বিশ্বকাপে বিশ্ব কেঁপেছিল

সনাতনী টেস্ট ক্রিকেটটা বেশ চলছিল, কিন্তু সময় বদলের সাথে সাথে মানুষের স্বাদ বদলের ও ইচ্ছা জাগলো, ক্রিকেট কর্তাদের গবেষণায় উঠে এলো এক নতুন ব্যাপার, কি না সীমিত ওভারের একদিনের ক্রিকেট, যা পরিচিত হলো আমজনতার কাছে বাহারি ক্রিকেট সার্কাস বা পাজামা ক্রিকেট নামে।

অনেকেই হয়ত জানেন না ক্রিকেট যখন প্রথম চালু হয় তা সীমিত ওভারের ক্রিকেটই ছিল, সময়ের সাথে জনপ্রিয়তা বেড়ে, দিন সংখ্যা বেড়ে তা টেস্ট ক্রিকেটে দাঁড়ালো। কিন্তু মানুষের মন তো, আবার গেল ঘুরে, টেস্ট ক্রিকেটের ফলাফল অর্ধেক সময় পাওয়া না যাওয়ায় নতুন দিশারী আবার সেই একদিনের ম্যাচ। ইংল্যান্ডে প্রথমে জিলেট কাপ, সানডে লিগ, বেনসন এন্ড হেজেস সিরিজ এসব চলতে লাগলো কাউন্টি দলগুলোর মধ্যে, আর খুব দ্রুত তা ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠল।

কাউন্টি ক্রিকেটে যখন এইসব চলছে তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৯৭১ সালে হুট করেই ঘটে গেল এক বিপ্লব, আশেজের তৃতীয় টেস্ট বৃষ্টি তে ভেসে যাওয়ায় চটজলদি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা হয়ে গেল, কোথায়? না, যেখানে প্রথম বার টেস্ট ম্যাচ খেলা হয়েছিল সেই মেলবোর্নেই। তখন ৮ বল করে ওভার, আর ৪০ ওভারের খেলা।

দুই দলের হওয়া প্রথম টেস্টের মত প্রথম একদিনের ম্যাচেও জয় সেই ক্যাঙ্গারু বাহিনীরই, আর জয়ের ব্যবধানটাও সেবারের মতো একই, সেই ৪৫ রানে!! এরপর থেকে ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়াতে কোনো দেশ সফর করলে একদিনের ম্যাচ খেলাটা একটা রেওয়াজ এ পরিনত হয়ে গেল যেন।

আইসিসির কর্তাব্যক্তিদের ব্যাপার টা বেশ নজরে গেল, তাদের মাথায় এলো টেস্ট খেলিয়ে ছয়টা দেশ আর দু’টো অ্যাসোসিয়েট দেশ কে নিয়ে যদি একটা টুর্নামেন্ট আয়োজন করা যায় তবে কেমন হয়, যেমনি ভাবা তেমনি কাজ, উঠে পড়ে লাগলো আইসিসি আর ইংল্যান্ড ক্রিকেট সংস্থা। ঢাক ঢোল পিটিয়ে ঘোষনা হয়ে গেল ক্রিকেটের আঁতুরঘর ইংল্যান্ডেই বসবে বিশ্বকাপের আসর, আটটি দল কে দুটো গ্রুপে ভাগ করে খেলা হবে আর প্রতিটা ম্যাচ হবে ৬০ ওভার করে। হই হই করে চালু হলো ব্যাটবলের তুমুল লড়াই, ঢাকে কাঠি পড়লো বিশ্বকাপে।

গ্রুপ ‘এ’ তে আয়োজক ইংল্যান্ডের সাথে থাকলো ভারত, নিউজিলান্ড এবং কেনিয়া, তানজানিয়া, জাম্বিয়ার অপেশাদার খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া পূর্ব আফ্রিকা আর গ্রুপ বি তে ঠাঁই হলো প্রবল পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া আর সাথে এশিয়ার পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার। শ্রীলঙ্কা তখনও টেস্ট স্ট্যাটাস পায়নি, অ্যাসোসিয়েট দল তারা, আর পূর্ব আফ্রিকাও তাই।

