহলে আরও একটা কথা মনে থাকার কথা – সেই বিশ্বকাপে ল্যান্স ক্লুসনারের অনবদ্য লড়াই – প্রায় একার প্রচেষ্টায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে সেমি ফাইনাল অব্দি টেনে তুলেছিলেন ক্লুজনার।

সেমি ফাইনালেও প্রায় দলকে জিতিয়েই দিয়েছিলেন। সেই ক্লুজনার যখন সেদিন ম্যাচের শেষে প্যাভিলিয়নে ফিরে আসেন, তার প্রথম কথা ছিল, ‘Nobody died!’ তার বক্তব্য পরিস্কার – নিছক একটা ক্রিকেট ম্যাচ হেরে যাওয়ায় এত হা হুতাশের কী আছে?

তবে আমি যাদের খেলা দীর্ঘদিন ধরে দেখেছি, তাদের মধ্যে কেউ যদি এই দর্শন সবেচেয়ে নিখুঁত ভাবে অনুসরণ করতেন তার নাম বীরেন্দ্র শেবাগ। তিনি গান গাইতে গাইতে ব্যাট করতেন। একবার গানের একটা কলি মনে পড়ছিল না বলে অতিরিক্ত ফিল্ডারকে ডেকে সেটা জেনে নিয়েছিলেন।

আরও একবার বিপক্ষ দলের অধিনায়ককে লং অনের ফিল্ডার কাছে তুলে আনতে অনুরোধ করেছিলেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে সেক্ষেত্রে তিনি লং অনের ওপর দিয়েই ছক্কা হাঁকাবেন (হাঁকিয়েছিলেন; বিপক্ষ অধিনায়কের নাম ইনজামাম, বিভ্রান্ত বোলারের নাম কানেরিয়া)।

একটা বল বেশি স্যুইং করছে বলে নন স্ট্রাইকার অভিযোগ করায় তিনি তার সমাধানে বলেছিলেন, এক্ষুনি বলটা হারিয়ে দিচ্ছি (দিয়েছিলেন, স্টেডিয়ামের বাইরে বিশাল ছক্কা মেরে)। আর একবার নন স্ট্রাইকার শচীন তাকে বেশ কিছুক্ষন ছক্কা মারা থেকে বিরত রাখলে শেষে ২৯৫ রানের মাথায় শচীনকে নোটিস দিয়ে ছক্কা মেরে ত্রিশত রান পূর্ণ করেছিলেন।

এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে শুরু থেকেই হুড়ুম দুড়ুম করে ব্যাটিঙের কারণ জিজ্ঞেস করা হলে শেবাগ উত্তর দেন, ‘আসলে নতুন বল আমার দুর্বলতা। তাই আমি চেষ্টা করি যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব বলটাকে পুরনো করে দিতে।’

একমাত্র তিনিই ডেভিড ওয়ার্নারের খেলা টি-টোয়েন্টি খেলা দেখে তাকে ডেকে বলেছিলেন যে তিনি টেস্টেও নির্ঘাত সাফল্য পাবেন। কথাটা ওয়ার্নার বিশ্বাস করতে না চাইলে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘আরে টেস্টে পুরো দিন ধরেই পাওয়ার প্লে চলে, যত খুশি বাউন্ডারি মারা যায়।’

এই কথাটা মনে ধরেছিল ওয়ার্নারের। পরবর্তী কালে এ বি ডি ভিলিয়ার্স শেবাগের ফুটওয়ার্ক বিহীন ব্যাটিং টেকনিক অনুসরণ করে প্র্যাকটিস করতেন।

অথচ লোকটার রেকর্ডও একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। টানা ১৫০ রানের সবচেয়ে বেশি ইনিংসের রেকর্ড তার দখলে। ৩০০ বা তার বেশি রানের একাধিক ইনিংস খেলার রেকর্ড তার ছাড়া আর মাত্র তিন জনের আছে – ব্রায়ান লারা, ক্রিস গেইল এবং ডন ব্র্যাডম্যান।

২৯০ এবং তার বেশি রানের তিনটি ইনিংস খেলেছেন শেবাগ, এখানে লারাও নন, একমাত্র ডন তার পাশে বসতে পারেন। এবং ওপেনিং করে সবচেয়ে বিধ্বংসী স্ট্রাইক রেটের অধিকারীও ব্যাটিং ক্রিজে কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এই ব্যাটসম্যানের।

এই শেবাগ একবার ভারতের কোচ হওয়ার জন্যে আবেদন করেছিলেন। হলে সম্ভবত বাজবলের জন্যে এতটা অপেক্ষা করতে হত না। এবং পুজারা (বা অন্য কেউ) তিনশো বল খেলে হাফ সেঞ্চুরি করে ফেরত এলে নির্ঘাত প্যাভিলিয়নে তার হাতে আক্রান্ত হতেন (যেমনটা তিনি নিজে একবার হয়েছিলেন জন রাইটের হাতে, সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে)।

ইদানিং জল্পনা চলছে শেবাগের মানসপুত্র আবার ভারতের দলে ফিরে আসবেন কিনা সেই বিষয়ে। জুড়েল যেভাবে পরিণত ব্যাটিং এবং নির্ভরযোগ্য কিপিং করেছেন, অনেকেরই মতে এখন তারই আমাদের দলের উইকেট কিপার – ব্যাটসম্যান হিসবে প্রথম পছন্দ হওয়া উচিৎ।

তাতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু পান্ত যদি নিজেকে ফিট প্রমাণিত করতে পারেন তাহলে আমি চাইব তিনি সবসময় ভারতের প্রথম একাদশে থাকুন। কার জায়গায়? সেটা নিয়ে আমার তেমন মাথাব্যাথা নেই – যে কারও জায়গায়। মানে, সত্যিই যে কারও।

বহুদিন হয়ে গেল এক হাতের ছক্কা, ফাস্ট বোলিংয়ের  বিরুদ্ধে রিভার্স স্কুপ, ক্রিজে শুয়ে পড়ে স্যুইপ দেখি নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link