Social Media

Light
Dark

আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে!

ছেলেটাকে প্রথম দেখেছিলাম বাংলাদেশেই, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। একেবারে ভারতীয় ক্রিকেটের গলি ঘুপচি জানা সমর্থক না হলে ঋষাভ পান্তকে এর আগে নজরে আনা বেশ মুশকিল। যাই হোক, অধিনায়ক ঈশান কিষাণের সাথে ওপেনিং এ নামতেন। ঋষাভের খেলার একটা বিশেষ ধরণ ছিল আর সেটাই ওর নজর কাড়ার জন্যে বাধ্য।

ছেলেটাকে প্রথম দেখেছিলাম বাংলাদেশেই, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। একেবারে ভারতীয় ক্রিকেটের গলি ঘুপচি জানা সমর্থক না হলে ঋষাভ পান্তকে এর আগে নজরে আনা বেশ মুশকিল। যাই হোক, অধিনায়ক ঈশান কিষাণের সাথে ওপেনিং এ নামতেন। ঋষাভের খেলার একটা বিশেষ ধরণ ছিল আর সেটাই ওর নজর কাড়ার জন্যে বাধ্য।

ঋষভ পান্থ খেলতেই চাইত আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে। কখনও পারত, কখনও পারত না। তবে মজার ব্যাপার হল, ঋষভ যদি ১০০ এর নিচে স্ট্রাইক রেটেও ব্যাট করত সেটাও দেখতে আক্রমণাত্মকই লাগত। সে যাক, ঋষভ সেবার বিশ্বকাপটা জিততে পারেনি। না পারুক, বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের শিরোপা তো আর কম নেই ভারতের।

তবে, বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও একটা ব্যাপার জিতে নিয়েছিলেন ঋষাভ রাজেন্দ্র পান্ত আর সেটা হল ভারতীয় ক্রিকেট কর্তাদের চোখ। আর তাই তো তাঁর সাথে থাকা অধিনায়ক ঈশান কিষাণ আর দলের সবচাইতে টেকনিক্যালি সলিড ব্যাটসম্যান সরফরাজ খানের আগে সুযোগ মিলেছিল দলে। এরপর ঋষাভ পান্ত হেঁটে গেছেন বহুপথ। কখনও হোঁচট খেয়েছেন, কখনও পড়তে পড়তে উঠেছেন আর কখনও বা পড়ে গিয়ে বসে থেকেছেন আরেকবার উঠে দাঁড়াবেন বলে।

ঋষাভ পান্ত যখন আলোয় এসেছিলেন তখন ভারতীয় ক্রিকেটে মহেন্দ্র ধোনির সূর্য অস্ত যায় যায় করছে। উইকেট কিপিংয়ে ভারতের দীর্ঘদিনের বড় ভরসা গ্লাভস জোড়া খুলে রাখবেন, এমন শোকের মাতম ভারত তখন করেনি। আসলে করার সুযোগ পায়নি। ভারতীয় ক্রিকেটের সবথেকে বড় চিন্তা তখন ধোনির ফেলে যাওয়া গ্লাভসে হাত গলাবেন কে। ঋষাভ পান্ত, ঋদ্ধিমান সাহা বহুপথ ঘুরে ঋষভের দিকে যেন একটু বেশিই নজর দিয়েছিলেন নির্বাচকেরা।

ঋষাভেরও মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, ‘ধোনির মত হতে হবে।’ কেউ যখন কারো মত হতে চায়, সে নিজের সহজাত প্রবৃত্তি হারিয়ে ফেলে। ঋষাভের ক্ষেত্রেও হয়েছিল তাই। এ ব্যাপারে সবথেকে বড় সত্যিটা মিডিয়াতে বলেছিলেন সাবেক ভারতীয় প্রধান নির্বাচক এম.এস.কে প্রসাদ।

প্রসাদ সোজাসুজিভাবেই বলেছিলেন, ‘আসলে যখনই ঋষাভ পান্ত খেলেছে, ওকে ধোনির সাথে তুলনা করা হয়েছে। আর এতে সেও নিজেকে ধোনীর সাথে তুলনা করা শুরু করেছে, মাঠে ধোনিকে হুবহু নকল করার চেষ্টা করেছে। অনেকবারই আমরা তাকে বলেছি- মাহি সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন ব্যাক্তিত্ব আর তুমিও আলাদা একজন। তোমার মধ্যে প্রচুর প্রতিভা আছে আর সে কারণেই আমরা তোমাকে ব্যাকআপ দিচ্ছি।’

