কেনিয়ার সোনালি দিনের ট্র্যাজিক হিরো

‘আমি কারো টাকা চুরি করিনি। তারপরও পাঁচ বছরর জন্য নিষিদ্ধ হলাম কেবল যোগাযোগ থাকার জন্য। আমি কখনোই ম্যাচ পাতানোর সাথে জড়িত ছিলাম না। তদন্তকারীরা বারবারই আমার কাছে জানতে চেয়েছে, এতদিনের পরিচয়ের পরও তুমি কি করে না জেনে থাকতে পারো যে ও একজন বুকি নয়! আমি বারবারই বলেছি, ওটা তো আর ওর কপালে লেখা ছিল না!’

২০১৫ বিশ্বকাপ খেলাই হল না, হারাতে হল ওয়ানডে স্ট্যাটাসও। কেনিয়ার ক্রিকেটের ভঙ্গুর দশা আরও দীর্ঘায়িত হল। ২০০৩ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে ওঠার ইতিহাসটাই তখন ভুলে গেছে সবাই। মরিস ওমান্ডি ওদুম্বেকে তাই মনে রাখার প্রশ্নই আসে না। সেই বিশ্বকাপে ৪২ গড়ে ব্যাট করে, নয় উইকেট পেয়েও তিনি হারিয়ে গেছেন। মনে রাখার কারণও নেই, ২০০৪ সালে তো তিনি নিষিদ্ধই হয়ে গেলেন।

ম্যাচ পাতানোর কোনো অভিযোগ তিনি স্বীকার করেননি। শুধু বলেছিলেন বুকি ও ভারতীয় ব্যবসায়ী জগদীশ সোধার সাথে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। ‘ও আমাকে বলেছিল যে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে। দু’টো পোস্টারে ওর নামও দেখেছি। ওর কার্ডেও লেখা ছিল না যে ও বুকমেকার।’ মরিসের সাফ কথা।

তাঁর স্বীকোরোক্তি ধোপে টেকেনি, কারণ এই ‘ভদ্রলোক’-এর সাথে মরিসের আট বছর যোগাযোগ ছিল। যদিও, মরিস বলেছিলেন, ‘আমরা খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম না। হাই-হ্যালো সম্পর্ক ছিল আর কি!’

আক্ষেপ করে মরিস বলেন, ‘আমি কারো টাকা চুরি করিনি। তারপরও পাঁচ বছরর জন্য নিষিদ্ধ হলাম কেবল যোগাযোগ থাকার জন্য। আমি কখনোই ম্যাচ পাতানোর সাথে জড়িত ছিলাম না। তদন্তকারীরা বারবারই আমার কাছে জানতে চেয়েছে, এতদিনের পরিচয়ের পরও তুমি কি করে না জেনে থাকতে পারো যে ও একজন বুকি নয়! আমি বারবারই বলেছি, ওটা তো আর ওর কপালে লেখা ছিল না!’ এসব কোনো কিছুকেই অবশ্য আইসিসি তোয়াক্কা করেনি।

বিচার প্রক্রিয়াতেও গলদ দেখেন মরিস, ‘সব সময় দেখে এসেছি যে এসব ক্ষেত্রে একজন স্থানীয় বিচারক থাকেন, যিনি কিনা তাঁর প্রাপ্ত তথ্য আইসিসিকে ফরোয়ার্ড করেন। আমার ক্ষেত্রেও তাই হল, আইসিসিই সব তদন্ত করলো, আর আমাকে নিষিদ্ধ করে দিল।’

সময়টাতে কেনিয়ার বোর্ডও পাশে ছিল না মরিসের, ‘অন্তত এসব ইস্যুতে খেলোয়াড়রা নিজেদের বোর্ডকে পাশে পায়। আমার ক্ষেত্রে হল উল্টো। বোর্ড আমাকে কসাইয়ের ছুঁড়ির নিচে রেখে পালালো। বিষয়টা আসলে কি ছিল, আমি এখনো বুঝতে পারি না!’

মরিসের দাবী, তাঁর সাবেক স্ত্রী ক্যাথেরিন ম্যালোনেও তাঁকে ধোঁকা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বাকিদের আর কি বলবো, নিজের স্ত্রী পর্যন্ত আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। একটু যদি দেখেন, আমার কেসে যারা সাক্ষী দিয়েছেন, তাদের শতকরা ৯৯ ভাগ আমার সাবেক প্রেমিকা। ওরা তো অবশ্যই আমার বিপক্ষে বলবে।’

‘আপনি যদি শেন ওয়ার্ন কিংবা মার্ক ওয়াহ’র দিকে তাকান দেখবেন, এই সবাই নিজেদের ক্যারিয়ারে স্বীকার করেছেন যে তাঁরা বুকমেকারদের তথ্য দিয়েছেন। ওদের তো কিছু হয়নি। আমার কেন হল, কালো বলে?’