এদিকে টেস্ট খেলিয়ে দেশ গুলোর মধ্যে সব দেশই একদিনের ক্রিকেটটায় সড়গড় হলেও ভারতের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে ছিল মাত্র একটি ম্যাচ। তার প্রমান পাওয়া গেল বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই, ডেনিস আমিসের শতরানে ৩৩৪ রানে পৌছালো ইংল্যান্ড, কিন্তু ভারত যে এই ধরণের খেলায় দুগ্ধপোষ্য শিশু তার নমুনা পাওয়া গেল সুনীল গাভাস্কারের ৬০ ওভার ব্যাট করে মাত্র ৩৬ নটআউট, আর ভারতের মোট ১৩২ রানের মধ্যে দিয়ে, যা মোটেই বিশ্বকাপের মেজাজের সাথে একেবারেই মানানসই হলো না।

বড় ব্যবধানে হারলো ভারত, সমালোচনার ঝড় বইলো চারদিকে। সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হলেন গাভাস্কার, অত্যধিক শ্লথগতির ব্যাটিংয়ের জন্য। যাই হোক বিশ্বকাপ চলল নিজের গতিতেই, পরের ম্যাচে নিউজিল্যান্ড এর গ্লেন টার্নার পূর্ব আফ্রিকার ক্লাব স্তরের বোলিংয়ে ১৭১ রান করে নজির সৃষ্টি করলেন, ওদিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার ভয়ঙ্কর ডেনিস লিলি ৫ উইকেট নিয়ে বিশ্বকাপে প্রথম ৫ উইকেটের নজির স্থাপন করলেন।

আবার লয়েডের ক্যারিবিয়ানদের সামনে দাঁড়াতেই পারলো না নবাগত লঙ্কানরা। ভারত তাদের দ্বিতীয় ম্যাচে জয়ে ফিরলো, যদিও পূর্ব আফ্রিকার মতো দলের বিরুদ্ধে জয়ের থেকে হারাটাই বোধহয় বেশি কষ্টকর ছিল! বিষেণ সিং বেদির অত্যধিক কৃপণ বোলিং কাপ ইতিহাসে জায়গা করে নিলো, ১২ ওভারে মাত্র ৬ রান খরচা করে এক উইকেট নিলেন বেদি।

গাভাস্কার আর ফারুখ ইঞ্জিনিয়ারের ব্যাটে ভর করে এবার সহজ জয় ভারতের। এরপরের নিউজিল্যান্ড ম্যাচটা এক প্রকার কোয়ার্টার ফাইনাল হয়ে দাঁড়ালো ভারতের সামনে, সে ম্যাচে ভারত প্রথমে ব্যাট করে ২৩০ তুলে খানিক লড়াই দিলেও কিউইদের পেশাদারি দক্ষতার কাছে পরাস্ত হতে হলো ভারত কে, আবারও শতরান টার্নারের, ৪ উইকেটে জয় পেয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছালো নিউজিল্যান্ড।

আসলে একদিনের ক্রিকেটের উপযোগী যে দল কিংবা  ব্যাটিং বোলিং এর গভীরতা দরকার ছিল, তার অর্ধেকও সেই ভারতীয় দলে অনুপস্থিত ছিল, দলে ছিল একাধিক স্পিনার, যা তখনকার দিনে একদিনের ক্রিকেটে বিলাসিতা বলেই গণ্য হত।

প্রতিদ্বন্দ্বীতায় ভরপুর বিশ্বকাপের শেষ লগ্নে দুই সেমি ফাইনালের একটায় মিলিত হলো ইংল্যান্ড – অস্ট্রেলিয়া আর একটায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ – নিউজিল্যান্ড। ইংল্যান্ড – অস্ট্রেলিয়া প্রথম সেমি ফাইনালের ম্যাচ টাকে আজও সবাই গিলমোরের ম্যাচ বলে, গ্যারি গিলমোর একাই ১৪ রান দিয়ে ৬ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ড এর দর্পচূর্ণ করে শেষ করে দেন মাত্র ৯৩ রানেই, সহজেই ফাইনালের সারণিতে পৌঁছায় অজিরা।

