বাংলাদেশ ক্রিকেটের যদি সবচেয়ে বড় আক্ষেপের নামটা কী?
অনেকেই হতে পারেন। আল শাহরিয়ার রোকন, শাহরিয়ার নাফীস, অলক কাপালি কিংবা মোহাম্মদ আশরাফুল। এদের সবারই হারিয়ে যাওয়ার কারণ ছিলো। কিন্তু এমন বিনা কারণে হারিয়ে যাননি আর কেউ। ফর্ম ছিলো, বয়স ছিলো; তারপরও কেনো যেনো হারিয়ে গেলেন তিনি।
হ্যা, বলছিলাম বাংলাদেশ ক্রিকেটের আক্ষেপ ছক্কা নাইমের কথা!
শারীরিক গঠনে বেশ তরতাজা না হলেও ছক্কা হাঁকাতে ছিলেন বেশ পটু। ঘরোয়া ক্রিকেটে টানা ৬ বলে ৬ ছক্কা, এরপর ২০১৯ সালে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ উইকেটে টানা তিন ছক্কায় খেলেন ম্যাচজয়ী ইনিংস। এরপরই নামের সাথে খেতাব পেয়ে যান ‘ছক্কা নাঈম’।
৩১ ডিসেম্বর, ১৯৮৬ গাইবান্ধার এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নাঈম। ২০০৪ এর শেষ দিকে রাজশাহী ডিভিশনের হয়ে অভিষেক হয় প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে। প্রায় চার বছর রাজশাহীর হয়ে খেলার পর নজর কাড়েন নির্বাচকদের, আর সুযোগও মিললো জাতীয় দলে। অবশ্য সুযোগ টা দিতে বাধ্য ছিলো বিসিবি! নিষিদ্ধ ক্রিকেট লিগ আইসিএলে যাওয়ায় বাংলাদেশী ১৪ ক্রিকেটারকে নিষিদ্ধ করে বিসিবি। এতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে স্কোয়াডে যুক্ত হয় তিন নতুন নাম; যার মধ্যে একজন ছিলেন নাঈম ইসলাম। অবশেষে ৯ই অক্টোবর,২০০৮ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক হলো তার। ৩য় ম্যাচেই চট্রগ্রামে খেললেন ৪৬ রানের ইনিংস, কিন্তু সে ম্যাচে টাইগাররা নিউজিল্যান্ডের কাছে ৭৯ রানের হার নিয়ে মাঠ ছাড়ে।
এরপর একই সিরিজের টেস্ট দলেও ডাক পেলেন। ১৭ই অক্টোবর ২০০৮, চট্রগ্রামে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হলো নাঈমের। প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে ১৪ ও ২য় ইনিংসে ১৯ রান ছাড়াও বল হাতে প্রথম ইনিংসের ফ্লিনকে নিজের মেইডেন টেস্ট উইকেটের শিকার বানান।
২০০৯ সালে বাংলাদেশের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও ৬ বলে ছয় ছক্কা মেরেছিলেন নাঈম। কিন্তু তখন ডিপিএলের লিস্ট ‘এ’ স্বীকৃতি না থাকায় রেকর্ডের পাতায় জায়গা হয়নি নাঈমের নাম। তবে ছক্কা নাঈমের ছক্কা নামটা যুক্ত হয় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একই বছর সেই স্মৃতিময় জয়ে! জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ উইকেটে প্রয়োজন ৩১ বলে ৩৫ রান, ক্রিজে ৪০ রানে অপরাজিত নাঈম। ম্যাচ জয় তো দূর সমর্থকরা ভাবছিলেন কত রানে বাংলাদেশ হারবে ম্যাচটি! কিন্তু সেই ম্যাচে সবার ভাবনা চিন্তাকে উড়িয়ে দূর্দান্ত এক জয় ছিনিয়ে আনে নাঈম। শেষ ৩৫ রানে ৩৩ রানই করেন নাঈম! সে ম্যাচে মারা ৪ ছক্কার মধ্যে টানা তিন বলে হাঁকান তিন ছক্কা! এরপরই তিনি বনে যান ছক্কা নাঈম হিসেবে।
এরপর সুযোগ পেলেন ২০১০ এশিয়ান গেমসে ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে খেলার। ফাইনালে আফগানিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ অর্জন করে ক্রিকেটে প্রথম গোল্ড মেডেল! বাংলাদেশ ক্রিকেটে নাঈমের অর্জন বলতে শুধু এইটুকুই!
সাল ২০১২, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) আয়োজন করে ৬ দলের অংশগ্রহণে দেশী-বিদেশী ক্রিকেটারদের নিয়ে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল)। প্রথম আসরে সিলেট রয়েলসের হয়ে খেলার সুযোগ পান নাঈম ইসলাম। ৯০ হাজার ডলারে সিলেট রয়েলস সে আসরে দলে ভেড়ায় নাঈমকে।
২০০৮ সাল থেকেই জাতীয় দলে তিনি ছিলেন নিয়মিত মুখ। তৎকালীন কোচ জেমি সিডন্সের বেশ পছন্দেরও ছিলেন তিনি। তবে জাতীয় দলে নাঈমের পজিশন কখনোই স্থায়ী ছিলোনা। ৪ নম্বর ছাড়া ১-৮ সব পজিশনেই ব্যাট করেছেন নাঈম। ৮ টেস্টে এক ফিফটি ও এক শতকে করেছেন ৪১৬ রান, বল হাতে নিয়েছেন এক উইকেট। ৫৯ ওয়ানডেতে করেছেন ৯৭৫ রান, ৫ ফিফটি ছাড়াও বল হাতে নিয়েছেন ৩৫ উইকেট। টি-টোয়েন্টিতে মাত্র ১০ ম্যাচে খেলে করেছেন ১৩০ রান।
তার আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান দেখে কখনোই আপনি নাঈমে প্রতিভা বিচার করতে পারবেন না৷ বাদ পড়ার আগের টেস্টেও করেছিলেন শতক! তবুও কোনো এক অজানা কারণে আর ফিরতে পারেননি দলে। এরপর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট তুলেছেন রানের ফোয়ারা। তবুও মন গলাতে পারেননি নির্বাচকদের।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ৭২ ম্যাচ খেলে ৪১+ গড়ে করেছেন ৪২৮৮ রান। আছে ১২ টি শতক ও ২৭টি অর্ধশতক! ২০১৭-১৮ ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে রুপগঞ্জের হয়ে তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ রান স্কোরার। ১৬ ম্যাচে করেছিলেন ৭২০ রান। ২০১৮-১৯ জাতীয় ক্রিকেট লীগে রংপুর বিভাগের হয়ে ৬ ম্যাচে করেন ৪৪৪ রান! ২০১৮-১৯ বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগে ৬ ম্যাচে ৫২২ রান করেও তিনি নজর কাড়তে পারেননি নির্বাচকদের।
৩৪ বছর বয়সে এসেও তিনি স্বপ্ন দেখেন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়াবার। ঠিকমতো সুযোগ আর পরিচর্যা পেলে টেস্ট ক্রিকেটে তিনি হয়তো আজ থাকতেন বাংলাদেশের হয়ে অনেক উপরে। প্রতি বছর ঘরোয়া লীগে পার্ফম করেও যেতে পারেননি জাতীয় দলের আশেপাশে। কি দোষ নাঈমের? তিনি কি সত্যি অযোগ্য নাকি দূর্ভাগা?
জবাব পাননি তিনিও, জবাব পাননি ভক্ত-সমর্থকরা।