প্রতি মৌসুমেই দলবদলে বড় অংকের অর্থ খরচ করলেও ইউরোপিয়ান মঞ্চে এখনো সাফল্য পায়নি পিএসজি। এবারের মৌসুমেও কেবল লিগা ওয়ান জিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে দলটিকে। আসুন দেখে নেয়া যাক, এবারের মৌসুমে পিএসজির ব্যর্থতার দশ কারণ।
- লিওনেল মেসির ক্লাব ছাড়তে চাওয়া
বিশ্বকাপের পর থেকেই যেন বদলে গেছে লিওনেল মেসির দুনিয়া। পরম আরাধ্য ট্রফিটা জেতার পর থেকেই মাঠে তাঁকে যেন আগের মতো উৎসাহী লাগছে না।
পিএসজির ফর্ম হারানোর শুরুটাও জানুয়ারির পর থেকেই। সেই দায়ভার তাই খানিকটা মেসির কাঁধেও আসবে। বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তো ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে।
তাছাড়া পুরনো ক্লাব বার্সেলোনায় ফেরার গুঞ্জন তো আছেই। মৌসুম যত শেষের দিকে গড়াচ্ছে মেসির পিএসজি ছাড়ার খবর তত জোরালো হচ্ছে। পিএসজি সমর্থকরাও মেসিকে আর তাঁদের জার্সিতে দেখতে চাইছেন না।
- নেইমারের ইনজুরি
প্রতি মৌসুমেই নেইমারের অ্যাংকেলের ইনজুরিতে পড়া নিয়মিত দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবারের মৌসুমেও অস্ত্রোপচারের কারণে মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে বড় একটা সময়।
যদিও পরিসংখ্যানের বিচারে ভালো সময় কাটিয়েছেন এই ব্রাজিলিয়ান তারকা। লিগা ওয়ানে ১৩ গোলের পাশাপাশি ১১ অ্যাসিস্ট আছে তাঁর নামের পাশে। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গুরুত্বপূর্ণ সময়েই তাঁকে মাঠে পায়নি পিএসজি।
প্রতি মৌসুমেই নেইমারের ক্লাব ছাড়ার গুঞ্জন উঠলেও প্রতিবারই থেকে গেছেন প্যারিসের ক্লাবটিতে। তবে মেসির ক্লাবত্যাগ, এমবাপ্পের হাতে দলবদলের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ থাকা – সব মিলিয়ে এই মৌসুম শেষে নেইমারের ক্লাব ত্যাগ অনেকটাই নিশ্চিত।
- বাজে ডিফেন্স
আজকের দিনে কেবলমাত্র আক্রমণ ভাগ দিয়ে মোটেই শিরোপা জেতা যায় না। এমবাপ্পে-নেইমাররা গোলের পর গোল করলেও গোটা মৌসুম জুড়ে ডিফেন্স ভুগিয়েছে পিএসজিকে।
অথচ মৌসুমের শুরুতে তারকাবহুল এক রক্ষণভাগ নিয়ে বেশ শক্তিশালীই লাগছিল দলটিকে। মার্কুইনহোস, প্রেসনিল কিমপেম্বে, সার্জিও রামোসের সাথে নর্দি মুকিয়েলেকে মিলিয়ে বেশ জমাট রক্ষণই ছিল দলটির। তাছাড়া দুই তরুণ উইংব্যাক আশরাফ হাকিমি এবং নুনো মেন্ডেজও থাকবেন নিজেদের পজিশনে বিশ্ব সেরার কাতারে।
কিন্তু পুরো মৌসুমজুড়ে বাজে পারফর্ম করে গেছেন পিএসজির তারকা সেন্টারব্যাকরা। হাস্যকর সব ভুল করেছেন, প্রতিপক্ষকে এক প্রকার গোল উপহারই দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে। রামোস কিংবা মার্কুইনহোসরা যেন বয়সের ভারে ক্লান্ত, নিজেদের হারিয়ে খুঁজছেন।
- অধারাবাহিক ডোনারুম্মা
বাজে রক্ষণের সমস্য্যা অনেকটাই কাটিয়ে উঠা যায় গোলরক্ষকের অতি মানবীয় পারফরম্যান্সের সুবাদে। ইতালির ইউরো জেতানোর নায়ক জিয়ানলুইজি ডোনারুম্মাকে নিয়ে তেমনটাই স্বপ্ন ছিল পিএসজির। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি, গোটা মৌসুম জুড়ে বড্ড অধারাবাহিক ছিলেন এই ইতালিয়ান গোলরক্ষক।
পিএসজির খেলার ধরণ অনুযায়ী এমন কিপার প্রয়োজন যিনি কিনা পাসিং এবং বল ডিস্ট্রিবিউশনে ভালো। কিন্তু ডোনারুম্মা অনেকটাই শট স্টপার ঘরানার কিপার, যারা কিনা বল পায়ে ততটা স্বচ্ছন্দ নন। তবে বয়স মাত্র ২৪ হওয়ায় ডোনারুম্মার সামনে উন্নতির সুযোগ আছে।
- উগ্র সমর্থকগোষ্ঠী
কাতারি মালিকানাধীন হবার পর থেকেই পিএসজি উগ্র সমর্থকগোষ্ঠী পিএসজি আল্ট্রাসের সাথে ঝামেলা লেগেই আছে। এবারের মৌসুমেই যেমন ঘরের মাঠে বাজে পারফরম্যান্সের কারণে লিওনেল মেসিকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এমনকি ভাড়াটে খেলোয়াড় হিসেবে স্লোগান দিয়েছিল।
