নিউজ রুম হোক কিংবা প্রেস বক্স – কোথাও আবেগের কোনো জায়গা নেই। সাকিব-তামিমরা একের পর এক সেঞ্চুরি করবেন, পাঁচ উইকেট পাবেন – আমাদের হতে হবে নিরাসক্ত, নির্বীকার। একের পর এক ভাবনা কিংবা লেখা উৎপাদন করতে হবে। আবেগের জায়গা কোথায়, শো মাস্ট গো অন।
আজ মেহেদী হাসান মিরাজ যখন সেঞ্চুরিটা করলেন, তখন আমি নিউজরুমে। দম ফেলার ফুরসৎ নেই, আঙুলকে বিশ্রাম দেওয়ার উপায় নেই। এতটাই বেগতিক অবস্থা যে খেলায় মনোযোগ দেওয়াটাও মুশকিল। অনলাইনের বাস্তবতায় নিউজম্যানের এটা বড় সংকট – কখন দেখবেন আর কখন লিখবেন।
এর মধ্যেও কিছু সময় আসে, যখন আসলে দেখতে বাধ্য হই। যেমন মিরাজের এই ইনিংসটা। শুধু দেখা না, দাঁড়িয়ে হাততালি দিতেও ইচ্ছা হল – নেহায়েৎ বয়স হয়ে গেছে বলে করা হল না।
ব্যাকফুটে শট খেলে একের পর এক যে বাউন্ডারি গুলো আদায় করলেন, যেমন টাইমিং, তেমন প্লেসমেন্ট। স্যুইপ করলেন, গ্লাইড করলেন, চোখ ধাঁধানো ফ্লিক করলেন, ইনসাইড আউটে গিয়ে খেললেন একের পর এক – অথচ তিনি হলেন এমন এক ‘ব্যাটসম্যান’ যিনি নামেন আট নম্বরে।
প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করার দিন বিশ্বের বড় বড় কুতুব ব্যাটসম্যানেরও পা কাঁপে। নব্বইয়ের ঘরে গিয়ে থমকে যান, একটু সময় নেন। কয়েকটা ওভার কাটে নিজেকে শান্ত করতে, অনেকে তো এই সময়েও ভুল করে বসেন। কিন্তু, মিরাজের ওতো সব ভাবতে হল না। তিনি ৯৩ থেকে ১০১-এ গেলেন মাত্র তিন বলের মধ্যে। এটা একটা সহজাত ব্যাটসম্যানের গুণ, এটা একটা অথরোটির ব্যাপার।
যদিও, মজার ব্যাপার হল – তিনি এমন এক চরিত্র যার আসলে মূল ব্যাটসম্যানদের ভাল একটা দিনে ডাকই পড়বে না। অথচ, দারুণ একজন ব্যাটসম্যানের যা যা গুণাবলী থাকা দরকার তাঁর সবই তো আছে মিরাজের মধ্যে। তবুও তাঁর পরিচয় কেবলই স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান!
মিরাজের বয়স খুব বেশি না, এখনো তাঁর জন্য লম্বা সময় পড়ে আছে – চাইলে তিনি বড় ব্যাটসম্যান হতেই পারেন, সেই সামর্থ্য, যোগ্যতা আর সময় তাঁর হাতে আছে। এই সময়ে টিম ম্যানেজমেন্টের যেমন তাঁকে বুঝতে হবে, তেমনি তাঁর নিজেকেও নিজেকে সময় দিতে হবে।
যুব পর্যায়ের ক্রিকেটে মিরাজ মূলত ছিলেন একজন পুরোদস্তর মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। সাথে দারুণ বোলিং করতে জানেন। ওখানে তাঁর প্রাথমিক যোগ্যতা ছিল তাঁর ব্যাটসম্যানশিপ। বোলিংটা ছিল বাড়তি প্রাপ্তি। এই পরিচয়ে তিনি খেলেছেন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ, তাতে তিনি ছিলেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। কিন্তু, মূল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি হয়ে গেলেন স্রেফ একজন বোলার।
এখন মিরাজের ব্যাটসম্যান পরিচয়টাকে ফিরিয়ে আনার দরকার। বোলিংয়ে যেমন তাঁর উন্নতির জায়গা আছে – যেটা বারবার লেখা ও কথায় বলার চেষ্টা করছি আমরা, তেমনি তাঁর ব্যাটিংয়েও উন্নতির শেষ নেই। যদি করা যায় – তাহলে হয়তো শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেটেই নয় – আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও বিগ ফ্যক্টর হয়ে উঠতে পারেন এই মিরাজ।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক ক্রিকেটারই আছেন – যারা বোলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করে পুরোদস্তর ব্যাটসম্যান বনে গেছেন একটা সময় এসে। এখানে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ হতে পারেন সবচেয়ে বড় উদাহরণ। অন্যদিকে, মিরাজের জন্য চ্যালেঞ্জটা তত বড় নয়, কারণ তিনি তো শুরু করেছেন ব্যাটসম্যান হিসেবে। এবার শুধু পুরনো চরিত্রটা আরেকটু ঝালাই করার মিশন। স্রেফ স্বাভাবিক একটা পক্রিয়া।
একদম ছোট বেলা থেকে মিরাজকে ‘আগামীর সাকিব আল হাসান’ মনে করা হয়। অনেকদিন হল নানাকারণে সেই আলোচনা এখন স্তিমিত হয়ে আছে। তবে, এমন এক সেঞ্চুরি করার পর সেই আলোচনা নিশ্চয়ই আবার ফিরবে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ শুরুর আগে বলেছিলাম – এটা হবে মিরাজের জন্য শেষ লাইফলাইন। হয় এবার না হয় আর নয়। কথাটা বরং এখন এভাবে বলি – এটা মিরাজের নতুন এক জীবন। ওয়ানডেতে বোলিং দিয়ে তিনি ওয়ানডে বোলারদের র্যাংকিংয়ে চারে উঠে এসেছেন, এবার পেয়েছেন প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। মিরাজও তাহলে বদলে যাচ্ছেন, বদলে যাওয়ার এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকুক!