বিস্মৃত ‘স্টাইলিশ’ জো হার্ডস্টাফ

তপন সিংহের ‘আতঙ্ক; ছবিটা দেখতে গিয়ে একজন ক্রিকেটারের কথা মনে পড়লো। যাঁরা ছবিটা দেখেছেন তাঁরা জানেন, কলাকুশলীদের নাম দেখানোর সময় মাঝে মাঝে কিছু সাধারণ মানুষের আলোচনা দেখানো হচ্ছিলো। তো সেখানেই এক কলেজ ছাত্র তাঁর এক বন্ধুকে বলছে, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের ব্যাকফুট ড্রাইভ নাকি ঠিক জো হার্ডস্টাফের মতো।

জ হার্ডস্টাফের কথা বহুদিন আগে কোথাও পড়েছিলাম, অত্যন্ত স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান ছিলেন হার্ডস্টাফ। কিন্তু একেবারে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছেন তিনি। ইংল্যান্ডের স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান বলতেই যে কয়েকজনের নাম উঠে আসে, যেমন ফ্রাঙ্ক উলি, টন্সিল নিয়ে অ্যাশেজ জেতানো এডি পেন্টার, ডেভিড গাওয়ার, ওয়ালি হ্যামন্ড, ডেনিস কম্পটন বা হালের জো রুট। কিন্তু, হার্ডস্টাফের কথা দূরদূরান্তেও কেউ বলেন না। আসুন আজ তাঁকে নিয়ে একটু আলোচনা হোক।

হার্ডস্টাফের বাবা, জো হার্ডস্টাফ সিনিয়রও ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন। যদিও, ছেলের মতো এতো আকর্ষণীয় ব্যাটিং বা লম্বা আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার কোনোটাই ছিল না তাঁর। যদিও ছেলের প্রথম টেস্ট সিরিজে বাবা ছিলেন আম্পায়ার (যদিও আম্পায়ার হিসাবে ওটাই ছিল ওনার শেষ সিরিজ )। হার্ডস্টাফ সিনিয়রের কথা নাহয় পরে হবে কখনো, আজ বরং তাঁর পুত্রের কথা আলোচনা করা যাক।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে, নটিংহামশায়ারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভূমিপুত্র বডিলাইন খ্যাত হ্যারল্ড লারউডের চোখে পড়েন হার্ডস্টাফ। তার তিন বছরের মধ্যেই আর্থার কারের নেতৃত্বে, নটিংহামশায়ারের দলভুক্ত হন জো হার্ডস্টাফ। আর্থার কার শুরুর দিকে হার্ডস্টাফকে বেশ নিচের দিকে খেলাতেন।

তাঁর অভিজ্ঞ মস্তিষ্ক হয়তো মনে করেছিল, এতো অল্প বয়সে টপ-অর্ডারে রান না পেলে হয়তো বাচ্চাটার আত্মবিশ্বাস কমে যাবে। অনেক ক্ষেত্রে এর ফল হয় উল্টো, কিন্তু হার্ডস্টাফের ক্ষেত্রে দারুণ ভাবে খেটে গিয়েছিলো এই স্ট্রাটেজি। এরপর আর পিছন ফায়ার তাকাতে হয়নি তাঁকে। ১৯৩৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে খেলেন প্রথম টেস্ট।

এরপর বছরের শেষে হোমসের নেতৃত্বাধীন এমসিসি দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়া সফরেও সুযোগ পান হার্ডস্টাফ। ১৯৩২-৩৩ এর বডিলাইন সিরিজের পর, দুই দেশের ক্রিকেটীয় সম্পর্ক এমনই তলানিতে ঠেকে, যে ১৯৩৬-৩৭ সালের ফিরতি অ্যাশেজ সিরিজের আগে সম্পর্ক খানিকটা পুনরুজ্জীবিত করতে এম.সি.সি ১৯৩৫-৩৬ মরসুমে শুধুমাত্র প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলার জন্যে সে দেশে দল পাঠায়। প্রসঙ্গত সেই সিরিজেই ডন ব্রাডম্যান প্রথমবার দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে নামেন।

