‘জার্মানি সাম্রাজ্যের রাজ্যপাটে অনেক তাবড় নামের ভীড়ে আমার নামটা কেউ কখনও সেভাবে উচ্চারণই করেনি। তবু আমি ছিলাম, থাকব… যদ্দিন লোকে মনে-টনে রাখে আর কী!’
একটা বাজে চিঠি লিখছিলাম। সে অনেককাল আগের কথা। আমার পাশে তখন জ্বলজ্বল করছে সব তারাদের গোষ্ঠী। কোচ লো’র তত্ত্বাবধানে যা খেলতাম আমরা তাতে ‘কাইজার’ শব্দের মানেই বদলে যাচ্ছিল আরেকটু হলে। সবার যেমন শুরু হয় জার্মানিতে, বা বলা ভাল ইউরোপের যে কোনও ক্লাবে, তেমনই আমার শুরু ফুটবলকে সঙ্গী করে স্বপ্ন দেখা।
এই যেমন আমার জন্ম স্টুটগার্টে। ভিএফবি স্টুটগার্টে খেলা শুরু করলাম। কিমাশ্চর্যম! একে আপনারা অভাবনীয় বলতে পারেন, আবার বলতে পারেন কপালের ফের। কেন না, আমি যে বছরে বুন্দেসলিগায় স্টুটগার্টের প্রথম টিমে খেলি সে বছরই স্টুটগার্ট চ্যাম্পিয়ন হয় বুন্দেসলিগা!
তা সে যাক। চিঠি বড় ক’রে লাভ নেই। সংক্ষেপসার কথাটা তো আমাদের মতো মিডিও, সেকেন্ড বয়দের জন্যই। ফার্স্ট বয়দের দেশে অন্য বসন্ত আসে। সে টিউলিপের সৌন্দর্যপ্রাপ্তি আমাদের জন্য নহে। ওরা হল এসেন্সিয়াল আমরা হলাম ফাউ।
এহ্, আবার বাজে কথা। তা কাজের কথায় ফিরি। চটপট লিখে ফেলতে হবে। হ্যাঁ যা বলছিলাম, শুনেছিলাম স্পেনের মাদ্রিদের যে বড় ক্লাবটা আছে তার প্রেসিডেন্টের একটা ক্ষ্যাপামি রয়েছে। সে নাকি তার সমর্থকদের সুপারস্টার গিফট করে। এই যেমন দুই রোনালদো, ফিগো, জিদান, বেকহ্যাম, কাকা, ওজিল – তা এদের মাঝে আমি তো ভাই কোনওদিনই সুপারস্টার ছিলাম না।
আমাকে কেন সই করালো বোধ করি মহাকাল জানে! আসলে আমার আজ মনে হয়, আপনাদের যে বিরিয়ানি এলাচ ছাড়া চলে না, ফুটবল গ্রাউন্ডে আমাদের ভূমিকাটাও তেমনই। কেন বললাম, সে কথা না হয় উহ্যই রইল। সব কিছু তো পৃথিবীতে প্রকাশের জন্য থাকে না।
জন্মভূমি ছেড়ে মাদ্রিদ। কষ্ট হতো, মানিয়ে নিলাম। আফটার অল, পেশাদার ফুটবলার। অত দুঃখ-কষ্ট পেলে চলে না। দুর্দান্ত পারফর্ম করেছিলাম তা নিজে মুখে বলতে কোনও লজ্জা নেই। মোরিনহো যাওয়ার পর আন্সেলোত্তির কোচিংয়ে যেবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগটা জিতলাম, তাতে কিছু না হলেও চল্লিশ শতাংশ ভূমিকা আমার।
