ওয়ানডে স্ট্যাটাস নেই, টেস্ট আঙিনায় পা পড়েনি কখনোই। কেনিয়ার ক্রিকেট এখন রীতিমত নিঃস্ব, রিক্ত। ২০০৭ ও ২০১১ বিশ্বকাপ অবধি যদিও টিম টিম করে জ্বলে ছিল কেনিয়ান ক্রিকেট। তবে এরপর একরকম নিভেই গিয়েছে দেশটির ক্রিকেট বাতি।
অথচ, এই কেনিয়াকেই বলা হতো বিশ্বকাপের জায়ান্ট কিলার। নব্বই দশক থেকে শুরু করে ২০০৩ বিশ্বকাপ, ক্রিকেটের অসংখ্য ‘দৈত্যবধ’-এর গল্প লিখেছে তাঁরা। সেই তালিকায় রয়েছে দুই বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজও।
দৈত্যবধের দুর্বিনীত দু:সাহসই বটে। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে এসেই কেনিয়ে হারিয়ে দিয়েছিল ব্রায়ান লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ১৯৯৪ সালে নিজ দেশে আয়োজিত আইসিসি ট্রফিতে রানার্সআপ হয়ে বিশ্বকাপে স্থান করে নিয়েছিল কেনিয়া।
মরিস ওদুম্বে, স্টিভ টিকোলো, দীপক চুদাসামা, কেনেডি ওটিয়েনো, মার্টিন সুজি, আসিফ করিম কিংবা হিতেশ মোদির মতো প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের নিয়ে তখন আফ্রিকার সিংহ হয়ে উঠেছিল কেনিয়া। তবে প্রথমবার বিশ্বকাপে পা রেখেই যে তাঁরা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দিবে, তা ছিল এক রকম বিস্ময়ের ব্যাপার।
সেই বিস্ময়ের ঘোর তো এখনও কাটেনি সে সময়ের উইন্ডিজ অধিনায়ক রিচি রিচার্ডসনের। দলে ছিল অ্যামব্রোস-ওয়ালস-বিশপ পেসত্রয়ী। যে সময়কালে এই পেস ট্রায়ো প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের কাছে বিরাট এক আতঙ্কের নাম। তা ছাড়া ব্যাটিং লাইনআপে ছিলেন জিমি এডামস, রিচি রিচার্ডসন, শিব নারায়ণ চন্দরপল, ব্রায়ান লারার মতো ব্যাটাররা।
এমন শক্ত লাইনআপ নিয়ে কেনিয়ার বিপক্ষে তাই আত্মবিশ্বাসীই ছিলেন অধিনায়ক রিচি রিচার্ডসন। টসে জিতে তাড়াতাড়ি ম্যাচ শেষ করবেন, এমন লক্ষ্যেই কিনা শুরুতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন তিনি। অল্প রানে বেঁধে ফেলার ভাবনায় সফলও ছিলেন রিচার্ডসন।
অ্যামব্রোস-ওয়ালশের বোলিং তোপে ৭৭ রানেই নেই ৫ উইকেট। কেনিয়া তখন ১০০ রানের নিচে গুঁটিয়ে যাওয়ার শঙ্কায়। শেষ ভরসা হিসেবে স্টিভ টিকোলোও ব্যক্তিগত ২৯ রানে ফিরে যান। তবে ৮১ রানেই ৬ উইকেট হারানো কেনিয়াকে কিছুটা আলোর পথ দেখানোর চেষ্টা করেন হিতেশ মোদী ও থমাস ওদোয়ো। তাদের জুটি থেকে আসে ৪৪ রান।
আর এতেই ১০০ রান পেরিয়ে যায় কেনিয়ার সংগ্রহ। শুধু তাই নয়, ১০০ পেরিয়ে দেড়শো রানের গণ্ডিও পার করে ফেলে তাঁরা। হিতেশ মোদী খেলেন ৭৪ বলে ২৬ রানের ইনিংসে। কেনিয়া শেষ পর্যন্ত ৪৯.৩ ওভারে অলআউট হয়েছিল বটে।
তবে, ১৬৬ রানের মান বাঁচানো পুঁজি পেয়ে যায় তাঁরা। এমন মামুলি সংগ্রহ তাড়া করতে নেমে বেশ নির্ভারেই ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন শারউইন চন্দরপল ও রিচি রিচার্ডসন। শুরুতে কেনিয়ার উইকেটরক্ষকের ভুলে দুজনই ‘জীবন’ পেয়েছিলেন।
