এবারে একটু অন্য ধরনের পরীক্ষায় ফেলব আমাদের আলোচ্য চার গ্রেটদের। বোঝার চেষ্টা করব তারা কঠিন বিদেশ সফরে কেমন পারফর্ম করতেন। উদ্দেশ্য এটা দেখা যে তারা নিজের দেশের মাটিতে বা মধ্যম মানের বোলিঙের বিরুদ্ধে প্রচুর রান করে নিজেদের রেকর্ড উন্নত করেন নি তো?
কঠিন বিদেশ সফরের ক্রাইটেরিয়া হচ্ছে বিপক্ষ দলে অন্তত একজন গ্রেট অথবা দুই বা তার বেশি খুব ভালো বোলার থাকবেন। যেমন ধরুন লিলি – টমসনের অস্ট্রেলিয়া, মার্শাল – রবার্টস – হোল্ডিং – গার্নারের ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ডোনাল্ড, পোলকের দক্ষিণ আফ্রিকা অথবা ইমরান, আকরাম, ওয়াকার, কাদিরের পাকিস্তান। এই বোলিং আক্রমণগুলি যে দুর্দান্ত তাতে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। বরং বিতর্কের অবকাশ রয়েছে হ্যাডলি – চ্যাটফিল্ড, ম্যাকডরমট – মার্ভ হিউজ, কপিল – মানিন্দার – শাস্ত্রি অথবা এন্ডারসন – সাইডবট্মদের বোলিং আক্রমনকে কঠিন বলা যাবে কিনা। আমি এগুলোকেও কঠিন সফর হিসেবে ধরেছি উল্লেখ্য সিরিজে হ্যাডলি, কপিল বা এন্ডারসনদের দুর্দান্ত ফর্ম ও সাফল্য কন্সিডার করে। তবে এই সফরগুলি বাদ দিয়েও আমাদের নিষ্কর্ষে খুব একটা পরিবর্তন হবে না।
সানিকে দিয়ে আরম্ভ করা যাক। হিসেব মতো সানি আটখানা কঠিন বিদেশ সফর করেছেন। এই আটখানা বিদেশ সফর ও তার খেলা বোলিং আক্রমণ এইরকম – ইংল্যান্ড ১৯৭৪ (উইলিস, আন্ডারউড, ওল্ড), ১৯৭৬ ওয়েস্ট ইন্ডিজ (রবার্টস, হোল্ডিং), ১৯৭৮-৭৯ পাকিস্তান (ইমরান, সরফরাজ), ১৯৭৯ ইংল্যান্ড (উইলিস, বোথাম), ১৯৮০-৮১ অস্ট্রেলিয়া (লিলি, প্যাসকো, হগ), ১৯৮২ ইংল্যান্ড (উইলিস, বথাম), ১৯৮২-৮৩ পাকিস্তান (ইমরান, সরফরাজ), ১৯৮৩ ওয়েস্ট ইন্ডিজ (রবার্টস, হোল্ডিং, মার্শাল, গারনার)।
এই সিরিজগুলিতে সুনীল গাভাস্কারের মোট রান ২৪৬২, গড় ৪৮.২৫। তিনটে সিরিজে তার গড় ছিল ৫০এর ওপরে, তিনটেতে ৩০ বা তার কম। বাকি দুটোয় ৩৫ থেকে ৫০এর মধ্যে। সানির ব্যর্থ সিরিজগুলির মধ্যে রয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের চার দুরন্ত ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে ১৯৮৩ এবং লিলি – প্যাসকোদের বিরুদ্ধে ১৯৮০-৮১। ইমরান – সরফরাজদের বিরুদ্ধে দুটো সিরিজেই ভালো পারফর্ম করেন সানি।
মোটের ওপর সানি সসম্মানে পাস করে যাচ্ছেন এই পরীক্ষায়। এখানে একটা পয়েন্ট নোট করার – ১৯৮৩’র পর, সানি আর কঠিন বিদেশ সফর খেলেন নি। এর একটা কারণ এই যে ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার বোলিং আক্রমন সেই সময় আর তত ধারালো ছিল না। দ্বিতীয় কারণ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা পাকিস্তানে ১৯৮৩র পর বেশ কিছুদিন টেস্ট খেলেনি ভারত।