গোটা সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী হন জো হার্ডস্টাফ। অ্যালেন কিপ্যাক্স, অ্যালেন ম্যাকগিলভ্রের অস্ট্রেলিয়া একাদশের বিরুদ্ধে মেলবোর্নে করা তাঁর ২৩০, অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড ক্রিকেট মহলে প্রশংসা কুড়ায়। বিশেষত তাঁর কভার ড্রাইভ, পেলব কব্জির মোচড়ে মারা ফ্লিক এবং অলস কিন্তু ক্ষিপ্র ফুটওয়ার্ক বন্দিত হয়।

১৯৩৭ মরসুম তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা মরসুম ছিল। কেন্টের বিরুদ্ধে ৩ ঘন্টায় ৩০০ তাড়া করতে হবে, এই অবস্থায় হার্ডস্টাফ খেলেন তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইনিংস। ৫১ মিনিটে ১০০ রান করেন, শেষ করেন ১২৬এ এবং নটিংহামশায়ার ম্যাচ জিতে নেয় ৪৫ মিনিট বাকি থাকতেই। এরপর ১৯৩৯ সালে ৬ বছরের জন্যে ক্রিকেট পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবার আগে অবধি, হার্ডস্টাফ সাহেব কিছুটা অফ-ফর্মের সম্মুখীন হন।

১৯৩৬-৩৭ সালের এশেজ সফরে তো মেলবোর্নে ৮৩ ছাড়া আর কিছু উল্লেখযোগ্য স্কোরই ছিলোনা তাঁর। যদিও বিশ্বযুদ্ধের আগে শেষ অ্যাশেজ টেস্ট তথা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম দূরদর্শনে সম্প্রচারিত টেস্ট ম্যাচে হার্ডস্টাফ করেন ১৬৯। যদিও ইংল্যান্ডের ৯০৩, হাটনের ৩৬৪ এবং টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো জয় হার্ডস্টাফের ইনিংসকে ফুটনোটে ঠেলে দিয়েছিলো।

হার্ডস্টাফ এরপর বার্মাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোস্টেড হন। মহাযুদ্ধ আরো বহু বড়ো খেলোয়াড়ের মতো হার্ডস্টাফের ক্রিকেট জীবনের ৬ বছর গ্রাস করে নেয়। ১৯৪৫ পরবর্তী যদিও হার্ডস্টাফের ফর্ম বা ফিটনেস একটুও কমেনি। ১৯৪৬ সালে ভারতের বিরুদ্ধে লর্ডসে করা ২০৫ যার প্রমান দেয়।

এরপর আগামী তিন বছর আন্তর্জাতিক স্তরে যথেষ্ট সফল হন (বিশেষত ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ) এবং কাউন্টি ক্রিকেটে অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ঘরের মাঠ ট্রেন্টব্রিজে শেষ টেস্ট খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান হার্ডস্টাফ। ব্র্যাডম্যানের অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়া সেই সফরে মাত্র একটাই টেস্ট জিততে ব্যর্থ হয়, সেটা এই টেস্ট। এবং তার প্রধান কান্ডারি ছিলেন কম্পটন ও হার্ডস্টাফ।

প্রায়ান্ধকার অবস্থায় দুজনের অমূল্য ৯৩ রানের জুটি বিশাল রানে পিছিয়ে থাকার পরেও ইংল্যান্ডকে সেই ম্যাচ বাঁচাতে সাহায্য করে। সুন্দর কভার ড্রাইভ, ফ্লিক এবং ফুটওয়ার্কের কথা আগেই বলেছি। ফিল্ডার হিসাবেও দারুন ছিলেন হার্ডস্টাফ, বিশেষত বাউন্ডারি লাইন থেকে তাঁর থ্রো বন্দিত ছিল। ২৩ টেস্টে ৪ সেঞ্চুরি সমেত ৪৬ গড় রাখা হার্ডস্টাফকে যদিও আজ ক্রিকেট বিশ্ব ভুলে গেছে। তপন সিংহকে অনেক ধন্যবাদ, আবার কিছুক্ষণের জন্যে তাঁকে মনে করিয়ে দেবার জন্যে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link