ভাল ব্যাটসম্যান কিংবা ভাল বোলার – খেলার জন্য এই একটা গুনই যথেষ্ট। সাথে ভাল ফিল্ডিং হলে সেটা বাড়তি পাওয়া। কেউ কেউ আবার বোলিং, ব্যাটিং ও ফিল্ডিং – তিন বিভাগেই থাকেন সমান পারদর্শী। যে কোনো দলে এমন একজন খেলোয়াড় থাকা সৌভাগ্যের ব্যাপার।
তবে, এর বাইরে একজন আছেন যিনি আসলে এসব পরিচয়ের বাইরেও অনেক কিছু করেছেন। তিনি টেল এন্ডারে কার্যকর ইনিংস খেলতেন, কিংবদন্তীতুল্য স্পিনার, দুর্দান্ত ফিল্ডার। খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করে জাতীয় দলের নির্বাচক ছিলেন, ছিলেন দলের ম্যানেজার, এমনকি আম্পায়ার হিসেবেও তিনি কিংবদন্তি। তিনি তো আসলে সুপারম্যান!
তার নাম শ্রীনিবাসরাঘবন ভেঙ্কটরাঘবন। পরিচিত ছিলেন তিনি ভেঙ্কট রাঘবন নামে। ১৯৪৫ সালের ২১ এপ্রিল চেন্নাইয়ে জন্ম এই অফ স্পিনারের। তিনি ভারতের খ্যাতনামা স্পিন চতুষ্টয়ের সদস্য। বাকি তিনজন হলেন – ভগবত চন্দ্রশেখর, বিষান সিং বেদি ও এরাপল্লি প্রসন্ন। ওই সময়ে এই স্পিন আক্রমণ ছিল বিশ্বসেরা।
মাত্র ২০ বছর বয়সে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক ঘটে। দিনটা ছিল ১৯৬৫ সালের ২৭ নভেম্বর। অভিষেক টেস্টে ১০ উইকেট শিকার করে বিরল রেকর্ডের জন্ম দেন। দিল্লীর সেই টেস্টে শেষ পর্যন্ত ১২ উইকেট নেন। তিনি জিম লেকারের পরে দ্বিতীয় বোলার হিসেবে ১১ ব্যাটসম্যানকে আউট করার কৃতিত্ব দেখান।
৫৭ টেস্টের ক্যারিয়ারে ১৫৬ উইকেট নেন। আর দুই হাফ সেঞ্চুরিতে করেন ৭৪৮ রান। তবে, এটা দিয়ে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ হয় না। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিনি ১৪ টি হাফ সেঞ্চুরি আর দু’টি সেঞ্চুরিতে করেন ৬৬১৭ রান।
ক্রিকেট ঐতিহাসিক রামাচন্দ্র গুহ তাঁর ব্যাপারে বলেন, ‘বিখ্যাত স্পিন চতুষ্টয়ের মধ্যে তিনি (ভেঙ্কট) ছিলেন দুর্ভাগ্যবশত সবচেয়ে কম গ্ল্যামারাস (শুধু ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণে, বাকিদের চেয়ে তিনি সুদর্শন ছিলেন)। তাঁর মধ্যে ছিল না বেদির অনবদ্য ফ্লাইট, প্রসন্নর বৈচিত্র আর চন্দ্রশেখরের টার্ন আর বাউন্স।’
সুনীল গাভাস্কার একবার লিখেছিলেন, ‘প্রথম দুই বোলারের (প্রসন্ন ও বেদি) পর আক্রমণে আসতেন ভেঙ্কট। ওর বোলিংয়ে রান নেওয়া শক্ত ছিল। ওর কাজটা ছিল রান আটাকানো, যাতে করে মূল বোলাররা যখন ফিরবেন, তখন যেন উইকেট নেওয়া সহজ হয়।’
সবচেয়ে লম্বা সময়ের টেস্ট ক্যারিয়ার বিবেচনায় নিলে ভেঙ্কট আছেন তিনি। ২৪ বছর একদিনের ক্যারিয়ারে সবার ওপরে আছেন শচীন টেন্ডুলকার। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা লালা অমরনাথের ক্যারিয়ার ১৯ বছরের। আর ভেঙ্কট ১৮ বছর ২১৪ দিন টেস্ট খেলেছেন।
প্রথম শ্রেণিতে তিনি ছিলেন অনবদ্য। ৩৪১ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন। মাত্র ২৪ গড়ে পেয়েছেন ৩৯০ টি উইকেট। মাদ্রাজের হয়ে ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রধান স্টাইক বোলার হিসেবে খেলেন। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তামিলনাড়ুর হয়ে খেলেন। এখন পর্যন্ত রঞ্জি ট্রফিতে ৯৪৫ উইকেট নিয়ে তিনি এই ঐতিহ্যবাহী আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী।