আগেও বলেছি, আবার বলছি – সানির যুগের শ্রেষ্ঠ বোলারদের মধ্যে মোটামুটি সবাই ফাস্ট বোলার ছিলেন (উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম ডেরেক আন্ডারউড)। এই ফাস্ট বোলাররা যখন নতুন বল হাতে ধেয়ে আসেন, তাদের খেলা সবচেয়ে কঠিন। এই কঠিন কাজ সানি বছরের পর বছর সাফল্যের সঙ্গে করে গেছেন বলে কিছুটা অতিরিক্ত কৃতিত্ব তিনি দাবী করতেই পারেন।
এবার ভিভ রিচার্ডস। ভিভের খেলা কঠিন সিরিজগুলি এইরকম – ভারত ১৯৭৪-৭৫ (চন্দ্র, বেদি, প্রসন্ন), ১৯৭৫-৭৬ অস্ট্রেলিয়া (লিলি – টমসন), ১৯৭৬ ইংল্যান্ড (আন্ডারউড, স্নো, উইলিস), ১৯৭৯-৮০ অস্ট্রেলিয়া (লিলি, হগ), ১৯৮৩-৮৪ ভারত (কপিল, মানিন্দার, শাস্ত্রী), ১৯৮৪ ইংল্যান্ড (বথাম, উইলিস), ১৯৮৬ পাকিস্তান (ইমরান, আক্রাম, কাদির), ১৯৮৭ নিউজিল্যান্ড (হ্যাডলি, চ্যাটফিল্ড)।
এই আটটা সিরিজে ভিভের মোট সংগ্রহ ২৭৯১ রান, গড় ৫২.৬৬। অর্থাৎ যত সবল প্রতিপক্ষ, তত দুর্ধর্ষ ভিভ। এর মধ্যে মাত্র একটা সিরিজে তার গড় ৩০ বা তার নিচে নেমেছে (১৯৮৭, নিউজিল্যান্ড)। ৫০বা তার ওপর গড় ছিল তিনটে সিরিজে। ইমরানদের বা কপিলদের বিরুদ্ধে তার গড় থেকেছে ৩৪ থেকে ৩৫এর মধ্যে। ১৯৮০ বা তার আগে খেলা সিরিজগুলিতে আরও বিস্ফোরক ছিলেন ভিভ। এই সময়ে চারটে সিরিজে তার মোট সংগ্রহ ১৯৯৪ রান, গড় ৬৮.৭৬।
এরপর আর কোন সিরিজে তার গড় ৫০ পেরোয় নি। অর্থাৎ ক্যারিয়রের শুরুতে ভিভ আমাদের আলোচ্য চারজনের মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী ছিলেন। সম্ভবত রিফ্লেক্স কমে আসায় এবং অধিনায়কত্বের চাপে তার পারফর্মেন্স এরপর কিছুটা নিম্নগামী হয়। তবুও সব মিলিয়ে ভিভ এই পরীক্ষায় লেটার মার্কস সহ পাশ করছেন।
এখানে একটা প্রশ্ন। ভিভও কি নিজের ক্যারিয়ার একটু বেশি লম্বা টেনে নিয়ে গেছিলেন? ওনার শেষের দিকের রেকর্ড দেখে তাই মনে হয়। তবুও সে যুগের প্রায় সব বোদ্ধাই ভিভকে নির্দ্বিধায় শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে মেনে নিয়েছেন। তার শেষের দিকের কম উজ্জ্বল ক্যারিয়র তাদের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রভাব ফেলেনি। অথচ এই বেনিফিট সচিনকে অনেকে দিতে চান না।
ক্যারিবিয়ান সম্রাটের পর এবার ক্যারিবিয়ন রাজপুত্র – ব্রায়ান লারা। দেখা যাক তার অবস্থান কোন জায়গায়। তার খেলা কঠিন সফর মোট ১২টি – ১৯৯০ পাকিস্তান (ইমরান, আক্রাম, ওয়াকার, কাদির), ১৯৯২-৯৩ অস্ট্রেলিয়া (ম্যাকডরমট, হিউজ), ১৯৯৪ ভারত (শ্রীনাথ, কুম্বলে), ১৯৯৬-৯৭ অস্ট্রেলিয়া (ম্যাকগ্রা, ওয়ার্ন), ১৯৯৭ পাকিস্তান (ওয়াকার, আকরাম, সাকলেইন), ১৯৯৮-৯৯ দক্ষিণ আফ্রিকা (ডোনাল্ড, পোলক), ২০০০ ইংল্যান্ড (গফ, ক্যাডিক, ফ্লিন্টফ), ২০০০-০১ অস্ট্রেলিয়া (ম্যাকগ্রা, লি, ম্যাকগিল, গিলেস্পি), ২০০১ শ্রী লঙ্কা (মুরলী, ভাস), ২০০১-০২ দক্ষিণ আফ্রিকা (পোলক, এন্তিনি), ২০০৪ ও ২০০৫ অস্ট্রেলিয়া (ম্যাকগ্রা, ওয়ার্ন)।
