নামটা আমার লিখে রেখো

২৪ এপ্রিল, ১৯৯৬ সাল।

‘ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য এখনো তৈরি নয় …’

দিল্লীর তাজ প্যালেস হোটেলের সুরম্য কক্ষে আসন্ন বিলেত সফরের দল নির্বাচনের জন্য আয়োজিত বৈঠকে যখন পূর্বাঞ্চলের নির্বাচক সম্বরন বন্দোপাধ্যায় যখন বেহালার ছেলে সৌরভ গাঙ্গুলির জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্তির জন্য তদবির করছেন তখন জাতীয় দলের প্রশিক্ষক সন্দীপ পাতিল উপরিউক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন।

তবুও, ছেলেটার ব্যাটসম্যানশিপের থেকেও ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বিলেতের পরিবেশে উপযুক্ত সিম বোলিংয়ের প্যাকেজিংয়ে নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ ভরসা করেছিলেন বলে শেষমেশ কলকাতার ছেলেটার বিলেতের বিমানে ওঠা হল।

২২, জুন ১৯৯৬ সাল।

গত দুই মাসে টেমস কিংবা গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। পাশাপাশি সফরকারী ভারতীয় ক্রিকেট দলের অন্দরমহলেও অনেক সম্পর্কের চোরাস্রোত বয়েছে – তার ফলশ্রুতিতেই প্রথম একাদশের গুরুত্বপূর্ন সদস্য ব্যাটসম্যান নভজ্যোৎ সিং সিধু দেশে ফিরে এসেছেন।

বার্মিংহ্যামের এজবাস্টন ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্টে বোলিং অলরাউন্ডার হিসাবে বাঁ হাতি স্পিনার সুনীল যোশিকে খেলানোর সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়েছে।

টেস্ট সিরিজে ১ – ০ পিছিয়ে থেকে অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন বেহালার সৌরভ গাঙ্গুলির নাম প্রথম একাদশে অন্তর্ভুক্ত করে খ্যাতনামা লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে টস করতে নামলেন ছেলেটার সিমিং উইকেটে বল হাতে সফল হওয়ার সম্ভাবনার কথা ভেবে। তখনও কোচ সন্দীপ পাতিলের নেতৃত্বাধীন টিম ম্যানেজমেন্ট ছেলেটার ব্যাটিংয়ের উপর ভরসা করতে রাজি নয়।

ম্যাচের দ্বিতীয় দিন ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের দলের প্রথম ইনিংসে ৩৪৪ রানের প্রত্যুত্তরে ভারতীয়রা ব্যাট করতে নেমে যখন ওপেনার বিক্রম রাঠোর দলের মাত্র পঁচিশ রানের মাথায় প্যাভিলিয়নের পথ ধরলেন, তখনও দিনের খেলা বেশ কিছুটা বাকি।

যে ছেলেটার ব্যাটিংয়ের উপর টিম ম্যানেজমেন্টের বিন্দুমাত্র ভরসা ছিল না সেই ছেলেটাকেই কিনা দলের বিপদে রক্ষাকর্তার ভূমিকা পালন করতে ফার্স্ট ডাউনে ব্যাট করতে পাঠানো হল নাকি ছেঁটে ফেলার জন্য জেনেবুঝে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হল?

সামনে ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিপদ-আপদ, যাই থাকুক না কেন ছেলেটাকে আলোর খোঁজে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতেই হবে। সে তো গত চার বছর ধরে এই একটা সুযোগের জন্য হাপিত্যেশ করে বসেছিল। গত চার বছর ধরে প্রতিটা দিন, প্রতিটা ঘন্টা, প্রতিটা মিনিট, প্রতিটা সেকেন্ড ধরে সে তার বিরুদ্ধে ওঠা মিথ্যা অভিযোগগুলোর জবাব দেওয়ার জন্য, তার উপর ভরসা করতে না পারা মুখগুলোকে জবাব দেওয়ার জন্য, তাকে গোঁড়াতেই ছেঁটে ফেলতে চাওয়া ভারতীয় ক্রিকেটের রথী – মহারথীগুলোকে জবাব দেওয়ার জন্য গত চার বছর ধরে নিজের ব্যাটিংয়ে শান দিয়ে এমন একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। তার ভয় কিসের ? তার তো হারাবার কিচ্ছুটি নেই। বরং, জয় করবার জন্য পুরো পৃথিবীটা পড়ে রয়েছে।

পরদিন ছেলেটা টেস্ট অভিষেকে ঐতিহ্যশালী লর্ডসে শতরান হাঁকিয়ে শত প্রশ্ন, শত অবিশ্বাস, শত অনাস্থার সপাটে জবাব দিল – ‘বাপি বাড়ি যা’। ভারতীয় ক্রিকেটে শুরু হল – ‘দাদাগিরি’। পরিচয় পাল্টেছে এরপর অনেকবার, তবে সৌরভ গাঙ্গুুলির দাদাগিরি আজও চলছে বহাল তবিয়তেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link