গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষের দিকে ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট দল গড়ে উঠেছিল। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এরপর ক্রিকেট বিশ্বে রাজত্ব করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট দলের শিরোপা নিয়ে তিনটে দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় – স্যার ডনের নেতৃত্বে ১৯৪৮-এর অস্ট্রেলিয়া, ক্লাইভ লয়েডের ১৯৮৩ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং স্টিভ ওয়াহের নেতৃত্বে ২০০২-এর অস্ট্রেলিয়া। অনেক বোদ্ধাদের মতে লয়েডের দলটিই সেরা এবং যারা আশির দশকে ক্রিকেট অনুসরণ করেছেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ক্রিকেট প্রেমিই এই দাবীর পক্ষে ভোট দেবেন।
আসুন সেই দলের নক্ষত্রদের দিকে একবার চোখ বোলানো যাক। শুরুতে গ্রিনিজ এবং হেইন্স – নিজের সময়ের তো বটেই, সর্বকালেরও অন্যতম সেরা ওপেনিং জুটি। মিডল অর্ডারে রিচার্ডস এবং লয়েড – নিজের দিনে যে কোন বোলিঙকে, যে কোন উইকেটে ছিঁড়ে ফেলার ক্ষমতা ছিল এই দুজনের। উইকেটের পেছনে জেফ ডুজন – একই সঙ্গে নির্ভরযোগ্য (কিপিং গ্লাভস হাতে) এবং আকর্ষণীয় (ব্যাটিং গ্লাভস হাতে)। এবং সর্বশেষে, না বলা উচিৎ সবার ওপরে, চার – পাঁচজন অল টাইম গ্রেট ফাস্ট বোলার – অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং, জোয়েল গার্নার, ম্যালকম মার্শাল, কলিন ক্রফট। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের চেয়ে আলাদা, প্রত্যেকেই একটা ইনিংসকে একাই শেষ করার ক্ষমতা রাখেন।
এবার আমরা দেখব এই তারকাখচিত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে কেমন পারফর্ম করেছিলেন আমাদের চার মহারথী।
প্রথমে ইয়ান বোথাম। নিজের ক্যারিয়রে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ২০টি টেস্ট খেলেন বোথাম। এই কুড়িটি টেস্টে ২১এর অল্প বেশি গড়ে ৭৯২ রান করেন, বল হাতে উইকেট প্রতি ৩৫ রান দিয়ে ৬১ উইকেট নেন। সংখ্যা গুলি তেমন আহামরি নয়, বথামের স্ট্যান্ডার্ডে তো আরও নয়। বোথামের স্বপক্ষে শুধু একটি কথাই বলার – মোট কুড়িটির মধ্যে উনিশটি টেস্ট ইয়ান বোথাম খেলেন ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬’র মধ্যে মোট চারটি সিরিজে। এর প্রত্যেকটিতেই প্রায় পূর্ণশক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। তবুও সব মিলিয়ে মেনে নিতেই হবে বিশ্বশ্রেষ্ঠ দলের বিরুদ্ধে নিষ্প্রভ ছিলেন বোথাম।
ভারতের কপিল দেব মোট ২৫টি টেস্ট খেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। ব্যাট হাতে প্রায় ৩১ গড়ে ১০৭৯ রান করেন, বল হাতে উইকেট প্রতি প্রায় ২৫ রান দিয়ে তুলে নেন ৮৯ উইকেট। সামগ্রিক দৃষ্টিতে যথেষ্ট উঁচু মানের পারফর্মেন্স। এবার একটু ভেতরে ঢোকা যাক। এই কুড়িটি টেস্টের মধ্যে প্রথম ছয়টি টেস্ট কপিল খেলেন ১৯৭৮-৭৯ সালে দ্বিতীয় সারির ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে।
এই ছয় টেস্টে উনি ৩২৯ রান করেন প্রায় ৬৫ গড়ে, সঙ্গে ৩৩ গড়ে নেন ১৭ টি উইকেট। এর পরের দুই সিরিজ, ১৯৮২-৮৩ এবং ১৯৮৩-৮৪ অবশ্য পূর্ণ শক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে খেলেন কপিল। এই দুই সিরিজ মিলে ১১ টি টেস্টে ইনিংস প্রতি প্রায় ২৬ রান করে ৪৩৮ রান করেন, সেই সঙ্গে উইকেট প্রতি ২১ রান দিয়ে তুলে নেন ৪৬টি উইকেট।
