হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা

আজকের ম্যাচ দিয়েই রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ারের ইতি টানতে পারেন পাঁচ-পাঁচজন খেলোয়াড়। যার মধ্যে আছেন দুই অধিনায়ক রামোস, মার্সেলোও! এটাই কী তবে শেষ?

বিদায়; পৃথিবীতে এই শব্দের মতন বেদনাসিক্ত শব্দ খুব কম আছে। বিশেষত রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকের জন্য।

মৌসুমের শেষদিনটা সেরকম বেদনাসিক্তই হতে চলেছে তাদের জন্য। ভাঙাচোরা, জোড়াতালি দিয়ে চলা মৌসুমের শেষটা হতে পারত পরম আনন্দের, শিরোপা উদযাপন করে। সে আশা এখনও শেষ হয়ে যায়নি, কিন্তু সেই সাথে যোগ হয়েছে হারানোর শঙ্কা!

রিয়াল সমর্থকদের মনে এখনও দাগ কেটে আছে ইকার ক্যাসিয়াসের সেই সাক্ষাতকার। সেই সাক্ষাতকারই ছিল ক্যাসিয়াসের শেষ। রিয়ালের সাথে ২৫ বছরের সম্পর্ক, অশ্রুসিক্ত নয়নে সেদিন ইতি টেনেছিলেন ক্যাসিয়াস। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সে সুযোগটাও হয়নি। মাঠ থেকে বিদায় দূরে থাক, রিয়ালকে দেওয়া শিরোপার সাথে শেষ ছবিটাও তোলার সুযোগ হয়নি তার। রিয়াল কিংবদন্তি হয়ে মাঠ থেকে শেষ বিদায় নেওয়ার ঘটনা শুধু জিনেদিন জিদান আর আলভেরো আরবেলোয়ার।

প্রাণের ক্লাবের হয়ে ইতি টানা কখনোই কোন সুখকর স্মৃতি নয়। যে দলের সাথে এত স্মৃতি, আনন্দ-বেদনার গল্প লেখা; সেই জার্সিকে বিদায় বলা কী সহজ কাজ? কোনভাবেই নয়। সে যে দলই হোক না কেন, ড্রেসিংরুমের হাজারো স্মৃতি ছেড়ে ভালোবাসার ক্লাব ছেড়ে অন্য ক্লাবে পাড়ি দেওয়ার গল্পটা সোজা নয়। আর সমর্থকদের জন্য?

সমর্থকদের জন্য গল্পটা তার থেকে আরো বেশী কষ্টের। আর সেই কষ্টে সামান্য হলেও প্রলেপ দিতে পারে একটা সুন্দর বিদায়। কিন্তু হুট করে বিদায় নেওয়া, বিদায় বলার সুযোগ না পাওয়া আরো বেশি বেদনার। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টকর বিদায় হচ্ছে না বলে নেওয়া বিদায়।’

রিয়াল সমর্থকদের জন্য হয়তো সেটাই অপেক্ষা করছে। পত্র-পত্রিকা, ক্লাবের অবস্থা আর বাকি সবকিছু মিলিয়ে এক ম্যাচেই বিদায় বলে দিতে হতে পারে রিয়ালের পাঁচ স্বপ্নসারথীকে। যার মধ্যে ক্লাব ক্যাপ্টেন সার্জিও রামোস, সহ-অধিনায়ক মার্সেলো, ভারানে থেকে শুরু করে আছেন দূর্দিনের সাথী ইসকো, ভাজকেজও। আর তার সাথে সারপ্রাইজ প্যাকেজ হিসেবে কোচ জিনেদিন জিদান। একদিনে এত বিদায় দিতে কি প্রস্তুত রিয়াল সমর্থকেরা?

পাঁচ জনের মধ্যে রিয়াল ছাড়া অনেকটা নিশ্চিত ছিল ইসকোর। রিয়ালে যোগ দেওয়ার আগে থেকেই বার্সার রাডারে ছিলেন তিনি। সেখান থেকে হয়েছেন মাদ্রিদের দূর্দিনের সাথী। ২০১৪ সালে মালাগা থেকে তাকে কিনেই আনা হয়েছিল আনচেলত্তির মিডফিল্ডের গ্যাপ পূরণ করতে। সেই ইসকো বেলের ইঞ্জুরির সুবাদে হয়ে উঠেছিলেন রিয়ালের ভরসার পাত্র। তার উপরেই ভর করে রিয়ালের থ্রি-পিটের দুই ফাইনাল জিতে নিয়েছেন জিনেদিন জিদান।