এই বারবারের মধ্যে লারা মোট চারটে সিরিজে ৫০এর বেশি গড়ে রান করেন। তিনটে সিরিজে তার গড় ৩০এর নিচে ছিল। তবে এরমধ্যে আবির্ভাবেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মাত্র টেস্ট খেলা সিরিজ ধরা হয়েছে। ভারত বা পাকিস্তানে তার পারফর্মেন্স সাধারন হলেও তিনি এই খামতি সুদে আসলে পুরিয়ে দিয়েছেন শ্রী লঙ্কার বিরুদ্ধে। ম্যাকগ্রার বিরুদ্ধে মোট চারটে সিরিজ খেলে মাত্র একটায় সফল হয়েছিলেন লারা – ২০০৫ সালে। এই সিরিজে ম্যাকগ্রার সঙ্গে ওয়ার্ন ও লি’ও ছিলেন। লারা আবার ক্যারিয়ারের শুরুর চেয়ে শেষের দিকে বেশি উজ্জ্বল ছিলেন। অর্থাৎ আরও কিছুদিন টেস্ট খেলে যেতে পারতেন লারা। তাতে তার সামগ্রিক রান বেশি হত কিন্তু সেই সঙ্গে শেষের দিকের ব্যর্থতার সম্ভাবনাও থাকত।
সবগুলি সিরিজ মিলিয়ে লারার মোট রান ৩৬১৩, গড় ৪৪.০৬। সম্মানজনক কিন্তু এই মাপকাঠিতে লারা ভিভ বা সানির চেয়ে বেশ কিছুটা পেছিয়ে। তবে লারার খেলা কঠিন সিরিজের সংখ্যা ভিভ বা সানির চেয়ে বেশি – যদিও তার খেলা টেস্টের সংখ্যা অন্য দুজনের কাছাকাছি।
অবশেষে শচীন টেন্ডুলকার। সবার চেয়ে বেশি টেস্ট খেলেছেন শচীন, স্বাভাবিক কারনেই তার খেলা কঠিন সফরের সংখ্যাও বেশি। ইমরান, ওয়াকার, আকরামদের থেকে আরম্ভ করে এন্ডারসন, ব্রডদের বিরুদ্ধেও মোকাবিলা করেছেন সচিন। তার খেলা কঠিন সিরিজগুলি এইরকম – ১৯৮৯ পাকিস্তান (ইমরান, আক্রাম, ওয়াকার), ১৯৯১-৯২ অস্ট্রেলিয়া (ম্যাকডরমট, হিউজ), ১৯৯২ দক্ষিণ আফ্রিকা (ডোনাল্ড, ম্যাকমিলান), ১৯৯৬-৯৭ দক্ষিণ আফ্রিকা (ডোনাল্ড, পোলক), ১৯৯৭ ওয়েস্ট ইন্ডিজ (অ্যামব্রোস, বিশপ, ওয়ালশ), ১৯৯৭ শ্রীলঙ্কা (মুরালি, ভাস), ১৯৯৯-০০ অস্ট্রেলিয়া (ম্যাকগ্রা, ওয়ার্ন), ২০০১ ও ২০০৬ দক্ষিণ আফ্রিকা (পোলক, এন্তিনি), ২০০৩-০৪ অস্ট্রেলিয়া (গিলেস্পি, লি, ম্যাকগিল), ২০০৭ ইংল্যান্ড (অ্যান্ডারসন, সাইডবট্ম), ২০০৭-০৮ অস্ট্রেলিয়া (লি, জনসন), ২০০৮-০৯ শ্রী লঙ্কা (মুরলী, ভাস, মেন্ডিস), ২০১০ শ্রী লঙ্কা (মুরলী, হেরাথ), ২০১০-১১ দক্ষিণ আফ্রিকা (স্টেইন, মরকেল) এবং ২০১১ ইংল্যান্ড (অ্যান্ডারসন, ব্রড)।
মোট ষোলটা সিরিজের মধ্যে ৭ টিতে শচীনের গড় ৫০এর বেশি ছিল। তার মধ্যে ৩০ বা তার চেয়ে কম গড় ছিল মাত্র একটিতে (২০০৮-০৯, শ্রী লঙ্কার বিরুদ্ধে)। তবে মুরলীদের বিরুদ্ধে অন্য দুটি সিরিজে সচিনের গড় ছিল ৯৭ ও ৭৮। ডোনাল্ডের দক্ষিণ আফ্রিকা এবং এন্ডারসনের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সচিন তেমন সফল ছিলেন না। তবে পুরোপুরি অসফলও বোধহয় বলা যায় না।