প্রথম শ্রেণিতে তিনি কতটা প্রতাপশালী ক্রিকেটার ছিলেন সেটা বোঝার জন্য একটা তথ্যই যথেষ্ট। তিনি প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটার যিনি ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেট খেলেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৩ অবধি তিনি খেলেন ডার্বিশায়ারের হয়ে।
তাঁর ফিল্ডিংয়ের কথা না বললেই নয়। ক্লোজ-ইন ফিল্ডে তিনি সেই ৪৪ টি ক্যাচ নিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। প্রথম শ্রেণিতে নেন ৩১৬ টি ক্যাচ।
তিনি বিশ্বকাপে ভারতের প্রথম অধিনায়ক। ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপে তাঁর নেতৃত্বেই ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়েছিল ভারত। বিশ্বকাপের ইতিহাসের প্রথম ক্যাচটাও তাঁর তালু-বন্দী হয়। তবে, বিশ্বকাপের ইতিহাসের অন্যতম ব্যর্থ অধিনায়ক ও খেলোয়াড় তিনি। অধিনায়ক হিসেবে দু’টি বিশ্বকাপ খেলেছেন। প্রতিটি ম্যাচে নিজের পুরো ওভারের কোটা পূরণ করেছেন, কিন্তু কখনো কোনো উইকেট পাননি। এই কলঙ্কিত রেকর্ড বিশ্বকাপ ইতিহাসে আর কোনো ক্রিকেটারেরই নেই।
মাঠের জীবন শেষ করেও তিনি ক্রিকেটেই ছিলেন। প্রথমে হলেন জাতীয় দলের ম্যানেজার। ১৯৮৫-৮৬ মৌসুমে তিনি দল নিয়ে যান অস্ট্রেলিয়া সফরে। চার বছর বাদে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেও তিনি ছিলেন ম্যানেজার। ১৯৯১-৯২ মৌসুমে তিনি জাতীয় দলের নির্বাচকের দায়িত্বে ছিলেন। এর আগে ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ – এই তিন বছর তিনি তামিলনাড়ু ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ছিলেন।
খেলোয়াড়ী জীবন শেষে তিনি সবচেয়ে সফল হন আম্পায়ার হিসেবে। ১৯৯০ সালে তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে আম্পায়ারিং শুরু করেন। দুই বছর বাদে তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে আইসিসির ম্যাচ অফিসিয়ালের পদ পান।
১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে তিনি ম্যাচ রেফারি হিসেবে পাঁচটি টেস্ট ও আটটি ওয়ানডের দায়িত্ব পালন করেন। এর তিন মাস পর তিনি আম্পায়ার হিসেবে সুযোগ পান। জয়পুরে ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার ম্যাচে তাঁর অভিষেক হয়, সেটা ছিল ওয়ানডে।
কিছুদিন বাদেই, তিনি ইডেন গার্ডেন্সে ভারত ইংল্যান্ডের ম্যাচে টেলিভিশন আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার মধ্য দিয়ে টেস্ট আম্পায়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। শ্রীনিবাস ভেঙ্কটারাঘভন খুব দ্রুতই আইসিসির এলিট প্যানেলে চলে আসেন। তিনি নিজের সময়ে বেশ সমাদৃত আম্পায়ার ছিলেন। কখনও কখনও বিতর্কিতও ছিলেন।
শ্রীনিবাস ভেঙ্কটারাঘভন আম্পায়ার হিসেবে ৭১ টি টেস্ট ম্যাচ পরিচালনা করেন। সাথে করেন ৫১ টি ওয়ানডে। ১৯৯৬ ও ১৯৯৯ – দু’টি বিশ্বকাপ আসরের সেমিফাইনালে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ছিলেন ১৯৯৯ বিশ্বকাপের টেলিভিশন আম্পায়ারের দায়িত্বেও।
২০০৩ সালে তিনি ওয়ানডে ছাড়েন। পরের বছরই টেস্ট ছেড়ে দেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আইসিসির আম্পায়ার প্যানেলের এলিট ক্লাবের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিই ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তিত্ব তিনি খেলোয়াড় ও আম্পায়ার দুই ভূমিকাতেই ৫০ টি করে টেস্টে অংশ নিয়েছেন। এজন্যই তিনি ক্রিকেট ইতিহাসে অনন্য!