ইসকোর রিয়াল ক্যারিয়ারে সেরা সময় হয়তো টেনেটুনে ১০ মাসও হবে না, কিন্তু যেটুকু সময় ফর্মের পিকে ছিলেন, সেটুকু সময় ছিলেন ইউরোপের ত্রাস। প্রতিটা পারফরম্যান্স চোখে লেগে আছে সমর্থকদের। ক্লপ মাথা নিচু করে বলেছিলেন, ‘আজ এক ইসকোই হারিয়ে দিয়েছে আমাদের’।

তিনি ছিলেন ফুটবলের ফুরিয়ে যাওয়া এক অলস সৌন্দর্য্য। কিন্তু যত দিন গড়িয়েছে তত অলস হয়ে পরেছেন, ফলাফলে চক্ষুশূল হয়েছেন জিনেদিন জিদানের। একসময় জিদানের প্রিয় ভরসার পাত্র ইসকোকে মাঠে নামিয়েই মাথায় হাত পরেছে জিদানের। আর তাতেই নিশ্চিত ছিল তার প্রস্থান। ইসকোর প্রস্থানটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

মার্সেলো। প্রায় এক যুগ রিয়ালের বামপাশ সামলানো রবার্তো কার্লোস যখন ঘোষণা দিলেন রিয়াল ছাড়ার, তখন প্রতিটি রিয়াল সমর্থক মুখ ফুলিয়েছিল সামনে আসা দিনের কথা ভেবে। কেনই বা লুকাবে না। ১৩ বছর সার্ভিস দিয়ে যাওয়া কার্লোশের ফেলে যাওয়া শুনয়স্থান কে পূরণ করবে? সেই জায়গাতেই ব্রাজিল থেকে রিয়াল উড়িয়ে এনেছিল মার্সেলোকে। কার্লোসের ফেলে যাওয়া শূন্যস্থান কার্লোসের মতন করেই পূর্ন করেছেন মার্সেলো। হয়ে উঠেছেন রিয়ালের একজন। একজন রিয়াল সমর্থকও পারবে না, তাকে একদিনের জন্য পর ভাবতে পেরেছে কেউ।

মাদ্রিদজমের, প্যাশনের চূড়ান্তরুপ ছিলেন মার্সেলো। প্রতিটি ম্যাচে জার্সির মান রাখতে খেলেছেন তিনি। বয়সের ভারে এখন সেই আগের গতি, ক্রসিং কোনোটাই নেই মার্সেলোর। নতুন শিশু মিগুয়েল আর মেন্দির জন্য জায়গাটা ছেড়ে দিচ্ছেন তাই স্বেচ্ছায়। যেমনটা রবার্তো কার্লোস ছেড়েছিলেন একদিন ছোট্ট মার্সেলোর জন্য, মার্সেলোও সেই বাডন পাস করে যাচ্ছেন মিগুয়েল-মেন্দির হাতে।

রাফায়েল ভারানে নামটা বললে মাদ্রিদিস্তাদের সামনে সেদিনের স্মৃতি ভেসে উঠে। ফ্রান্স থেকে এক ১৯ বছর বয়সী ছোকড়াকে ধরে এনেছেন জিনেদিন জিদান। কথা নেই, বার্তা নেই, এল ক্লাসিকোর ডিফেন্স সাময়াতে তাকে পাঠিয়ে দিলেন জোসে মোরিনহো। এক এল ক্লাসিকো মাস্টারক্লাস দেখল বিশ্ব। সেদিনের দিনটা কম করে হলেও ৯ বছর পুরোনো। ২০১১ সালে রিয়ালের মাত্র ১৯ বছর বয়সে যোগ দিয়েছিলেন ভারানে। আর সেখান থেকে ভারানে হয়ে গিয়েছেন রিয়ালের একজন।

এক কথায় পেলে পুষে বড় করা যাকে বলে, সেটাই করেছে রিয়াল। পেপে-রামোসের ছত্রছায়ায় ভারানে হয়ে উঠেছেন সেরাদের একজন। জিতেছেন বিশ্বকাপ। আর সেই ভারানে রিয়ালে এক দশক কাটিয়ে খুজছেন নতুন চ্যালেঞ্জ, নতুন শিরোপা জেতার আকাঙ্ক্ষা তার মনে। যত দিন যাচ্ছে রিয়াল ছাড়ার গল্প আরো জট বুনছে। ভারানে ছাড়বেন কীনা তা নির্ভর করছে পারিপার্শ্বিকের অনেক ঘটনার উপর, কিন্তু আশা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

