গ্রেট নম্বর থ্রি অব ইন্ডিয়া

১৯৪১ সালের বোম্বে নাম বদলে এখন আধুনিক মুম্বাই।

তবে বোম্বে বলুন আর মুম্বাই দুটিই বিশ্বের মেগাসিটি। ভারতের অর্থনীতির চাকা, ভারতীয় সিনেমার আঁতুড়ঘর, শত শত তারার মেলা কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক প্রসিদ্ধ শহর বোম্বে। সেটা ২০২১ সালের অত্যাধুনিক মুম্বাই হোক কিংবা সেই ১৯৪১ সালের বোম্বে।

৮০ বছর আগে এই শহরে জন্ম নেয়া ছেলেটাকে বাবা বানাতে চেয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। বাবার স্বপ্ন ছেলে হবে অংকের পন্ডিত। ছেলেও অংকের ওস্তাদ হয়েছে ঠিকই তবে একটু ভিন্ন ভাবে। দ্রুত গতিতে ছুটে আসা ওই কাঠের বলটা ব্যাটসম্যানের ব্যাটের কোণায় লেগে ঠিক কত ডিগ্রি কোণে সেটা তাঁর দিকে আসবে এই অংক বোধহয় ক্রিকেট দুনিয়ায় তাঁর থেকে ভালো কেউ করতে পারে না।

তিনি যদি বাবার বাধ্য সন্তান হয়ে কাগজ-কলম নিয়ে অংকই কষবেন তাহলে ভারতের ক্রিকেট উত্থানটা হবে কার হাত ধরে? অবাধ্য কন্ডিশন গুলোকে বশে এনে ভারতকে জিততে শেখাবে কে? কিংবা ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা তিন নম্বর ব্যাটসম্যানটাই বা হবে কে ? এইসব অংক মেলাতে গিয়েই তো অজিত ওয়াদেকারের আর ইঞ্জিনিয়ার হওয়া হলো না।

১৯৫৮ সালে ভারতের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করেন অজিত ওয়াদেকার। তবে বোম্বেতেই তাঁর টেস্ট অভিষেক হয় আরো আট বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। আট বছরে ঘরোয়া ক্রিকেটে কয়েক হাজার রান করে আসা ওয়াদেকার তাঁর অভিজ্ঞতার পুরোটা ঢেলে দেন জাতীয় দলে। দ্রুতই তিন নম্বর পজিশনে ভরসার নাম হয়ে ওঠেন অজিত ওয়াদেকার। ১৯৭১ সালে ভারতের অধিনায়ক ঘোষণা করা হয় তাঁকে। সেই দলটার অধিনায়ক যেই দলে ছিলেন সুনীল গাভাস্কার, ফারুখ ইঞ্জিনিয়াররা আরো ছিলেন বিষান সিং বেদি বা ভগবত চন্দ্রশেখরের মত ক্রিকেটার।

তবে দেশের বাইরে জয় তখনও এক অজানা রহস্য দলটার জন্য। ১৯৬৮ সালে প্রথম টাইগার পতৌদির নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ডে জয় পেয়েছিল একবার। এছাড়া দেশের বাইরে ক্রিকেট খেলাটা যেন দুঃস্বপ্ন দলটার কাছে। তাও যদি হয় তখনকার ক্রিকেটের পরাশক্তি ইংল্যান্ড বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তাদেরই দেশে। তবে ১৯৭০ সালে অজিত ওয়াদেকারের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজে যাওয়া দলটা বুঝি এক অন্য দল। অজিতের দলটা প্রথমবারের মত ভেদ করলো উইন্ডিজ রহস্য। প্রথমবারের মত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জয়। তাও তাদেরই দেশে পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ জয় করে ফিরে এলো অজিতরা।

এই যে দেশের বাইরে জয়টা যে কোনো অঘটন না কিংবা ক্যাপ্টেন অজিত ওয়াদেকার যে ভারতের ক্রিকেট ইতিহাস বদলে দিতেই এসেছেন তা প্রমাণ করেন পরের বছরই। এবার ইংল্যান্ডে গিয়ে পরাশক্তি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জয় করে ঘরে ফেরে অজিতের ভারত। এমন কি এরপর ইংল্যান্ড ভারতে এলে সেখানেও ২-১ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজে জয় পায় ভারত। টানা তিন টেস্ট সিরিজে জয় তুলে নেন তাঁরা।

তাই ঘরের মাঠে ভারতকে স্মরণ করতে গেলেই আপনাকে একবার সালাম জানিয়ে নিতে হবে অজিত ওয়াদেকারকে। তবে এসবের পেছনে ঢাকা পড়ে যায় ব্যাটসম্যান অজিতের অসাধারণ সব কীর্তি। ভারতের হয়ে ৩৭ টি টেস্ট ম্যাচ খেলে করেছেন ২১১৩ রান। তিনিই ভারতের প্রথম বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান যিনি টেস্ট ক্রিকেটে দুই হাজার রান পূর্ণ করেন। যেই তালিকায় পরবর্তীকালে যুক্ত হন সৌরভ গাঙ্গুলি কিংবা গৌতম গম্ভীররা।  শুধু তিন নম্বরে ব্যাট করেই করেছেন ১৮৯৯ রান। ভারতের হয়ে এই পজিশনে তাঁর চেয়ে বেশি রান করেন শুধু রাহুল দ্রাবিড়, মহিন্দের অমরনাথ ও দীলিপ ভেংসরকার।

তাঁর বীরত্ব-গাথা অধিনায়কত্বের গল্পের পেছনে প্রায়ই ভাঁটা পড়ে এসব ব্যাটিং রেকর্ড। তাছাড়া ঘরোয়া ক্রিকেটেও রানের ফোয়ারা খুলে বসেছিলেন এই কিংবদন্তি। এখানে প্রায় ৪৮ গড়ে করেছেন মোট ১৫ হাজারেরও বেশি রান। তাছাড়া স্লিপিং পজিশনে অজিত ওয়াদেকারকেই বা আপনি কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন! ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই স্লিপিং ফিল্ডারের গল্পই বা আমরা ক’জন বলি।

১৯৭৪ সালে ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পরেও তো ভারতীয় ক্রিকেটকে দু’হাতে দিয়ে গিয়েছেন তিনি। ১৯৯০ সালে ভারতীয় ক্রিকেট দলের ম্যানেজার হন তিনি। এছাড়া ভারতের কোচ ও সিলেক্টিং কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। তবে ২০১৮ সালে তাঁর মুম্বাই শহরেই মৃত্যবরণ করেন এই কিংবদন্তি। এর আগে ১৯৭২ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হন তিনি।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link