এরপরের দুই সিরিজ যথাক্রমে ১৯৮৭-৮৮ এবং ১৯৮৮-৮৯ সালে খেলা হয়। প্রথমটির বোলিং আক্রমণ আগের ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে তুলনীয় না হলেও প্যাটারসন, ওয়ালশ এবং বেঞ্জামিনের আক্রমণকে দুর্বল বলা যাবে না কোন মতেই। দ্বিতীয় সিরিজের আক্রমণ আরও মজবুত – এতে যোগ দিয়েছেন ম্যালকম মার্শাল এবং কার্টলি অ্যামব্রোসও। এই দুই সিরিজেও কপিলদেবের পারফর্মেন্স যথেষ্ট ভালো – প্রথমটিতে তিনি ব্যাট হাতে বেশি উজ্জ্বল, দ্বিতীয়টিতে বল হাতে। সুতরাং মোটের ওপর বিশ্বসেরাদের বিরুদ্ধে পরীক্ষায় যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গেই পাস করছেন কপিল।
ইমরান মোট ১৮টি টেস্ট খেলেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। মোট রান করেছেন ৭৭৫ (গড় ২৮), উইকেট নিয়েছেন ৮০ টি (গড় ২১)। দেখাই যাচ্ছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ইমরান বেশি উজ্জ্বল ছিলেন বল হাতে। এবার দেখা যাক ইমরান কোন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে এই পারফর্মেন্স করেছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ইমরানের প্রথম দুই সিরিজ ১৯৭৬-৭৭ এবং ১৯৮০-৮১ সালে।
দুটো ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলই যথেষ্ট শক্তিশালী হলেও কোনটাই সেই পৃথিবী কাঁপানো ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল নয়। ১৯৭৬-৭৭ এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে হোল্ডিং বা মার্শাল ছিলেন না, তেমনই ছিলেন না হেনেসও। ১৯৮০-৮১র ওয়েস্ট ইন্ডিজে অবশ্য মার্শাল ছিলেন কিন্তু ছিলেন না হোল্ডিং বা রবার্টস। এবং গ্রিনিজ। এক্ষেত্রে স্মরণীয় যে ১৯৮০-৮১র মার্শাল সেই উচ্চতায় ওঠেন নি যা পরবর্তীকালে উঠবেন।
অবশ্য ১৯৭৬ বা ১৯৮০’র ইমরানও সেই ইমরান নন যাকে বিশ্ব ক্রিকেট চেনে এবং সমীহ করে। এই দুই সিরিজ মিলে ইমরানের সংগ্রহ ৪১৯ রান (গড় ২৫), ৩৫ টি উইকেট (গড় ২৯)। খারাপ নয়, কিন্তু ইমরানোচিতও নয়। এরপর ইমরান আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে খেলবেন ১৯৮৬-৮৭ সালে। এই ওয়েস্ট ইন্ডিজও শক্তিশালী কিন্তু ১৯৮২-৮৩এর ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে তুলনীয় নয়।
রবার্টস, হোল্ডিং, গার্নারদের জায়গায় রয়েছেন মার্শাল, প্যাটারসন ও ওয়ালস, লয়েডের জায়গায় এসেছেন রিচি রিচার্ডসন। এই সিরিজে ইমরানের মূল সাফল্য বল হাতে – উইকেট প্রতি ১১ রান দিয়ে ১৮ টি উইকেট তুলে নেন ইমরান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ১৯৮৮ সিরিজ নিয়ে আগে লিখেছি বলে আর রিপিট করলাম না। এই সিরিজেও বল হাতে ইমরান খান যথেষ্ট সফল।
মোটের ওপর ইমরানও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সফল তবে তিনি বোথাম বা কপিলের মতো তাদের সেরা সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হন নি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কম খেলেছেন হ্যাডলি, মোট ১০টি টেস্ট। মোট রান ৩৮৯ (গড় ৩২), উইকেট ৫১ (গড় ২২)। অর্থাৎ চারজনের মধ্যে ব্যাটিং আর বোলিং গড়ের সবচেয়ে বেশি পার্থক্য হ্যাডলিরই। ১৯৮০, ১৯৮৫ এবং ১৯৮৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হন হ্যাডলি। ১৯৮০ সালের সিরিজে ভিভ খেলেন নি, তবে ছিলেন কালিচরন এবং লরেন্স রো।
