১৯৯৯ সালে কার্গিল সীমান্তে দুই দেশের সৈন্যরা তখন বারুদ আদান-প্রদানে ব্যস্ত। সেই সময় ভারতে টেস্ট খেলতে আসে পাকিস্তান ক্রিকেট দল। চেন্নাই টেস্টে পড়ন্ত বিকেলে ভারতের হয়ে অভিষেক হয় সদাগোপন রমেশ নামের নতুন এক ব্যাটসম্যানের।
ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুসদের বোলিং তোপে যখন ভারতের বাঘা বাঘা সব ব্যাটসম্যানদের হাঁটু কাঁপছে ঠিক তখনই শুরু হয় রমেশের ক্রিকেটীয় অধ্যায়। একটি সংক্ষিপ্ত অধ্যায় যার দাগ থেকে যাবে চিরকাল।
সেদিন কার্গিল সীমান্তের বারুদের উত্তাপকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন রমেশ। অভিষেক ম্যাচে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুসদের বল শুধু সামালই দেননি, খেলেছেন কর্তৃত্ব নিয়ে। প্রথম দিনের খেলা শেষে ৩০ রানে অপরাজিত থেকে যখন ড্রেসিং রুমে ফেরেন তখন অধিনায়ক মোহম্মদ আজহারউদ্দীন তাঁকে জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন।
আজহারউদ্দীন সেদিন বলেছিলেন, ‘অভিষিক্ত কোনো ব্যাটসম্যান ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুসদের বল এভাবে খেলবেন তা আমি কখনো চিন্তাও করতে পারিনি।’ সেই ম্যাচে পরের দিন সকালে ইনিংস খুব বেশি লম্বা করতে না পারলেও ফিরেছিলেন ৪১ বলে ৪৩ রানের একটি ইমপ্যাক্টফুল ইনিংস খেলে।
দিল্লিতে তাঁর দ্বিতীয় টেস্টে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আরও উজ্জ্বল। প্রথম ও দ্বিতীয় ইনিংসে তার রান যথাক্রমে ৬০ এবং ৯৬। পরের টেস্টেও অব্যাহত থাকে তাঁর রানের ফুলঝুরি। খেলেন ৭৯ ও ৫০ রানের দু’টি ইনিংস। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বোতে তাঁর চতুর্থ টেস্টেও খেলেন ১৪৩ রানের বাহারি এক ইনিংস। তুলে নেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর প্রথম সেঞ্চুরি।
তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম চার টেস্টেই ৬২ গড়ে করেন ৪৯৬ রান। এবার তাকে ভাবা হচ্ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের এক নতুন অধ্যায় হিসেবে। যিনি টেস্ট ক্রিকেটে নিজেকে এবং ভারতকে নিয়ে যাবেন এক নতুন উচ্চতায়। এমনকি ১৯৯৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের দলেও জায়গা করে নেন রমেশ। অসাধারণ একটি বছর কাটানোর করার পর ভারতের বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন।
২০০০ সালে টেস্টে হাফ সেঞ্চুরি করেন মাত্র একটি। এরপর ২০০১ সালে শ্রীলঙ্কা সফর যেন অপয়া হয়ে আসে তাঁর ক্যারিয়ারে। যদিও সেই সফরের ৩ টেস্টের ৬ ইনিংসে তিনি রান করেন যথাক্রমে ৪২, ২, ৪৭, ৩১, ৪৬ এবং ৫৫। এমনকি তিনি ছিলেন ওই সফরে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (২২৩) রান সংগ্রাহক।
ভারতের হয়ে ওই সফরে সবচেয়ে বেশি (২৩৫) রান করেন রাহুল দ্রাবিড়। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে শেষ টেস্টে ১০১ রান করা রামেশকে বাদ দিয়ে দেয়া হয় পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে। তার পরিবর্তে দলে রাখা হয় শিবসুন্দর দাসকে যিনি শ্রীলঙ্কা সফরে রমেশের থেকে কম রান করেছিলেন।
২০০১ এ জাতীয় দল থেকে ছিটকে গেলেও তিনি ধারাবাহিকভাবে রান করতে থাকেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। পরপর দুই বছর পাহাড়সম রান করার পর ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরের জন্য তাকে আবার জাতীয় দলে ফিরিয়ে আনা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম প্রস্তুতি ম্যাচে ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে ৮৭ রানের একটি ইনিংস ও খেলেন।
তবুও সেই সিরিজের চারটি টেস্টই তাঁকে দেখতে হয় সাইডবেঞ্চে বসে। হয়তো সেই সময় ভারতের হয়ে ওপেন করা শেওয়াগ,আকাশ চোপড়াদের মাঝখানে রামেশকে কখনোই চায়নি টিম ম্যানেজমেন্ট। তাই হয়তো রমেশকে পরবর্তী পাকিস্তান সফরের দলেও রাখা হয়নি।
বাদ পড়াটা কখনোই মেনে নিতে পারতেন না রমেশ। যেভাবেই হোক তিনি ফিরবেনই। ১০ বছর বয়সে যখন পেস বোলার হিসেবে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন তখন অনূর্ধ্ব-১৩ দলে নির্বাচিত না হওয়ায় পেস বোলিংই ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরে শুরু করেন অফ স্পিন করা। এবং সবাইকে অবাক করে অফ স্পিন করেই জায়গা করে নিয়েছিলেন অনুর্ধ্ব-১৬ দলে।
১৯৯৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যখন ওয়ানডে অভিষেক হয় তখন এই অফ স্পিন দিয়েই রেকর্ড বুকে জায়গা করে নেন রমেশ। অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি তাঁর হাতে বল তুলে দিলে প্রথম বলেই তুলে নেন উইকেট। তিনিই ভারতের প্রথম বোলার ছিলেন যিনি অভিষেক ম্যাচের প্রথম বলেই উইকেট পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে ভুবনেশ্বর কুমার দ্বিতীয় বোলার হিসেবে এই রেকর্ড করেন।
২০০৪ এ জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর তামিল নাড়ুর হয়ে অঝোরে রান করেন বাম-হাতি এই ব্যাটসম্যান। ১১৬ ম্যাচে ২০ টি সেঞ্চুরি সহ করেন ৭৬৯৬ রান। ২০০৮ সালে ক্যারিয়ারের একদম দাড়প্রান্তে আসামের হয়েও এক সিজন ব্যাট করেন তিনি।
কিন্তু ২০০১ সালে শ্রীলঙ্কা সফরের পর জাতীয় দল থেকে বাদ পড়লে আর কখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে পারেননি রমেশ। মাত্র ১৯ টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ৩৮ গড়ে ১৩৬৭ রান করা রমেশের ক্যারিয়ার কেনো আরও দীর্ঘ হলো না তা হয়তো বারবার ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাস কে প্রশ্ন করে যাবে।
মজার বিষয় হলো বাদ পড়া যে তিনি মেনে নিতে পারেন না তার প্রমাণ তিনি আবারও দিয়েছেন। ২০০৮ সালে ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি অভিনয় করা শুরু করেন তামিল সিনেমায়। ‘সান্থোশ সুব্রামানিয়াম’ নামে একটি সিনেমায় অভিষেক হয় তাঁর অভিনয় জীবনের। পরবর্তীতে ২০১১ সালে ‘পোট্টা পোট্টি’ সিনেমায় তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন।
অবশ্য এমন নাটকীয়তায় ভরা যার জীবন তিনি তো তামিল সিনেমার হিরোই হবার কথা!