প্রসাদের কথা ঋষাভ শুনেছেন কিনা জানিনা। তবে এক সময় সবাই কিন্তু একটু বিরক্তই হয়ে গেছিল । তবুও নির্বাচক আর অধিনায়ক ঋষভকে দলে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছিলেন। দলে হয়তো ব্যাকআপ ব্যাটসম্যান আছে, হয়তো ব্যাকআপ উইকেটকিপারও আছে। তবুও ঋষাভকে লাগবেই!

এবার একটু বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে ফেরা যাক, খুব বেশিদিন আগের কথা তো নয়। দুই দেশের দুই কিংবদন্তির নামে শুরু হওয়া এই ট্রফির এবারের সিরিজটা খেলতে অস্ট্রেলিয়া গেছিল টিম ভারত। শুরু থেকেই দলে জায়গা পাননি ঋষাভ, পাওয়ার কথাও নয়। সাদা পোশাকে ভারত দীর্ঘদিন ঋষাভ আর ঋদ্ধিমান সাহাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলালেও বড় ভরসাটা ছিল ঋদ্ধিমানের ওপরই। তবে ৩৬ এর সেই ট্রাজেডিটার পর পাশার দান গেল উল্টে। অধিনায়ক তো ফিরেই গেলেন, আরো কয়েকটা বড় পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল।

লিওঁ টলস্টয় বলেছিলেন, পরিবর্তন না হলে সত্যিকারের জীবন পাওয়া যায়না। ঋষাভ পান্তও তো দলের পরিবর্তনে একটা জীবনই পেয়েছিলেন বলতে হবে। তবে পরিবর্তনের জীবন পেলেই তো হবেনা, সেটাকে তো কাজে লাগাতে হবে!

এমনিতেই মাথার ওপর রাজ্যের চাপ, সমর্থক-বিশেষজ্ঞদের অনেকেই হুট করে ঋদ্ধিমানের বাদ পড়াটা মানতে পারেননি। আবার দলও তখন বিষম চাপে, এর মধ্যে আবার নেওয়া হয়েছে ঋষভকে, টেস্ট ক্রিকেটে যার খেলার ধরণ মানানসই কিনা এমন একটা আলোচনা আছে বহুদিন ধরেই। সেই ভীমের গদার মত চাপ মাথায় নিয়ে ব্রিসবেনে ব্যাট করতে নেমে ঋষভ করলেন কি?

এটা যদি রূপকথা হত আর ঋষাভ যদি নায়ক হতেন তাহলে হয়ত গল্পের নায়ক ‘দেখিয়ে দেওয়া’র মত একটা ইনিংস খেলতেন । কিন্তু জীবনটা রূপকথা নয়, মেলবোর্নের এক ইনিংসে ব্যাট করে ঋষাভ তাই করলেন মাত্র ২৯, প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেন স্টার্কের বলে পেইনের হাতে ক্যাচ দিয়ে!

আলোচনাটা তো এমনিতেই চলছিল, ছাইচাপা আগুনে ফুঁ দিয়ে দিলেন ঋষাভ পান্ত। ঋষাভ তো পারলেন না, আবারও তবে ঋদ্ধি কেন নয়? যে ম্যাচ দিয়ে ঋদ্ধিমানের বাদ পড়া সেখানে তো ঋদ্ধি একা খারাপ খেলেননি।

যৌক্তিক কথা। তবে তা মানতে বয়েই গেছে কোচ আর অধিনায়কের। আগেই বলেছি, ঋষাভের জন্যে ভারতীয় ক্রিকেটে একটা ‘সফট কর্ণার’ ছিল সবসময়ই। পরিবারের বেয়াড়া ছোট ছেলের মত ঋষাভ খারাপ করলেও সবসময় মিডিয়ার সামনে ঢাল হয়ে সবসময় দাঁড়িয়ে গেছেন অধিনায়ক-নির্বাচকেরা । আর তাছাড়াও, ছত্রিশের ট্রাজেডির পরের ম্যাচেই টেস্ট জিতেছে ভারত, কে আর তখন টিম কম্বিনেশন পরিবর্তন করে!