যদিও রান তাড়া করতে নেমে ছয়টা উইকেট হারাতে হয়েছিল ইয়ান চ্যাপেল বাহিনীকে, তারপরেও জয়ের রানটা এমন কিছু দুর্লঙ্ঘ্য ছিলোনা, যাতে অজিরা হারতে পারে। অন্য সেমি ফাইনালে কালীচরণের ৭২ রানের অনন্য ইনিংসের সুবাদে নিউজিলান্ডকে বাড়ি ফেরার টিকিট হাতে ধরায় ক্যারিবিয়ানরা, কিউইদের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয় জুলিয়েন, রবার্টস, হোল্ডারদের মারাত্মক ফাস্ট বোলিং।

লর্ডসের এক চমৎকার সকালে ক্রিকেট গতিতে স্পন্দিত, প্রাণশক্তিতে রোমাঞ্চিত ও উদ্বেলিত, প্রতিভার উদ্দাম বিকাশে পরিপূর্ণ ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হয় নির্মম পেশাদারিত্বের শেষ কথা ইয়ান চ্যাপেলের অস্ট্রেলিয়া। ম্যাচ শুরু হতে না হতেই নাটক শুরু হয়ে যায়, লিলির ভয়ঙ্কর বাউন্সার চলে আসে রয় ফ্রেডরিক্স এর মুখে, বল ফাইন লেগ বাউন্ডারি দিয়ে উড়ে গেলেও শরীরের ভারসাম্য রাখতে না পেরে ফ্রেডরিক্স পড়ে যান উইকেটের ওপর।

এসব সামলে নিয়ে নেতার মতো ব্যাট করে শতরান হাঁকান ক্লাইভ লয়েড, লয়েডের ইনিংসটা যেন ছিল অস্ট্রেলিয়ার নির্মম পেশাদারিত্বের বিরুদ্ধে এক ঘুমভাঙা ঝর্ণার গান। সেই গান দিয়ে তৈরী ক্যালিপসোর মূর্ছনায় ধাক্কা খেলো অসিরা, ক্যারিবিয়ানরা বোর্ডে তুলে ফেললো ২৯১ টা রান, ক্লাইভ লয়েডের সাথে লর্ডস মাতালেন রোহন কানহাইও অমূল্য ৫৫টা রান করে। শেষ বেলায় কিথ বয়সের ৩৪টা রান বড় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল।

অস্ট্রেলিয়া বাহিনীও শুরুটা ভালোই করেছিল কিন্তু রিচার্ডস এর করা দুটো রানআউট যখন দুই চ্যাপেল ভাই কে সাজঘরে ফেরালো তারপর আর ফিরে আসতে পারেনি চ্যাপেলের দল, নবম উইকেট পড়ার পরে যদিও ব্যাট হাতে লিলি-টমসন জুটি একটা শেষ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্রুডেন্সিয়াল কাপের ভাগ্য ততক্ষণে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। রাত আটটা ৪০-এ শেষ হওয়া ফাইনালে শেষপর্যন্ত হাসি হাসলো সেই ক্যালিপসো সঙ্গীতের মৃগয়াভূমির ক্যারিবিয়ানরাই।

ডিউক অব এডিনবার্গ যখন ফাইনালের সেরা ক্লাইভ লয়েড কে প্রুডেন্সিয়াল বিশ্বকাপের ট্রফিটা তুলে দিলেন তখন নি:শব্দেই বোধহয় ক্রিকেট বিশ্বে ঘটে গেল এক নবজাগরণ। চিরন্তন আবেগ, আনন্দ, বেদনার মাধুরী জড়ানো ওয়েস্ট ইন্ডিজের হাতেই শোভা পাচ্ছিলো সেই নবজাগরণের মাস্তুল বিশ্বকাপের ট্রফিটা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link