উত্তেজনা চরমে পৌঁছায় যখন মেসি ক্লাবকে যা জানিয়েই পরিবারের সাথে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। সমর্থকরা ক্লাবের বাইরে মেসির শাস্তির জন্য রীতিমতো মিছিল করেন।
এছাড়া নেইমারের ইনজুরির সময়টাতে তাঁর বাসার সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করেছিল। দলটির বাজে পারফরম্যান্সের পেছনে তাই সমর্থকরাও অনেকাংশে দায়ী।
- কোচের পরিকল্পনায় ভুল
পিএসজিতে আসার আগে লিলে এবং নিসের হয়ে দারুণ সময় কাটিয়েছেন ক্রিস্তোফ গালতিয়ের। কিন্তু পিএসজিতে আসার পর যেন নিজের পুরনো ধার হারিয়ে ফেলেছেন।
মৌসুমের শুরুতে তাঁর ৩-৪-৩ ফর্মেশন কার্যকরী মনে হলেও ইনজুরি আর ফর্মহীনতায় বেশি দূর আগাতে পারেননি। এছাড়া দলের তারকাবহুল ড্রেসিংরুমেও নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি এই ফরাসি। সংবাদমাধ্যম সামলাতেও তেমন পটু নন গালতিয়ের। বিভিন্ন সময়ে খেলোয়াড়দের উপর দোষ চাপাতে দেখা গেছে তাঁকে।
- দলবদলের ব্যর্থতা
মৌসুমের শুরুতে হুগো একিটিকে, রেনাতো সানচেজ, ভিতিনহাদের মতো তরুণ তারকাদের দলে ভিড়িয়েছিল পিএসজি। কিন্তু গোটা মৌসুম জুড়ে কেউই নিজেদের সামর্থ্যের ছিটেফোঁটা দেখাতে পারেননি।
সানচেজ, ভিতিনহা কিংবা ফ্যাবিয়ান রুইজ প্রত্যেকেই সীমিত সামর্থ্যের ফুটবলার। তাঁরা আসলে মাঝারি মানের ক্লাবের নিয়মিত তারকা হলেও ইউরোপিয়ান বড় মঞ্চে খেলার জন্য কতটা যোগ্য এবং অভিজ্ঞ সে নিয়ে প্রশ্ন শুরু থেকেই ছিল। মৌসুম জুড়ে মাঠেই তাঁর প্রতিফল দেখেছে সমর্থকরা।
ফলে আরো একবার পিএসজির দলবদল বিবেচিত হয়েছে ব্যর্থ হিসেবেই।
- লুইস কাম্পোস
মাঝারি মানের ক্লাবে থাকাকালীন সময়ে তরুণ ফুটবলার খুঁজে বের করার সুনাম ছিল লুইস কাম্পোসের। কিন্তু পিএসজির মতো বড় ক্লাবে এসে যেন খেই হারিয়ে ফেলেছেন এই স্পোর্টিং ম্যানেজার।
লুইস কাম্পোসের সাথে লিলেতে দারুণ কাজ করলেও পিএসজিতে আসার পর দ্বন্দে জড়িয়ে পড়েছেন এই দুজন। কাজে মাঝে সমন্বয় ছিল না, উল্টো সংবাদ মাধ্যমে পরস্পর বিরোধী মন্তব্য করে বারবার বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। এছাড়া ড্রেসিংরুমে প্রভাব বিস্তার নিয়েও সমস্যা হয়েছিল এই দুজনের।
- কিলিয়ান সেইন্ট জার্মেই
ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই রিয়াল মাদ্রিদে খেলার স্বপ্নের কথা জানালেও এখনো পর্যন্ত পিএসজিতেই রয়ে গেছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। দারুণ পারফর্ম করে সমর্থকদের মন জিতে নিয়েছেন এই তারকা। পাশাপাশি নতুন চুক্তির সময়েই ক্লাবে নিজের কর্তৃত্ব বুঝে নিয়েছেন এমবাপ্পে।
ফলে ড্রেসিংরুমের পরিবেশ অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন আসা তারকারা তো এক প্রকার নিজেদের বহিরাগত ভাবতে শুরু করেছিলেন মৌসুমের মাঝপথে, কেননা পিএসজি জুড়ে যেন কেবলই এমবাপ্পে। তাঁর পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও এই ব্যাপারগুলো দল হিসেবে পিছিয়ে দিয়েছে পিএসজিকে।
- অনিশ্চিত ভবিষ্যত
পিএসজির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দলটির কেউই জানে না তাঁদের ভবিষ্যত কি।
মৌসুম শেষে মেসি এবং নেইমার ক্লাব ছাড়ার দ্বারপ্রান্তে আছেন। কোচ গালতিয়ের সমর্থকদের আস্থা হারিয়েছেন। কেউই জানেন না আগামী মৌসুমে কে ডাগ আউটে দাঁড়াবেন।
অথচ এবারের দল বদলের বড় অংকের অর্থ নিয়েই মাঠে নামছে পিএসজি। এরমাঝেই গুঞ্জন আছে বের্নাদো সিলভা, রান্ডাল কালো মুয়ানিকে দলে ভেড়াতে কাজ শুরু করে দিয়েছে দলটি।
কোচের পছন্দসই খেলোয়াড় কিংবা স্পোর্টিং ডিরেক্টরের পরিকল্পনা ছাড়াই খেলোয়াড় ভেড়ানোর কাজ শুরু করা বোধহয় কেবল পিএসজিতেই সম্ভব।