 লুকাস ভাজকেজ, মৌসুমের শুরুতেও ছিলেন মাদ্রিদিস্তাদের চক্ষুশুল। তেমন কিছু নয়, রিয়ালের ইতিহাসে তার মতন খেলোয়াড় খুব কম এসেছে। মৌসুমের পর মৌসুম কাটিয়ে দিয়েও ঠিক রিয়াল মাদ্রিদ লেভেলের খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। এত বছর পরেও রিয়াল মাদ্রিদের তারকাখ্যাতি লাগেনি তার গায়ে। না লাগাটাই হয়তো ভালো হয়েছে তার জন্য। জিনেদিন জিদানের কাছে হয়ে উঠেছেন বিপদের সারথী।

যখনই যেখানে প্রয়োজন ভাজকেজ হয়ে উঠেছেন ইউটিলিটি খেলোয়াড়। রাইট ব্যাক, রাইট উইং, মিডফিল্ড; এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তাকে খেলাননি জিদান। তাকে দিয়েই নিজের কাজ সেরেছেন, যখন ডানপাশে ছিল না কোনো ব্যাকআপ, ভাজকেজ ছিলেন জিদানের ভরসা, রাইট উইঙ্গার থেকে হয়েছেন রাইটব্যাক, কিন্তু কেউ বলতে পারবে না বিন্দুমাত্র ছাড় দিয়েছেন তিনি। গোল বাঁচাতে গিয়ে নিজের পা এগিয়ে দিয়েছেন বাজে পজিশনে, তার মৌসুম শেষ হয়ে গিয়েছে বটে কিন্তু এল ক্লাসিকো জিতে ফিরেছেন।

লুকাস ভাজকেজ এমনই, রিয়াল মাদ্রিদ তার কাছে ইমোশোনের মতই। ২০১৫ সালে বেনিতেজ যখন প্রথম ডেকে আনেন ভাজকেজকে, তখনই এক অচেনা অজানা খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। সেখান থেকে ভ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে প্রথম পেনাল্টি নিতে ছুটেছিলেন তিনি। জিদানও বড় বড় খেলোয়াড়দের ভিড়ে ভরসা রেখেছিলেন তার উপরে। ফলাফল? প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ মেডেল! তার কন্ট্রাক্ট ফফুরোচ্ছে এই মৌসুম শেষেই। সামান্য সম্ভাবনা আছে বাড়ানোর বটে, কিন্তু তা না হলে, মাঠের বাইরে থেকেই প্রাণের ক্লাবকে বিদায় বলতে হবে তাকে।

 সার্জিও রামোসকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে কী? গ্যালাক্টিকোসের একমাত্র সদস্য যিনি এখনও খেলে যাচ্ছেন রিয়ালের জার্সিতে। গত দশকের স্তম্ভ তিনি। রিয়ালে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরে সান্তিয়াগো বার্নাব্যূ কাঁপিয়েছেন অনেকেই। ম্যানুয়েল সানচিজ, ফার্নান্দো হিয়েরো, রাউল থেকে ইকার ক্যাসিয়াস। মাঠে যতবারই নেমেছেন রিয়ালের একজন হয়েই নেমেছেন তিনি। কারণ শুরু থেকেই রিয়ালের একজন হয়ে ছিলেন তারা। কিন্তু রামোসের বেলায় ঠিক সেই কথাটা খাটে না। রামোশ ছিলেন সেভিয়ার খেলোয়াড়, সেভিয়াতেই তার বড় হয়ে উঠা। সেখান থেকে রিয়ালে এসেছেন, অথচ রিয়ালে ১৫ মৌসুম কাটানোর পর তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই, তিনি রিয়াল মাদ্রিদ একাডেমির কেউ নন।