২০০৯ সালে টম টিকোলের বিরুদ্ধে ১০ হাজার ডলার আত্মসাৎ-এর অভিযোগ উঠেছিল। তিনি বহাল তবিয়তেই ছিলেন। অথচ, ওদুম্বেকে চলমান ম্যাচ থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয় (কেনিয়া-ভারত এ, ১৪ আগস্ট, ২০০৪)। কেনিয়ার আর কোনো খেলোয়াড়ের বিপক্ষেই আর কোনো দুর্নীতির অভিযোগ কখনো প্রমাণ করা যায়নি।

‘আমার দোষ ছিল একটাই, একজন বাজে লোকের সাথে বন্ধুত্ব করা। কিন্তু, যদি খেলাধুলার প্রতি আমার নিষ্ঠা নিয়ে বলতে চান, তাহলে আমি বলবো নিজের সেরাটাই আমি দিয়েছি, নিজের সব দিয়েছি। এতকিছুর পরও আমার শান্তিতে ঘুম হয়, কারণ আমি জানি আমি নির্দোষ, ভুল ভাবে আমাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বিবেচনা করে আমাকে পুনরায় আবেদনেরও সুযোগ দেওয়া হয়নি।’

কেনিয়ার ক্রিকেটে মরিস ও তাঁর পরিবারের অবদানের কথা বিবেচনা করলে এই শাস্তিটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক ছিল। ১৯৬৩ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পরও দেশটিতে সাদা ও এশিয়ানদের জনসংখ্যাগত আধিপত্তই বেশি ছিল। একটু একটু করে দেশটিতে আফ্রিকানরা থিতু হতে ‍শুরু করেন।

১৯৭৬ সালে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান হিসেবে কেনিয়া দলে খেলার সুযোগ পান কেনেথ ওধিয়াম্বো ওদুম্বে। কালক্রমে তাঁর ভাই খেলেন কেনিয়ার হয়ে। কেনিয়ায় খেলাটা কালোদের জন্য স্রেফ একটা খেলাই ছিল না, ছিল জীবনের অন্ধকার থেকে বাঁচার একটা মাধ্যমও।

ওদুম্বে পরিবার নাইরোবির সরকারি চাকুরেদের কলোনিতে বড় হন। তাঁদের বসবাস স্যার আলী ‍মুসলিম ক্লাবের ঠিক বিপরীতে। আগ্রহ ভরা চোখ দিয়ে ওই সময় খেলা দেখতেন। নিজেদের মধ্যেও খেলতেন। একটা কাঠের টুকরাকে ব্যাট বানাতেন। বল হত ভুট্টার ছোবড়া। মরিস বলেন, ‘রাস্তায় খেলতাম। আমাদের উইকেট হত ডাস্টবিন।’

ক্লাবটা একদম পাশেই হওয়াতে তাঁদের প্রতিভা দ্রুত নজরে আসে। চার ভাই ক্লাবটির হয়ে খেলা শুরু করেন। ১৪ বছর বয়স থেকে মরিসের স্কুল ফিও দিয়ে এসেছে স্যার আলী মুসলিম ক্লাব। মরিস বলেন, ‘স্কুলে আমি রাগবি আর ফুটবল খেলতাম। স্কুল থেকে ফিরে মন দিয়ে খেলতাম ক্রিকেট, আমি জানতাম আমাকে দ্রুত রোজগার করতে হবে।’

কেনিয়ার আরেক ক্রিকেটীয় পরিবার টিকোলো পরিবারের দুই ভাই স্টিভ টিকোলো ও টম টিকোলোর গল্পও অনেকটা এমনই। তাঁরাও ‍ওই মুসলিম ক্লাবের কাছেই বড় হয়েছন। ওদুম্বে ভাইদের সাথে ক্রিকেট খেলেন। পার্থক্য এটুকুই যে তাঁদের পরিপূর্ণ ক্রিকেটার করে তুলেছে স্বামিবাপা স্পোর্টস ক্লাব।

এই দু’টো পরিবার কালক্রমে হয়ে উঠেছে কেনিয়া ক্রিকেটের মহীরুহ।  ১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফিতে যে কেনিয়ান দলটি রানারআপ হয়, সেখানে ছিল এই দুই পরিবারের তিন সদস্য। প্রথমবারের মত তাঁরা ১৯৯৬ সালে খেলতে যায় বিশ্বকাপ। তখন থেকেই ক্রিকেটের জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটা পরিবারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায় কেনিয়ার ক্রিকেট।

১৯৯৫-৯৬ মৌসুমের শীতে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম শ্রেণির দল বোর্ডারের হয়ে খেলেন স্টিভ টিকোলো। বাকিরা দেশেই বিশ্বকাপের প্রস্তুতি সারছিলেন। ওই সময় উন্নত মানের বলের দাবী বোর্ডের কাছে করেছিলেন ক্রিকেটাররা। বোর্ড বিশ্বকাপে ব্যবহৃত দামী সাদা বল কিনে দিতে পারেনি। লাল বলেই সাদা রং করে তাঁদের কাজ চালাতে হত।