সবগুলি সিরিজ মিলিয়ে শচীনের মোট রান ৪৪৭২, গড় ৪৯.৫৬। অর্থাৎ গড় হিসেবে সচিনের অবস্থান ভিভ ও সানির মাঝখানে, লারার চেয়ে বেশি কিছুটা এগিয়ে। অথচ ক্রিকেট বোদ্ধাদের মধ্যে একটা প্রচলিত ধারণা রয়েছে লারা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সচিনের তুলনায় বেশি উজ্জ্বল। এই ধারনার একটা বড় কারণ নিজের দেশের মাটিতে ম্যাকগ্রাদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অসাধারণ ইনিংস যা আমাদের আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে।
এখানে একটা ঘটনা লক্ষ্য করার মতো – নিজের মোট খেলা টেস্টের অনুপাতে শচীরে কঠিন বিদেশ সফরে খেলা টেস্টের অনুপাত লারার চেয়ে কম। অবশ্য তার সাফল্য এটাই প্রমান করে যে সংখ্যাটা বেশি হলেও সামগ্রিক ক্যারিয়রে খুব একটা প্রভাব পড়ত না। তবুও পিক ফর্মের ওয়াকার – আকরামের বিরুদ্ধে পরিণত শচীনের পাকিস্তানের মাটিতে একটা পাঁচ টেস্টের সিরিজ দেখতে পেলে ক্রিকেট প্রেমী হিসেবে আনন্দিত হতাম।
শচীন ভিভের মতো বিস্ফোরক ছিলেন না কিন্তু ধারাবাহিকতায় আবার তিনি সবার চেয়ে এগিয়ে। নিজের জীবনে অন্তত ১৩-১৪ জন গ্রেট বোলারদের তিনি খেলেছেন। সংখ্যাটা আলোচ্য অন্য তিন ব্যাটসম্যানের চেয়ে বেশি। চারজনের মধ্যে সব দেশের মাটিতে একমাত্র শচীনেরই গড় চল্লিশ বা তার বেশি (সানির শ্রী লঙ্কায়, ভিভের নিউজিল্যান্ড, লারার ভারত এবং নিউজিল্যান্ডে গড় চল্লিশের নিচে)। আবার অন্যদিকে এই চারজনের মধ্যে একমাত্র সচিনেরই রান কোন সিরিজে ৫০০ পেরোয় নি। ভিভ এবং লারা দুজনেই একটা করে সিরিজে ১০০ র ওপর গড়ে রান করেছেন। এই কৃতিত্ব সানি বা সচিনের নেই।
লারা ও শচীনের মধ্যে মূল পার্থক্যের জায়গাটা হচ্ছে লারা প্রত্যেক দশটা ইনিংসের মধ্যে হয়ত দুটোয় অনবদ্য খেলবেন, চারটেতে ব্যর্থ হবেন। সচিনের ক্ষেত্রে সাফল্যের সংখ্যা ব্যর্থতার চেয়ে বেশি হবে কিন্তু তার সবচেয়ে বেশি রানের ইনিংস লারার চেয়ে বেশ কিছুটা কম রানের হবে। অর্থাৎ লারার পিক বেশি উঁচুতে, তাই তার ক্ষেত্রে স্মরণীয় ইনিংসের সংখ্যা বেশি। আবার লারার ব্যর্থতাও সচিনের তুলনায় বেশি। সচিন অনেক বেশি ধারাবাহিক হলেও তুলনামূলক ভাবে লারার চেয়ে তার খেলা স্মরণীয় ইনিংসের সংখ্যা কম।
ভিভ বা লারার ব্যাটিং যদি শেয়ার মার্কেটকে মনে করায় (হাই রিস্ক, হাই রিটার্ন), তাহলে সানি হবেন মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রথম পছন্দ সরকারী ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিট। এবং শচীন ছিলেন ব্যাল্যান্সড মিউচুয়াল ফান্ড যে পরস্থিতি অনুযায়ী শেয়ার আর বন্ডের মধ্যে নিজের ইনভেস্টমেন্ট পরিবর্তন করতে থাকেন।
এই চারজনের মধ্যে আপনি কাকে পছন্দ করবেন সেটা নির্ভর করছে আপনার ক্রিকেট দর্শন ও মানসিকতার ওপর।