গত এক দশকে হয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের স্তম্ভ। ৯২.৪৮ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ইকার ক্যাসিয়াস যখন রিয়াল ছাড়লেন তখন রিয়ালের অধিনায়কের আর্মব্যান্ড উঠল তার হাতে। আর সেদিন থেকে একদিনের জন্যও রিয়াল মাদ্রিদের পতাকা নিচু হতে দেননি তিনি। হট হেড, রেড কার্ড মাস্টার’ কত নামই উঠেছে তার পাশে। কিন্ত সবকিছু ছাড়িয়ে তিনি হয়েছেন রিয়ালের গ্ল্যাডিয়েটর। জিতিয়েছেন থ্রি-পিট, জিতিয়েছেন দুই লিগ শিরোপা। এবারও খুব কাছাকাছি আছেন শিরোপা জেতার, কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠেছে তার কন্ট্রাক্ট ইস্যু। বয়সটা পা দিয়েছে ৩৫ এ, কিন্তু খেলা দেখে বুঝবার উপায় নেই বিন্দুমাত্র। কিন্তু রিয়ালে বয়স হলেও ছুড়ে ফেলার গল্পটা নতুন কিছু নয়। ফলে কোপটা পরেছে রামোসের উপর। রামোস চাচ্ছেন দুই বছর বাড়াতে ওদিকে পেরেজ এক বছরেই ক্ষান্ত। মৌসুমের দ্বিতীয়ভাগে ইঞ্জুরিতে ইঞ্জুরিতে কাটিয়ে দেওয়াটাও প্রভাব রেখেছে সেই সিদ্ধান্তে।

 আর সবশেষ নামটা হলো জিনেদিন ইয়াজিদ জিদান। তাকে নিয়ে নিশ্চয় নতুন করে কিছু বলার নেই। রিয়াল ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা কোচ হয়ে গিয়েছেন মাত্র ৩ বছর কোচিং করিয়েই। জিদানের কোচিং ক্যারিয়ার ছিল জুলিয়াস সিজারের ভিনি, ভিসি, ভিডি। এসেছেন, থ্রি-পিট জিতিয়ে বিশ্বকে অবাক করেছেন, এরপর বিদায় নিয়েছেন। এক মৌসুম যেতে না যেতেই আবার ফিরেছেন কোচিং করাতে, রিয়াল মাদ্রিদের ডাগআউটে। শুধু রিয়ালকে সাহায্য করতে। সেই ভঙ্গুর ট্রাঞ্জিশনে থাকা রিয়ালকে জিতিয়েছন লা লিগা।

আর তাকে নিয়েই খবর রটিয়েছে স্প্যানিশ মিডিয়া। প্রেশার দিয়ে রিয়াল কোচদের মানসিকভাবে ব্যতিব্যস্ত রাখাই যেন তাদের নিত্যনৈমিত্যিক কাজ। আর এতেই বিরক্ত জিনেদিন জিদান। কোচিং লাইফে কোনোদিন বিরক্ত না হওয়া জিদান পর্যন্ত কথা ছুড়ে দিয়েছেন সাংবাদিকদের দিকে। এক জিদানে ভরসা করেই হাজারো পথ পারি দিয়েছে রিয়াল। সেই জিদানকে হারিয়ে ফেলা সহজ কাজ নয়। আর সেটা হওয়ার সম্ভাবনাই এখন রিয়াল আর তাদের সমর্থকদের সামনে।

লিভারপুলের বিখ্যাত কোচ বিল শ্যাঙ্কলি একবার বলেছিলেন, ‘অনেকে বলে ফুটবল নাকি জীবন মরণের সমান। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এটা তার থেকেও বড় কিছু।’

রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের জন্য অবশয়ই এই ম্যাচটা বড় কিছু। এই ম্যাচ শুধু ৩৫তম লিগ শিরোপা জেতার লড়াই নয়। বরং এক অদৃশ্য লড়াই নিজেদের তারকাদের ধরে রাখবার, নিজেদের সেরা বিশ্বস্ত সৈনিকদের নিজেদের করে রাখার লড়াই। যে লড়াই লিগ জয়ের থেকেও বড় লড়াই আজ।

অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের সামনে রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকেরা। তাদের মনে মনে ঠিকই গাইছেন, “আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই সেই দেখা নয় তো।’ কিন্তু মনের গহীন কোনে ঠিকই একটা ভয় কাজ করছে, এই বুঝি শেষবার তাদের একত্রে দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে আমাদের। আগামী মৌসুমে হয়তো সকলেই রাঙ্গাবেন রিয়ালের জার্সিতে কিংবা কেউই নয়। এই দিনটা শুধু রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের জন্য, মনে মনে নিজের সেরা খেলোয়াড়দের বিদায়ের প্রস্তুতি নেওয়ার।   

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...