বিশ্বকাপ চলাকালে যাতায়াত বাবদ ক্রিকেটারদের কেবল ১০ ডলার করে দেওয়া হয়েছিল। এর কোনো কিছুই খেলোয়াড়দের গায়ে লাগেনি, কারণ সেবার তাঁদের সামনে মাত্র ৯৩ রানে অলআউট হয়ে যায় প্রতাপশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। প্রথম বিশ্বকাপে নেমেই সাবেক চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে দেয় অধিনায়ক মরিস ওদুম্বের দল।

এর বছর দুয়েক আগের একটা ঘটনা সেদিন মনে পড়ছিল ওদুম্বের। ইংল্যান্ডের সোয়ানসিতে একটা ক্লাবের হয়ে খেলতেন ওদুম্বে। ওয়ারউইকশায়ারের একটা ম্যাচ দেখার পর লারার অটোগ্রাফ চেয়েছিলেন। লারা নাকোচ করে দেন।

বিশ্বকাপে সেই লারাদের বিপক্ষে ১৫ রানে তিন উইকেট পেয়েছিলেন ওদুম্বে। ওদুম্বে ম্যাচ শেষে ড্রেসিংরুমে লারার সাথে দেখা করেন, তাঁর হাতে নিজের অটোগ্রাফ তুলে দিয়ে বলেন, ‘আমি তোমার কাছে  অটোগ্রাফ চেয়েছিলাম, দাও নি। এবার তুমি চাইলে আমারটা নিতে পারো।’

শুধু লারাই নয়, ওই সময় ক্রিকেট বিশ্বের আরো অনেক বড় তারকা চিনে গিয়েছিল এই মরিস ওদুম্বেকে। তখন নিয়মিত খেলার সুযোগ পাচ্ছিল কেনিয়া। নানা রকম ত্রিদেশীয় কিংবা চতুর্দেশীয় টুর্নামেন্টে তাদের দেখা ছিল। বাংলাদেশের পর তারাই ক্রিকেট বিশ্বের ১১ তম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হতে যাচ্ছে – এমনটা ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’।

এরপর আসে ২০০৩ সালে আসে সেই অবিস্মরণীয় সাফল্য। সেটাও যথেষ্ট হল টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য, যথেষ্ট হল না ক্রিকেটে কেনিয়ার টিকে থাকার জন্য। কারণটা পরিস্কার, অবকাঠামো আর জনপ্রিয়তা। ইংল্যান্ডের যেকোনো পাবলিক স্কুলের মাঠে যতগুলো নেট আছে, গোটা কেনিয়াতেও ততগুলো নেই। দেশটির ক্রিকেট কেবল কয়েকটা পরিবারের মধ্যে সীমিত, সেইটা এই আজকের দিনে এসেও সত্যি।

কেনিয়ার হয়ে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ খেলা অধিনায়ক আসিফ করিম বলেছিলেন, ‘কেনিয়ার ক্রিকেট মরে গেছে।’ মরিস ওদুম্বে আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, ‘কেনিয়ার ক্রিকেট মরে গেছে, শেষকৃত্যও শেষ।’

‘আমরা হেরে গেছি, নৌকাটায় চড়তে পারিনি। ক্রিকেট আমাদের জন্য এখন একটা বন্ধ দোকান। এখানে ক্রিকেট গুটিকয়েকের খেলা। তুমি যদি কোনো ক্লাবের অংশ না হও, তাহলে তুমি ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন ভুলে যাও। ‘ মরিসের আক্ষেপ।

পাঁচ বছরের নির্বাসন শেষ করে ২০০৯ সালে যখন আবারো নাইরোবির স্টেডিয়ামে গেলেন মরিস ওদুম্বে, তখন তাঁর বয়স ৪০। সেই সময়ও আশে পাশে তরুণ যেসব ক্রিকেটার ছিলেন, সবার চেয়ে সেরা ছিলেন মরিস নিজেই। এটাই তো কেনিয়ার ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সংকট। নিষেধাজ্ঞার অতীত না থাকলে হয়তো ওই সময়ে দলে ডাকও পেয়ে যেতেন।

‘যারা ক্রিকেট বোঝেন, এতটা নিচে নামা দেখে তাদের অন্তত লজ্জিত হওয়া উচিৎ’ মরিস বলেন। কিন্তু খোদ মরিসের অতীত জীবন, কেনিয়ার ক্রিকেট প্রশাসকদের দুর্নীতি – এসব কিছুই কেনিয়ার ক্রিকেটকে চিরতরে ভুলিয়ে দিতে পেরেছে!

ওহ, হ্যাঁ, কেনিয়া জাতীয় ক্রিকেট দলের কোচও ছিলেন এই ওদুম্বে। ২০১৮ সালে মে-তে তিনি দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কেনিয়া ক্রিকেটকে আবারো কক্ষপথে ফেরানোর মিশন ছিল তাঁর হাতে। কিন্তু, সেবারও ব্যর্থতা নিয়েই বিদায় নিতে হয় তাঁকে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...