যার ধেয়ে আসাই ছিল বিপদের পূর্বাভাস

সেটা ছিল ক্যারিবিয়ান ফাস্ট বোলিংয়ের দুরন্ত এক সময়।

‘পেস কোয়াড্রেট’ দিয়ে বিশ্ব কাঁপাচ্ছে তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই দলে গার্নার, রবার্টস ও মার্শালের তুলনায় একটু যেন কম ‘আতঙ্ক’ ছিলেন তিনি। কিন্তু পরিসংখ্যান ও ইতিহাস বলে, তিনিও যোগ্যতায় যে কারো মতই ভয়ানক ছিলেন।

হ্যাঁ, তিনি মাইকেল অ্যান্থনি হোল্ডিং।

কিংস্টনের হাফওয়ে ট্রি নামে এলাকায় জন্ম হোল্ডিংয়ের। বাবার দিকের সবাই ছিলেন কালো। সে জন্য মায়ের বাড়ির লোকজন খুব অপছন্দ করতেন হোল্ডিং ও তার ভাইয়েদের। মাত্র তিন বছর বয়সে অ্যাজমা ধরা পড়ে। তখন তিনি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন কি না, এ নিয়ে সন্দেহ তৈরী হয়।

কিন্তু কালক্রমে হোল্ডিং ইনহেলারকে বিদায় করে দেন। তার জীবন হয়ে ওঠে খেলাময়। অনেক ধরণের খেলাই যৌবনে খেলেছেন। এর মধ্যে ক্রিকেট তাকে বেঁধে ফেলেছিল।

৭০-৮০ দশকের অন্যতম সেরা পেসার ছিলেন মাইকেল হোল্ডিং। ৭০-৮০ দশকের ক্রিকেটারদের কাছে মাইকেল হোল্ডিং এর পরিচয় ছিল একজন গতিশীল বোলার হিসেবে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে তাঁর পরিচয় শুধু মাত্র একজন সাবেক ক্রিকেটার নয়; একজন ধারাভাষ্যকার। যিনি তাঁর দরাজ কণ্ঠ দিয়ে জয় করেছেন ক্রিকেট বিশ্বকে।

মাইকেল হোল্ডিং ছিলেন ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর পেসারদের মধ্যে একজন। ৭০-৮০ দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান যেসব পেসার বিশ্বকে শাসন করেছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম ‘হাইলাইটেড’ ছিলেন মাইকেল হোল্ডিং। জোয়েল গার্নার, অ্যান্ডি রবার্টস, ম্যালকম মার্শাল কারো থেকেই কম ছিলেন না হোল্ডিং। অন্তত ক্রিকেটীয় পরিসংখ্যান এবং ইতিহাস এটাই বলে যে, বাকি তিন জনের চেয়ে সবচেয়ে কম ত্রাস ছিলেন মাইকেল হোল্ডিং।

মাইকেল হোল্ডিংকে বলা হত ‘হুইসপারিং ডেথ’। কারণ তিনি মাঠে ছিলেন সবচেয়ে শান্ত একজন ক্রিকেটার। তাঁর মাঠের ব্যবহারে কখনো বোঝা সম্ভব ছিলো না তিনি একজন ফাস্ট বোলার। মাঠে শান্ত থাকলেও বল হাতে আগুন ঝরাতে কোনো অংশেই কম ছিলেন না তার অন্যান্য ফাস্ট বোলার সতীর্থদের থেকে।

মাইকেল হোল্ডিং এর উচ্চতা ছিল ৬ ফুট সাড়ে ৩ ইঞ্চি। এই উচ্চতার ব্যবহারের হয়ে উঠেছিলেন দুর্দান্ত একজন ফাস্ট বোলার। শুধু অনেক দ্রুত গতিতে বল করতেন না, বলে ছিল দুর্দান্ত সব বাউন্স। মাইকেল হোল্ডিং হয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেরা ফার্স্ট বোলারদের প্রজন্মের একজন ফাস্ট বোলার।

