গায়ানার রাজধানী জর্জটাউন থেকে ২২৫ কিলোমিটারের পথ। যে পথ পাড়ি দেওয়া যায় শুধুমাত্র জলযানের মাধ্যমেই। এমন একটা প্রত্যন্ত এলাক থেকেই উঠে এসেছেন ঐতিহাসিক গ্যাবায় অজিবধের নায়ক শ্যামার জোসেপ।
বারাকারা নামের সেই গ্রাম, এমনই এক প্রত্যন্ত এলাকায়, যেখানে আধুনিকতার সব ধরনের সুবিধা পাওয়া যায় না এখনও। এই বছর পাঁচেক হলো, সেই গ্রামে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছেছে। চোখ কপালে তোলার মতো ব্যাপার হলো, এই গ্রামে স্থানীয় প্রশাসনের অন্তর্ভূক্তই হয়েছে ২০১৫ সালে।
কী অদ্ভুত ব্যাপার! যে গ্রামকে দিন সাতেক আগেও সেভাবে কেউই চিনতো, সেই গ্রামের নামটাই এখন গোটা দুনিয়ায় আলোচিত। কারণ অবহেলিত এই গ্রামের এক ছেলেই যে কদিন আগে এক সাফল্যের মশাল জ্বেলেছেন। সে সাফল্যে গ্রাম তো বটেই, আলোকিত হয়েছে গোটা ক্যারিবিয়ানদের ভূখণ্ড। শ্যামার জোসেফের জীবন যেন রূপকথার গল্পকেও হার মানায়।
তবে শ্যামারের মতোই এই গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন আরেক ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার। তিনি রোমারিও শেফার্ড। মজার ব্যাপার হলো, এই শেফার্ড আবার শামারের শৈশব কালের বন্ধু। একই সাথে একই গ্রামে বেড়ে উঠেছেন। এরপর গায়ানার হয়ে একই সাথে ক্রিকেট খেলেছেন।
এরপর উইন্ডিজ জার্সি গায়ে একজন ছুটেছেন সাদা বলের ক্রিকেটের দিশারী হয়ে। অন্যজন ইতিহাস গড়েছেন লাল বলের ক্রিকেটে। কেননা এই রোমারিও শেফার্ড তো উইন্ডিজ ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দলের নিয়মিত এক মুখ।
শ্যামার আর শেফার্ডের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের মতো শিক্ষাজীবনও কেটেছে একই সাথে। দুজনই পড়েছে বারাকারা প্রাইমারি স্কুলে। যেখানে নার্সারি ও প্রাইমারি শ্রেণি পর্যন্ত দুজন একই সাথে পড়াশোনা করেছিলেন। এরপর রোমারিও শেফার্ড পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে মনোযোগ দিয়েছিলেন পুরোপুরিই ক্রিকেটে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়েও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় তাঁরই আগে।
তবে সেটির জন্য বন্ধুত্বের শেকড় ভুলে যাননি শেফার্ড। শামারের বোলিংয়ের বিপরীতে প্রায় সময়েই নিজের ব্যাটিং প্র্যাকটিসটা সেরে নিতেন এ অলরাউন্ডার। দুজনে একসাথে খেলেছেন টেপ টেনিস ক্রিকেট। নিউ আমস্টারডাম শহরে খেলতে যেতেন। এভাবেই একসময় সুযোগ পেয়ে যান ওই শহরের ক্লাব টাকবার পার্কে।
সেই ধারাবাহিকতায় সেই শৈশবের শ্যামার-শেফার্ড বন্ধুত্ব আজ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ দুই চরিত্র। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অ্যাডিলেড টেস্ট দিয়ে শুরু। আর শেফার্ডের শুরুটা হয়েছিল ৪ বছর আগে, আফগানিস্তানের বিপক্ষে।
শ্যামার জোসেফের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। এরপর গায়ানা অ্যামাজন ওয়ারিয়র্সে সিপিএল খেলেছেন। তবে নজরে পড়েন গত নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘এ’ দলের সিরিজে।
সে সিরিজের ২ ম্যাচে ১২ উইকেট নেন এ পেসার। আর এরপরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট দলে জায়গা করে নেন শ্যামার। তাও আবার মাত্র ৭ টি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতাতে!
শ্যামার জোসেফেরর এরপরে গল্পটা সবার জানা। ক্যারিয়ারের প্রথম বলেই পেয়েছেন স্টিভেন স্মিথের উইকেট। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সুদীর্ঘ টেস্ট ইতিহাসে ক্যারিয়ারের প্রথম বলেই উইকেট শিকারি মাত্র দ্বিতীয় বোলার তিনি। তাঁর আগে ১৯৩৯ এই কীর্তি গড়েছিলেন বাঁহাতি পেসার টাইরেল জনসন।
তবে প্রথম বলেই উইকেট প্রাপ্তিতে তো আর শ্যামারের গল্প থেমে থাকেনি। গ্যাবায় ৬২ রানে ৭ উইকেট নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে এনে দিয়েছেন স্মরণীয় এক জয়। যে মুহূর্ত ক্যারিবিয়ানরা দেখেছিল ২১ বছর আগে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের হারানো গৌরব ফেরানোর পথে চোখ শ্যামার জোসেফের। আর তাঁর বন্ধু রোমারিও শেফার্ড লড়ছেন বিশ্বকাপ পুনরুদ্ধারের ইতিহাস গড়তে। কোনো একদিন হয়তো দু’জনেরই দেখা মিলবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ একাদশে।
বারাকার গ্রামের দুই ছেলে তখন একই সাথে লড়বেন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট আকাশ রক্ষার কাজে। এমন সব জুটি দেখার জন্যই তো ক্রিকেট অপেক্ষায় থাকে শত বছর অবধি।