ভারতও করেনি, সিডনিতে তাঁরা মাঠে নেমেছে ঋষভকে নিয়েই। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসের ৩৩৮ রান তাড়া করতে নেমে ভারত যে এবার প্রথম ইনিংসে অল-আউট হয়ে গেল ২৪৪ রানেই! আর ভারতের ২৪৪ রানে পান্তের অবদান মাত্র ৩৬!

তবে সিডনিতে নিজেকে একটু বাঁচিয়ে নিয়েছিলেন পান্থ, ছেঁকে ধরা মৌমাছির মত সমালোচনা এড়িয়ে তিনি দ্বিতীয় ইনিংসেই করে ফেললেন ৯৭ রান!

যাক বাবা, একটু হলেও তো বাঁচা গেল। কিছু তো একটা করে দেখানো গেল অবশেষে। তবে ঋষভ কিন্তু সে ম্যাচে আলোয় আসতে পারলেন না। ম্যাচের পুরো আলো কেড়ে নিলেন হনুমা বিহারি আর রবীচন্দ্রন অশ্বিন। ভারতও সে ম্যাচে ড্র করে ফেলল।

চার ম্যাচ সিরিজে তখন ১-১ এ সমতা। ঋষভ পান্ত এবার একটু স্বস্তিতে আছেন। ৯৭ রানের ইনিংসটা কিছুটা হলেও আরাম দিয়েছে তাকে, দিয়েছে মুক্তি। তবে ঋষাভের মত থাকেনি ভারতের পুরো দল, ছিল ভীষণ অস্বস্তিতে। আর থাকবে নাই কেন? কোহলি নেই, অশ্বিন,বুমরাহ, বিহারি, জাদেজা ইনজুরিতে, ভারতকে খেলতে নামতে হত নিয়মিত একাদশের পেসার ছাড়াই!

সে যাক, মহা চাপের এই ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ঋষভ করলেন মাত্র ২৩! তিনি আরেকটু ভাল করলে হয়তো ভারত লিড নিয়ে ফেলতে পারত, কিন্তু ঋষাভ তাঁর এই ‘আরেকটু ভাল’  ইনিংসটা তুলে রেখেছিলেন এমন এক সময়ের জন্যে যেখানেই আসলেই সেটা ভাল জমে-ক্লাইম্যাক্স শেষে না হলে কি আর থ্রিলার জমে!

অবশেষে ক্লাইম্যাক্সেও বাজিমাত করে দিলেন ঋষাভ। ইতিহাস হয়ে যাওয়া রান তাড়ায় তিনি ১৩৮ বল খেলে অপরাজিত আছেন ৮৯ রানে। একটু ব্যাক-গিয়ারে গিয়ে দেখুন। ৩৬ রানে অল-আউট, দলে ঋষাভের জায়গা নেই আর সেখান থেকে সিরিজ জেতা ম্যাচ আর সেখানে দলকে জিতিয়ে ঋষাভ অপরাজিত আছেন ৮৯ রানে, হয়েছেন ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ও! টেস্ট ক্রিকেট তো এমনিতেই জীবনের গল্প বলে, ঋষভ যেন আজকে সেই জীবনের প্রতিটা মোড়ের বাঁক চিনিয়ে গেলেন!

ঋষাভের কথা দিয়েই শেষ করি,  ‘এটা আমার জীবনের সবথেকে বড় দিন। যখন আমি খেলছিলাম না, যে সমর্থন দল আমাকে দিয়েছে তা অসাধারণ। এটা একটা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মত। প্রথম টেস্টের পর থেকেই আমরা কঠিন অনুশীলন করছিলাম। টিম-ম্যানেজমেন্ট সবসময়ই আমাকে রক্ষা করেছে আর বারবার বলেছে- তুমি ম্যাচ উইনার, তোমাকে শুধু সেখানে যেতে হবে আর জিততে হবে এবং আমি সেটা করতে পেরেছি আজকে (গ্যাবা টেস্টের শেষদিন), এজন্যে আমি আনন্দিত। এটা আসলেই পঞ্চম দিনের পিচ ছিল আর বল টার্ন করছিল।’

ঋষাভ রাজেন্দ্র পান্ত, আপনি সত্যিই পেরেছেন!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link