যেকোনো ধরনের উইকেটে আগুন ঝড়াতে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন মাইকেল হোল্ডিং। সেটা হোক উপমহাদেশের উইকেট। ইংল্যান্ড,অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের মাটিতে বল হাতে মাঠ কাপিয়েছেন মাইকেল হোল্ডিং এবং তাঁর সতীর্থ বোলাররা।

মাইকেল হোল্ডিং এর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে অভিষেক ১৯৭৫ সালে। দলে সুযোগ পেয়েছিলেন আরেক কিংবদন্তি পেসার বানার্ড জুলিয়েনের স্থলে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অভিষেক সিরিজে বোলিং করেন অ্যান্ডি বরার্টেস সাথে জুটি বেঁধে।

দ্বিতীয় টেস্টেই উইজডেনের মতে তিনি ‘জেফ থমসনের চেয়েও জোরে’ বল করেন। ওই সিরিজে রবার্টস যেন হোল্ডিংয়ের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যান।

ক্যারিয়ারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলেছেন ৬০ টেস্ট। নিয়েছেন ২৪৯ উইকেট। ক্যারিয়ারে বোলিং গড় ছিলো ২৩.৬৮ এবং প্রতি উইকেট নিতে করেছেন ৪৯ বল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলেছেন ১০২ ওয়ানডে। ১২০ ওয়ানডে নিয়েছেন ১৪২ উইকেট। বোলিং গড় ২১.৩৬ এবং বোলিং স্ট্রাইক রেট ৩৮.৫৪। টেস্টে ব্যাট হাতে মোটামুটি কার্যকরী ছিলেন মাইকেল হোল্ডিং। টেস্টে ৭৩ ইনিংসে ব্যাট করে করেছিলেন ৯১০ রান। সর্বোচ্চ ছিল ৭৬ রান। বিচিত্র একটি তথ্য হল মাইকেল হোল্ডিং তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রায় ২৪ শতাংশ রানই করেছেন ছক্কার মাধ্যমে।

বল হাতে এখন পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের হয়ে সেরা বোলিং ফিগারের অধিকারী মাইকেল হোল্ডিং। ম্যাচে ১৪৯ রানে ১৪ উইকেট নেয়ার রেকর্ড এখনো কোনো ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বোলারদের পক্ষে ভাঙ্গা সম্ভব হয়নি।

তাঁর সময়ে সেরা একজন বোলারদের মধ্যে অন্যতম হয়েও ক্যারিয়ারে খুব বেশি পাদপ্রদীপের আলোয় ছিলেন না তিনি। সম্ভবত শান্ত স্বভাবের হওয়ার কারনেই তিনি খুব বেশি লাইম লাইটে ছিলেন না।

তখনকার দিনে ক্রিকেটে খুব একটা টাকা পয়সা ছিল না। ফলে হোল্ডিং বাড়তি কিছু টাকা আয়ের জন্য কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা শুরু করেন। পাশাপাশি ক্রিকেট উইকেট নিয়েও কাজ করার চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যেই ক্যারি পেকারের বিখ্যাত ওয়ার্ল্ড সিরিজে অংশ নেন। ফলে হুমকিতে পড়ে গিয়েছিল তার ক্যারিয়ার। পরে অবশ্য ফিরে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত খেলেছেন তিনি।

৬০ টেস্টে ২৪৯ উইকেট এবং ১০২ ওয়ানডেতে ১৪২ উইকেট নিয়ে অবসরে যান হোল্ডিং। অবসরের পর ক্রিকেটের সাথে ঘনিষ্ঠই হয়ে আছেন। ধারাভাষ্যকার হিসেবে পেয়েছেন দারুন জনপ্রিয়তা। গমগমে কণ্ঠ তাকে অন্যরকম একটা পরিচিতি এনে দিয়েছে।

ধারাভাষ্যকার হিসেবে ঠোঁটকাটা বলে পরিচিত। খোদ আইসিসি বিশ্বকাপের ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে আইসিসির সমালোচনা করে আলোচনায় এসেছিলেন।

আর এই সবকিছু মিলিয়েই অনন্য এক নাম মাইকেল হোল্ডিং। গতি দিয়ে, বাউন্সার দিয়ে, কথা দিয়ে যিনি জয় করেন বিশ্ব।

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link