ডানহাতিদের দাপট: ভারতের কেস স্টাডি

ভারতের ব্যাটিং লাইনআপের একটা মজার বিষয় আমাদের সবার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। সেই মজার ব্যাপারটা দেখার আগে ভারতের টেস্ট ব্যাটিং লাইনআপের বড় নামগুলির দিকে একবার চোখ বুলানো যাক- মায়াঙ্ক আগারওয়াল, পৃথ্বী শ, শুভমন গিল, চেতেশ্বর পূজারা, বিরাট কোহলি, আজিঙ্কা রাহানে, হনুমা বিহারি আর রোহিত শর্মা। এই নামগুলির দিকে ভাল করে লক্ষ্য করুন, এই নামগুলির ব্যাটিং স্ট্যান্স মনে করার চেষ্টা করুন। কিছু লক্ষ্য করছেন?

এরা প্রত্যেকেই ডানহাতি ব্যাটসম্যান।তার মানে যেটা দাঁড়াল ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ বেশিরভাগই ডানহাতি ব্যাটসম্যানে ভর্তি। টানা এই ডানহাতি থাকার জন্যে প্রতিপক্ষ দলের অধিনায়কও কিন্তু পরিকল্পনা করতে একটা বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন।

আবার যদি আমরা টেস্টে ভারতের সেরা রান সংগ্রাহকদের দিকে তাকাই, সেই নামগুলো হল শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, সুনীল গাভাস্কার, ভিভিএস লক্ষণ থেকে হালের বীরেন্দ্র শেবাগ আর বিরাট কোহলি। একটু খেয়াল করলেই বুঝে ফেলা সম্ভব এরাও প্রত্যেকে ছিলেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান।

ভারতীয় ক্রিকেটের গ্রেট বাঁহাতি খুঁজতে হলে আপনি একটা নামই খুঁজে পাবেন – সৌরভ গাঙ্গুলি। আর গ্রেট ছাড়িয়ে সেরাদের কাতারে খুঁজতে চাইলে অবশ্য গৌতম গম্ভীর অবধি পৌছাতে পারেন। এর বেশি যদি অনুসন্ধান চালাতে চান তাহলে একালের শিখর ধাওয়ানকে তালিকায় রাখতে পারেন। কিন্তু এরপর? আর নেই!

ভারতের প্রবল প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়ার সাথে যদি আমরা এ তালিকাটার তুলনা করি তাহলে অস্ট্রেলিয়ার সাদা পোশাকে সবচেয়ে বেশি রান করা দশজন ব্যাটসম্যানের মধ্যে পাঁচজনই (অ্যালান বোর্ডার, ম্যাথ্যু হেইডেন, জাস্টিন ল্যাঙ্গার, মার্ক টেলর ডেভিড ওয়ার্নার) বাঁহাতি !

আরো পড়ুন

এখন ভারতের এই যে বাঁহাতির অপ্রতুলতা এর কারণ হিসেবে সে দেশের পরিবেশকেও আমরা কিছুটা দায়ী করতে পারি। ২০১৪ সালের দিকে ইকোনমিকস টাইমসেইন্ডিয়ান লেফট হ্যান্ডার ক্লাব’ এর প্রতিষ্ঠাতা সন্দ্বীপ বিষ্ণু একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন,

‘আমি রাজস্থানের একটা ছেলেকে চিনি যে কিনা সব কাজেই নিজের বাঁহাত ব্যাবহার করত। ও ডানহাত দিয়ে লিখতে পারত না, আর তাই ওকে স্কুলে অনেক অপমান সহ্য করতে হত। ওকে জোর করে ডানহাতি বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল আর ও যখন এটা একেবারেই পারল না, ওকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।’

বাঁহাতিদের নিয়ে এই উপমহাদেশে অনেক গালগল্প চালু আছে। আর একটা এরকম একটা গল্প হল এই যে একজন তাঁর শিশুকে সামনে বসিয়ে রেখেছে আর কলম তুলতে বলছে। যদি শিশুটা বাঁহাত দিয়ে কলম তোলে তাহলে তাঁর হাতে স্কেলের বাড়ি দেওয়া হবে। দুঃখের ব্যাপার, এটা শুধুই গল্প হয়ে থাকেনি। এখন সত্যিই বাঁহাতিদের নিয়ে মশকরা করা হয়, অনেক জায়গাতেই এভাবে স্কেলের বাড়ি দেওয়া হয়। উপমহাদেশের অনেক বাবা-মায়েরা বাঁহাতি শিশুকে অভিশাপ হিসেবেও নিয়ে থাকেন। 

তবে পৃথিবীর অন্য সব জায়গার চাইতে এই উপমহাদেশের বাঁহাতিদের সংখ্যা কিন্তু বেশ কম। কানাডা আর ইংল্যান্ডের জনসংখ্যার ১১.৫ শতাংশ বাঁহাতি, অস্ট্রেলিয়াতে যেটা কিনা ১০ শতাংশ। কিন্তু এই উপমহাদেশে আরব আমিরাতে সেটা ৭.৫ শতাংশ, ভারতে ৫.৮ শতাংশ, জাপানে ৪ শতাংশ। এখন একজন বাঁহাতি হবে নাকি ডানহাতি হবে সেটাতে অবশ্যই জেনেটিক ব্যাপার থাকে, কিন্তু পরিবেশের প্রভাবও একেবারেই উপেক্ষা করার মত না। এটা কিন্তু আমি বলছিনা, বিজ্ঞানীরা বলেছেন।

ভারতের স্কুলগুলোতে অবশ্য এখন বাঁহাতিবিদ্বেষ দূর করার জন্যে বিভিন্ন প্রোগ্রাম আয়োজন করা হয়, কিন্তু সেটা আসলে পর্যাপ্ত কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন হতে পারে। সৌরভ গাঙ্গুলী কিংবা ভারতের সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সবচাইতে বড় তারকা যুবরাজ সিং তো বাঁহাতি ছিলেন, কিন্তু কেউ যখন শচীন হতে চায় সে ডানহাতি না হলে বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। কিন্তু একালের ঋষভ পান্ত কিংবা রবীন্দ্র জাদেজার দিকেও তো তাকানো উচিত।

কিংবা যদি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) দিকে আমরা তাকাই, আইপিএল ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক বিরাট কোহলি। কিন্তু দ্বিতীয় নামটা? সুরেশ রায়না। এছাড়াও তৃতীয় নামটা ডেভিড ওয়ার্নার, যিনি নিজেও বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। তবে বাঁ-হাতিদের রোল মডেল খুঁজতে হলে আমাদের সাকিব আল হাসানের দিকে তাকাতেই হবে। আর তিনিও এই উপমহাদেশেরই ক্রিকেটার!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link