একটা সময় তাঁদের নামের সাথে বসানো হতো ‘চোকার্স’ ট্যাগ। বছর ২৫ ধরে মোটামুটি এই রীতিই চলে এসেছে আফ্রিকার সেরা এই দলের জন্য। কিন্তু সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে বদল হয় সবকিছুতেই, সেই দুর্ধর্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা এখন কালের নিয়মে সাধারণ দল, তাদের নামের সাথে এইমুহূর্তে ‘মিডিওকার’ শব্দটাই যেন বেশি মানানসই।
একটা সময় দারুন সব মহাতারকার ভিড়ে রাজত্ব করা দক্ষিণ আফ্রিকা এখন সেই সোনালি প্রজন্মকে শুধুই হাতড়ে বেড়ায়, দুর্ধর্ষ ডি ভিলিয়ার্স, ক্যালিস, স্মিথ, গিবস, পোলক, স্টেইন, ক্লুজনার, ডোনাল্ড দের যুগ অস্ত গিয়ে ডি কক, বাভুমা, রাবাদা, শামসিরা হাল ধরেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার, সেই সোনালি সুদিন আবারও ফেরানোর আশায়।
এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কী দক্ষিণ আফ্রিকার সেই ঘুরে দাঁড়ানোর টুর্নামেন্ট হবে নাকি বারবার বেদনা নিয়ে জোহানেসবার্গের বিমান ধরা দলটা এবারও সেই একই কাহিনী শোনাবে? টি-টোয়েন্টি র্যাংকিংয়ে অস্ট্রেলিয়া কিংবা ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ও আগে ৫ নম্বরে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকা গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর খেলা ৫১ ম্যাচের মধ্যে জয় পেয়েছে ২৭টাতেই। এছাড়া এ বছরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আয়ারল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কায় গিয়ে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জেতার ফর্ম ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে মরু দেশে মাঠে নামলে এ বিশ্বকাপ দক্ষিণ আফ্রিকার ঘুরে দাঁড়ানোর সেরা মঞ্চ হতেই পারে।
- শক্তিমত্তা
ব্যাট হাতে ওপেনিংয়ে কুইন্টন ডি কক, মিডল অর্ডারে রাসি ভ্যান ডার ডুসেন ও বল হাতে কাগিসো রাবাদা ও তাবরেজ শামসি গত কয়েক বছর ধরেই দক্ষিণ আফ্রিকার বড় ভরসা। নিয়মিত চমৎকার পারফরমেন্স করে চলা এই চার জনের ওপর বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি নির্ভর করবে প্রোটিয়া বাহিনী।
গত ২ বছরে ডি ভিলিয়ার্স এর ফেলে যাওয়া শূন্যস্থান কিছুটা ভরাট করার চেস্টা করে যাচ্ছেন একটু দেরিতেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রবেশ করা ডান হাতি মিডল অর্ডার ব্যাট ভ্যান ডার ডুসেন এর পাশাপাশি এই মুহূর্তে টি-টোয়েন্টি বিশ্ব র্যাংকিংয়ে সেরা বোলারের জায়গাটা কিন্তু তোলা রয়েছে চায়নাম্যান বোলার তাবরাইজ শামসির জন্য। ইমরান তাহিরের অবসরের পর শামসি টি২০ তে দুর্দান্ত ভাবে নিজেকে মেলে ধরেছেন। এই বিশ্বকাপে আমিরশাহীর পছন্দের কন্ডিশনে শামসি হতে চলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকা বোলিংয়ের সবচেয়ে বড় তুরুপের তাস।
এর পাশাপাশি মার্করাম ও রিজা হেনড্রিক্স ও ব্যাট হাতে যথেষ্ট কার্য্যকরী। কামিন্স, স্টার্ক, বোল্ট, বুমরাহ দের মতো বিশ্ব সেরা ফাস্ট বোলারদের সাথে একসাথে উচ্চারিত হয় কাগিসো রাবাদার নাম। এই বিশ্বকাপ তাঁর ও জ্বলে ওঠার সবচেয়ে বড় মঞ্চ, এর আগে আমিরশাহীতে আইপিএল এ চমৎকার পারফরমেন্স করে গেছেন রাবাদা, ফলত এই কন্ডিশনে ঠিক কেমন বোলিং দরকার তা তাঁর নখদর্পনে।
রাবাদা- নর্টজে ফাস্ট বোলিং জুটি ফর্মে থাকলে বিপক্ষের ব্যাটসম্যানের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেন। বিশেষ করে ডেথ ওভারে দুজনেই ইয়র্কার দেওয়ায় পটু, যা ডেথে বোলারদের একটা বড় অস্ত্র। বরাবরের মত দক্ষিণ আফ্রিকার অলরাউন্ড পারফরমেন্স এই বিশ্বকাপে চললে হারানো মর্যাদা ফিরে পেতেই পারে দক্ষিণ আফ্রিকা।
- দুর্বলতা
দক্ষিণ আফ্রিকার বরাবরের সমস্যা চাপের মুখে বড় ম্যাচে ভেঙ্গে পড়া, এবারের দলে যেহেতু বেশ কিছুটা অভিজ্ঞতার অভাব আছে সেটা আবারও প্রকট হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া ভালো ফিনিশারের অভাব ও ভোগাবে এই বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। ডেভিড মিলারের ওপর ভরসা করা কতোটা কাজের হবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
এছাড়া একার হাতে ম্যাচ জেতানো বা ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়া পারফরমেন্স করার লোকের যথেষ্টই অভাব এই দক্ষিণ আফ্রিকার। দলের ৪-৫ জন তারকা বাদ দিলে অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা সহ গোটা দলটাই বড় মাঝারিমানের। মাঝারিমানের দল নিয়েও চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা যায়, কিন্তু নতুন অধিনায়ক বাভুমা সেটা কতোটা করতে পারবেন এ বিষয়ে ঘোরোতর সন্দেহ আছে। লোয়ার অর্ডারে তেমন কোনো বিগ হিটার নেই, যাঁর ওপরে চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়। এই এতো নেই রাজ্যের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে দাঁড়ালে সেটাই বিরাট চমক হবে।
- দক্ষিণ আফ্রিকা দল ও তাঁদের সম্ভাবনা
ডি ভিলিয়ার্স বা ইমরান তাহিরকে অবসর ভেঙ্গে আবার দলে ফেরানোর কথা বহুদিন ধরে শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি, সবচেয়ে আজব ব্যাপার হলো দীর্ঘদিনের অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসিসকে নিয়ে যেটা হলো। ডু প্লেসিস টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ালেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দিকে তাকিয়ে, সেই ডু প্লেসিসকেই বিশ্বকাপ দলে নেওয়া হলো আগের কয়েকটি সিরিজ তিনি খেলতে পারেননি বলে। ডু প্লেসিস না থাকায় দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং এ যথেষ্ট শূন্যস্থান তৈরি হল, একথা দক্ষিণ আফ্রিকা বোর্ড কবে বুঝবে? হয়তো বিশ্বকাপ শেষে।
তাঁরা বিশ্বকাপ শেষে হয়তো বুঝবেন জর্জ লিন্ডের মত তরুণ বাঁহাতি স্পিনারকে আমিরশাহীর কন্ডিশনে বাদ দিয়ে কী ভুল করেছেন। পাওয়ার প্লে কিংবা মিডল ওভার গুলোতে টাইট বোলিং করা উইকেট তুলে নেওয়ায় লিন্ডে যথেষ্ট কার্যকরী ছিলেন শেষ বছর দুয়েক।
এছাড়া ৮ নম্বরে নেমে ব্যাট হাতেও ভালো অপশন হতে পারতেন লিন্ডে। ক্রিস মরিসের না থাকাও দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য মোটেই ভালো ব্যাপার নয়, মরিসের বদলে যে দুই অলরাউন্ডার সুযোগ পেলেন সেই উইয়ান মূল্ডার বা ডোয়েন প্রিটোরিয়াস দুজনেই আহামরি নন, যদিও দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্মার।
যদিও রাবাদা, নরকে, এনগিডি, শামসি, মহারাজ কে নিয়ে গড়া বোলিং লাইন আপ যথেষ্ট উঁচু মানের। যদিও ব্যাটিং নিয়ে চিন্তা থেকেই যায় এ দলের। নজর থাকবে উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান ক্লাসেনের দিকে, স্লগ ওভারে তিনিই ভরসা হতে পারেন। মোটামুটি মাঝারিমানের দল নিয়ে মরু অভিযান শুরু করতে চলা প্রোটিয়া বাহিনীর লড়াই মোটেই সহজ হবে না, যেহেতু তাঁরা ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মত দল গুলো থাকা গ্ৰুপে রয়েছে। এরকম গ্ৰুপ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা নক আউটে যেতে পারলেই যথেষ্ট ভালো পারফরমেন্স বলে ধরা যেতে পারে।
- দক্ষিণ আফ্রিকা স্কোয়াড
টেম্বা বাভুমা (অধিনায়ক), কুইন্টন ডি কক, রিজা হেনড্রিক্স, এইডেন মার্করাম, ডেভিড মিলার, রাসি ভ্যান ডার ডুসেন, ডোয়াইন প্রিটোরিয়াস, উইয়ান মুল্ডার, ক্যাগিসো রাবাদা, এনরিচ নরকে, লুঙ্গি এনগিডি, তাবরাইজ শামসি, বিয়র্ন ফরটুইন, কেশব মহারাজ, হেনরিখ ক্লাসেন।