কিন্তু, এরপরের দৃশ্যপটে রীতিমত চমকে যায় স্টেডিয়ামে থাকা দর্শক থেকে শুরু করে টেলিভিশনের ওপারে থাকা ক্রিকেট অনুরাগীরাও। রজব আলীর বলে বোল্ড হন রিচি রিচার্ডসন। তখনও ব্যাটিং ধ্বসের আভাস মেলেনি।
৩৩ রানের মাঝে যখন লারাও ফিরে গেলেন, তখন নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় পুনের গ্যালারিতে থাকা দর্শকরা। ক্যারিবিয়ানদের ধ্বসের শুরু সেখানেই। এরপর মরিস ওদুম্বের বলে একে একে ফিরে যান আথারটন, চন্দরপল ও জিমি এডামস। ৬৫ রানেই ৬ উইকেট হারানো ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য জয় তখন অনেক দূরের পথ।
লক্ষ্য যেহেতু ছোট, তাই ছোট্ট কোনো জুটি দাঁড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কাই ছিল কেনিয়ার জয়ের পথে একমাত্র বাঁধা। তার উপর প্রথমবারের মতো বিশ্বমঞ্চ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে সেই অভিজ্ঞতাতেই তাঁরা হেরে বসে কিনা, এমন কিছুরও সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছিল।
কিন্তু মরিস ওদুম্বের সেদিন ক্যারিবিয়ানদের প্রতিরোধই গড়তে দেয়নি। ১৬৬ রানের পুঁজি নিয়েই তাঁরা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বেঁধে ফেলে মাত্র ৯৩ রানে। ৭৩ রানের সেই ঐতিহাসিক জয়ে ৩ টি করে উইকেট নেন অধিনায়ক মরিস ওদুম্বে আর রজব আলী। তবে ম্যাচসেরা নির্বাচিত হন ১০ ওভারে ১৫ রান দেওয়া ওদুম্বে।
তবে ঐতিহাসিক এ ম্যাচের পরের ঘটনা আরো ঘটনাবহুল। এই ম্যাচের পরই বর্ণবাদ বৈষম্যের শিকার হন ব্রায়ান লারা।
এ ম্যাচ হারের পর কেনিয়ার ড্রেসিংরুমে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ম্যাচ হারাটা দু:খজনক। তবে এই হারটা আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দু:খজনক পরাজয় নয়। আমার সবচেয়ে বাজে দিন ছিল, ১৯৯২ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হারা। কেননা ঐ ম্যাচ হারের কারণেই আমরা সেমিতে উঠতে পারিনি।’
লারার এমন মন্তব্যের পরই তাঁকে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা বিদ্বেষের গল্প ছড়িয়ে পড়ে। যদিও সে বিশ্বকাপে এমন অঘটনের পর সেমিতে উঠেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর কেনিয়া এরপর থেকে বিশ্বকাপে চমকই দিয়ে গেছে।
২০০৩ সালের বিশ্বকাপে এই দলটিই শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে স্থান করে নিয়েছিল সেমিফাইনালে। এ ছাড়া বিশ্বকাপের বাইরে নন প্লেয়িং টেস্ট দেশ হিসেবে কেনিয়াই একমাত্র ভারতকে দুই বার হারের স্বাদ দিতে পেরেছে।
তবে সেই সেরা সাফল্যই এক সময়ে নিচে বেয়ে নামতে নামতে দেশটির ক্রিকেটে কাল হয়ে আসে। দূর্নীতির কালো থাবায় একদম নিঃশেষ হয়ে যায় তাদের ক্রিকেট যাত্রা। সময়ের স্রোতে কেনিয়া দলটা এখন পরিণত হয়েছে নখদন্তহীন সিংহে। যাদের থাবায় এখন আর কোনো ভাগ্য বদলায় না।