আমার প্লেয়িং স্টাইলটাই এমন ছিল। বক্স টু বক্স খেলেছি, প্রয়োজনে ডিফেন্সিভ মিডে খেলেছি। যদিও আমার প্রধান পজিশন ছিল সেন্ট্রাল মিড, কিন্তু দরকারে পিভটও করেছি। অ্যাটাকে গোল করেছি – অর্থাৎ আমার টিমকে জেতাতে যা যা করণীয়, একজন মিডফিল্ডার হিসেবে তার সবটাই করেছি। তখনও আমার স্বদেশীয় জুনিয়র ক্রুজ আসেনি মাদ্রিদে। বলা বাহুল্য, নিজের কাজের সুবাদে লোর ডাকে জায়গা পেলাম ব্রাজিল বিশ্বকাপ স্কোয়াডে।
সে রাতের কথা আর কী বলি হে, সে ছিল স্বপ্নের রাত। মায়াবী কবিতায় গাঁথা এক অবিস্মরণীয় রাত। রিওতে শুধুই আমাদের জয়জয়কার! মেসির কান্নাকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে জার্মানবাসীদের গগনভেদী উচ্ছ্বাস। বিশ্বকাপ জিতেছিলাম আমরা। আমার ভাগ্যে ছিল। তবে আমি জার্মান, ভাগ্য-টাগ্যয় অত বিশ্বাস করি না। আমি শুধু জানি, পারফরমেন্স শেষ কথা। আমরা জান লড়িয়ে ছিলাম, দলের প্রায় প্রতিটি ম্যাচের প্রথম একাদশে আমি ছিলাম, জান কবুল করেছিলাম দেশের সনে – ফল পেয়েছিলাম।
ঐ বছরই শহর চেঞ্জ করলাম। বলা ভাল, দেশও বদল করলাম। মাদ্রিদ ছেড়ে গেলাম তুরিনে। জুভেন্টাস, ইতালি। আমরা যারা স্বপ্নের বাগিচায় ফুল ফোটাই ফুটবলকে ঘিরে, কত দেশে দেশে ঘুরে ফেরি করে বেড়াই ফুটবলের স্বপ্নকে – তারা জানি যে দিনের শেষে মানুষ মনে রাখবে আমার খেলাকে। আমাকে মনে রাখবে আমার খেলা দিয়েই। কোনও মানুষকে কি মানুষ এমনি এমনি মনে রাখে?
তবু, আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘ওরা কাজ করে’র শ্রমিকদের মতো। যাদের না আছে তেমন নাম, না লোকে ফ্যান্টাসি করে তাদের নিয়ে। আমাদের কোনও পোস্টার নেই, আমাদের ঘিরে কোনও রং নেই। আমরা দিনশেষে একে অপরের ভালবাসার পাত্র। ফুটবলই আমার এক ও আদি-অকৃত্রিম ভালবাসা। জীবনের রসদ – চিঠি লম্বা করে ফেলছি।
আমাকে আপনাদের মনে আছে? আমি কিন্তু সেই স্যামি খেদিরা, যে আপনাদের প্রিয় ব্রাজিলকে কাঁদিয়েছিল বেলো হরিজেন্টেতে। যে মেসিকেও চোখের জলের সঙ্গী করেছিল। যার পা থেকে ২০১০-র ব্রোঞ্জ মেডেল পরার জন্য জয়সূচক গোল এসেছিল। এই যে, শুনছেন – জানি আপনাদের আমায় মনে নেই। একদিন অবশ্য আমি আপনাদেরই ছিলাম।
জার্মানি সাম্রাজ্যের রাজ্যপাটে অনেক তাবড় নামের ভীড়ে আমার নামটা কেউ কখনও সেভাবে উচ্চারণই করেনি। করেওনা। কেনই বা করবে! বাস্তি আছে, লাম আছে, মুলার আছে, ক্লোসে-পোডলস্কি আছে, কাইজার আছেন, বালাক আছেন, ওদের মাঝে আমি তো এক ভূমিহারা শ্রমিক। জার্মানিকে ভালবেসে, ফুটবলকে ভালবেসে যে তার দিন গত করেছে নীরবে, নি:শব্দেই।
তবু আমি ছিলাম, থাকব… যদ্দিন লোকে মনে-টনে রাখে আর কী!