এই সিরিজে রবার্টস, হোল্ডিং, গার্নার, ক্রফটের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরিও করেন হ্যাডলি। এই সিরিজে ব্যাট এবং বল – দুটোতেই যথেষ্ট সফল ছিলেন হ্যাডলি। ১৯৮৫ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ যথেষ্ট শক্তিশালী দল ছিল। গ্রিনিজ, হেনেস, রিচার্ডস, রিচার্ডসন, মার্শাল, হোল্ডিং এবং গার্নারে সমৃদ্ধ এই টিমের বিরুদ্ধে চার টেস্টে ১৭ উইকেট নেন হ্যাডলি (গড় ২৭), ব্যাট হাতে করেন ১৩৭ রান (গড় ২৩)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে হ্যাডলির শেষ সিরিজ ১৯৮৭ সালে। বল হাতে আবার যথেষ্ট হ্যাডলি সাফল্য লাভ করেন বিশ্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটিং লাইন আপের বিরুদ্ধে (২১ গড়ে ১৭ উইকেট), তবে বেশি ব্যাটিং করার সুযোগ পান নি (৭৪ রান, গড় ৩৭)।
তাহলে দেখা যাচ্ছে একমাত্র বথাম বাদে অন্য তিনজনই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধেও নিজের সাফল্য ধরে রাখতে পেরেছিলেন। তবে বোথামের দুর্ভাগ্য যে তিনি প্রায় সবকটা টেস্টই ওয়েস্ট ইন্ডিজের সবচেয়ে শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে খেলেছেন। ইমরান এবং হ্যাডলিও লয়েডের অশ্বমেধের সম্মুখীন হন নি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে কপিল, ইমরান এবং হ্যাডলি, তিনজনেরই সেঞ্চুরি আছে – কপিল এবং হ্যাডলির সেঞ্চুরি তুলনায় বেশি ভালো বোলিং আক্রমনের বিরুদ্ধে। তবে বথাম উঁচু মানের পেস বোলিং খেলতে পারতেন না এমন মনে করার কারণ নেই। লিলি, হ্যাডলি, এবং কপিল – তিনজনেরই বিরদ্ধে তার সেঞ্চুরি আছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ইমরান সর্বাধিক বার ৫ উইকেট নিয়েছেন ইনিংসে – ৬ বার, কপিল এবং হ্যাডলি ৪ বার করে।
চারজনের মধ্যে অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে সফল ইমরান খান। তার নেতৃত্বে পাকিস্তান পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট দল হিসেবে বিশ্ব ক্রিকেটে উঠে আসে। ভারতের মাটিতে ভারতকে হারায় পাকিস্তান, তারপর সিরিজ ড্র করে শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিরুদ্ধে। এবং ফেদার অব দ্য ক্যাপ অবশ্যই ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ জয়।
পাকিস্তানের বিশ্বজয়ের চেয়ে অবশ্য ভারতের ১৯৮৩’র প্রুডেনশিয়াল কাপের জয় অনেক বেশি কৃতিত্বের। বিশ্ব ক্রিকেটের তলানি থেকে উঠে এসে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ একদিনের দলকে হারানোর সেই গল্প কোন রূপকথার চেয়ে কম নয়। বরং কপিলের ভারতের বিশ্বজয়ের তুলনা হতে পারে ডিয়েগো ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার ১৯৮৬’র সাফল্যের সঙ্গে।
দুই ক্ষেত্রেই একজন সুপারস্টারে ব্যাক্তিগত পারফর্মেন্সে অনুপ্রাণিত হয়ে মাঝারী মাপের দল বিশ্বজয়ী হয়। ম্যারাডোনার ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’র সঙ্গে তুলনীয় কপিলের ‘ইনিংস অব দ্য সেঞ্চুরি’। এবং ফাইনালে ম্যারাডোনার এক মুহূর্তের ব্রিলিয়ান্স গড়ে দেয় দুই দলের পার্থক্য, অনেকটা কপিলের ধরা ভিভের ক্যাচের মতোই।
বোথাম বা হ্যাডলি কেউই নিজের নেতৃত্বের জন্যে এক্সট্রা পয়েন্ট পাবেন না। দুজনেই অসাধারণ ম্যাচ উইনার, তবে তাঁরা নিজের পারফর্মেন্স দিয়েই দলকে উদ্বুদ্ধ করতেন।