হেলমেট ফেলে আকাশের দিকে দুই হাত প্রসারিত করে তাকিয়ে থেকে উল্লাস, উদযাপন। খুব অল্পদিনের ক্যারিয়ার। তবে যশস্বী জয়সওয়ালের এই সেলিব্রেশন এখন চিরায়ত হওয়ার পথে। বিশাখাপত্তনম টেস্টের পর রাজকোট টেস্টে এসেও করলেন ডাবল সেঞ্চুরি। ২১ পেরোনো যুবকের এমন ইনিংসে মুগ্ধ হয়ে ড্রেসিংরুমে বসে হাততালি দিলেন ইংল্যান্ডের কোচ ব্রেন্ডন ম্যাককালামও।
অথচ ‘বাজবল’ মূলমন্ত্রের এ পরিচালক নিজেই উদাসমনে রাজকোট টেস্টের চতুর্থ দিন জুড়ে জয়সওয়ালের তাণ্ডবের সাক্ষী হলেন। যেখানে তাঁর দলের বোলাররা রীতিমত অসহায় বনে গিয়েছে। একই সাথে ম্যাচ হারের তীব্র শঙ্কাও জেগেছে জয়সওয়ালে ওই ইনিংসে। তবুও এমন একটা ইনিংসে ম্যাককালাম যেন ফিরে গেলেন নিজের ক্যারিয়ারেই।
২০১৪ সালের ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৯৫ রানের ইনিংস খেলার পথে ১১ টা ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। ১০ বছর পরে এসে, রাজকোটে যখন তিনি কোচ হয়ে ইংলিশ ডাগআউটে, তখন তাঁর দলের বিপক্ষেই এক ইনিংসে ১২ টা ছক্কা হাঁকালেন জয়সওয়াল।
যা টেস্ট ক্রিকেটে এক ইনিংসে যৌথভাবে সর্বোচ্চ। ১৯৯৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অপরাজিত ২৫৭ রানের ইনিংস খেলার পথে ১২ টি ছক্কা মেরেছিলেন তিনি। বলাই বাহুল্য, ২৮ বছর পর এসে ওয়াসিম আকরামের সেই রেকর্ডটাকেই স্পর্শ করলেন কেউ।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ২১৪ রানের ইনিংসে জয়সওয়ালের নিজের নামের পাশে যোগ হয়েছে আরো বেশ কিছু কীর্তি। এক ইনিংসে ছক্কা মারার দিক দিয়ে নাহয় তাঁর পাশে এখনও ওয়াসিম আকরামের নামটা অক্ষত থাকছে। কিন্তু এক টেস্ট সিরিজে সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ডটা এখন শুধুই তাঁর একার।
২০১৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এক টেস্ট সিরিজে সর্বমোট ১৯ টা ছক্কা মেরেছিলেন রোহিত শর্মা। ততদিনে ১৪৭ বছরের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে এক সিরিজে কেউই ২০ ছক্কার গণ্ডি পেরোতে পারেননি। অথচ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫ ম্যাচের এই সিরিজের প্রথম ৩ ম্যাচেই ২২ টা ছক্কা হাঁকিয়েছেন জয়সওয়াল। এখন দেখার পালা, এই সংখ্যাটা সিরিজ শেষ করদূর গিয়ে গড়ায়।
টেস্ট ক্রিকেটে পা পড়ার আগেই জয়সওয়াল রঞ্জি ট্রফি থেকে শুরু করে দিলীপ ট্রফি, ইরানি কাপ কিংবা ৫০ ওভারের টুর্নামেন্ট বিজয় হাজারে ট্রফিতেও ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। আর এখানেই তিনি গড়েছেন অনন্য এক কীর্তি। ক্রিকেট ইতিহাসে জয়সওয়ালই এখন একমাত্র ক্রিকেটার যার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের আওতাভূক্ত সব টুর্নামেন্টসহ টেস্টেও ডাবল সেঞ্চুরি রয়েছে।
না এখানেই শেষ নয়! ভারতের প্রথম ব্যাটার হিসেবে ক্যারিয়ারের প্রথম তিনটি শতককেই ১৫০ এর বেশি রানের ইনিংসে রূপ দিয়েছেন জয়সওয়াল। টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে এমন বিরল রেকর্ডে জয়ওয়ালের উপরে রয়েছেন একজনই। ক্যারিয়ারের প্রথম ৪টি শতককেই ১৫০-এর উপরে নিয়ে গেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক ব্যাটার গ্রায়েম স্মিথ।
রাজকোটে ডাবল সেঞ্চুরি করে তৃতীয় ভারতীয় ব্যাটার হিসেবে পরপর দুটি টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন যশস্বী জয়লওয়াল। ভারতীয় ব্যাটার হিসেবে যে কীর্তি এর আগে ছিল বিনোদ কাম্বলি ও বিরাট কোহলির। এবার তাদের সাথে একই আসনে বসলেন যশস্বী।
এ ছাড়া এর আগে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি কড়ে ডাবল সেঞ্চুরির কীর্তি ছিল বিরাট কোহলি, সুনীল গাভাস্কার, বিনোদ কাম্বলি, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, রাহুল দ্রাবিড়, চেতেশ্বর পুজারা ও মনসুর আলি খান পতৌদির। এক ম্যাচ আগেও যার এই তালিকায় সংযুক্তি হয়েছিলেন নতুন সদস্য হিসেবে, সেই জয়সওয়ালই রাজকোট টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি দিয়ে এবার সবাইকে ছাপিয়ে গেলেন। এখন পর্যন্ত জয়সওয়ালই প্রথম ও একমাত্র ভারতীয় ব্যাটার যার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি দ্বিশতক আছে।
বাঁ-হাতি ব্যাটার হিসেবেও অনন্য এক রেকর্ড গড়েছেন জয়সওয়াল। বাঁহাতি ব্যাটার হিসেবে টেস্টে এক সিরিজে সবথেকে বেশি রানে রেকর্ড এতদিন ছিল সৌরভ গাঙ্গুলীর। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে ৫৩৪ রান করেছিলেন তিনি। ১৭ বছর বাদে এবার সেই রেকর্ড নিজের করে নিলেন জয়সওয়াল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে এখনও ২ টেস্ট বাকি। তার আগেই ৫৪৫ রান করে ফেলেছেন এ বাঁহাতি ব্যাটার।
জয়সওয়ালকে নিয়ে শচীন টেন্ডুলকার বলেছিলেন, এই ছেলে ভারতের ভবিষ্যৎ তারকা হতে যাচ্ছে। শচীনের সেই ভবিষ্যদ্বাণী যেন এখনই বাস্তব হয়ে ধরা দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের এখন এক বছরও পূর্ণ হয়নি। তাতেই রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করে দিয়েছেন তিনি। ১৪৭ বছরের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে যা এর আগে হয়নি, সেটিই এখন হচ্ছে ২১ বছর বয়সী এ ক্রিকেটারের হাত ধরে। ভারতীয় ক্রিকেট তো বটেই, ক্রিকেট দুনিয়ায় জয়সওয়াল আর এখন ভবিষ্যৎ নয়, বরং তিনি বর্তমান তারকা।