Social Media

Light
Dark

নিখাঁদ ব্যাটের নিষ্ঠুর নিয়তি

১৯৮৯ সালে পাকিস্তান সফর শেষে ফিরার সময় ভারতের নতুন দুই ব্যাটসম্যানকে সুনীল গাভাস্কার বলেছিলেন ‘ভয়ংকর জোড়া’। তাঁদের একজন পরবর্তীকালে বিশ্বক্রিকেটের অন্যতম সেরা শচীন টেন্ডুলকার। তবে অন্যজনকে নিয়ে আশা ছিল শচীনের চেয়েও বেশি। তাঁর নিখুঁত টেকনিক দিয়ে হতে পারতেন বিশ্বসেরাদের একজন।

তবে এখন কমেন্ট্রি বক্সের পরিচিত নাম সঞ্জয় মাঞ্জরেকার আসলে নিজের প্রতিই সুবিচার করতে পারেননি।

তাঁর বাবা বিজয় মাঞ্জরেকার ছিলেন দু:সাহসী এক ব্যাটসম্যান। ১৯৫০ এর দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসারদের বাউন্সারকে রীতিমত ছেলে খেলা বানিয়ে ফেলেছিলেন ভারতের কিংবদন্তি এই ব্যাটসম্যান। বাবার মতই ব্যাট হাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসারদের তুলোধুনো করবেন এমনটাই আশা ছিল।

অথচ সঞ্জয় মাঞ্জরেকার কিনা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে বাউন্সার খেলতে পারলোনা। শুধুমাত্র বিজয় মাঞ্জরেকারের ছেলে বলেই হয়তো এই বিষাক্ত তীরগুলো ছুটে এসেছিল তাঁর দিকে। তবে দ্রুতই তিনি প্রমাণ করেছিলেন নিজের অস্তিত্ব। তিনি যে অন্য মানুষ, অন্য এক ব্যাটসম্যান।

বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে তিনটি সেঞ্চুরি করার পর হঠাৎই রঞ্জি ট্রফিতে সুযোগ পান সঞ্জয় মাঞ্জরেকার। রঞ্জি ট্রফির প্রথম ম্যাচেই দারুণ পারফর্ম্যান্স করলে ওই মৌসুমে আর খুব একটা ধারাবাহিক হতে পারেননি। তবে ১৯৮৬-৮৭ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সেঞ্চুরির দেখা পান এই ব্যাটসম্যান। তখনই তাঁর টেকনিক দিয়ে ঝড় ফেলে দিয়েছিলেন।

ফলে ভারত অনুর্ধব-২৫ দলের হয়ে পাকিস্তান সফরের জন্য ডাক পান তিনি। সেখানে ওয়াসিম আকরাম, জাকির খানদের বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসেই করেন ১২৮ রান। ওই ইনিংসে পর ভারতের গনমাধ্যমগুলো তাঁকে নিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল।

তাঁদের মতে এর আগে কখনো কোনো ব্যাটসম্যানকে এমন সোজা ব্যাটে, এত নিখুঁত ভাবে খেলতে দেখেননি কোনো ব্যাটসম্যানকে। ওদিকে ১৯৮৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ইনজুরির কারণে ছিটকে গিয়েছিলেন মহিন্দার অমরনাথ ও মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন।

ফলে প্রথমবারে মত ভারত দলে ডাক আসে সঞ্জয় মাঞ্জরেকারের। দিল্লিতে প্রথম ইনিংসে ভারত অল আউট হয়ে গিয়েছিল মাত্র ৭৫ রানেই। সেখানে সঞ্জয় করেছিলেন ৫ রান। দ্বিতীয় ইনিংসেও ৮২ রানে চার উইকেট হারিয়ে ফেলে ভারত।

সেই সময় অধিনায়ক দীলিপ ভেঙসরকারের সাথে জুটি গড়তে থাকেন সঞ্জয়। প্রায় দেড় ঘন্টা ব্যাট করে ৬৩ বলে করেছিলেন ১০ রান। তখনই হঠাত একটু বাউন্সার এসে সঞ্জয়ের হেলমেটে আঘাত করে। বাঁ চোখে চোট পেয়ে রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে ফেরেন এই ব্যাটসম্যান। ক্রিকেট ইতিহাসের ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেক ম্যাচেই রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে ফেরেন তিনি।

দ্বিতীয় টেস্টে অমরনাথ ও আজহারউদ্দীন ফিরে এসে দলে জায়গা হারান সঞ্জয়। তবে রঞ্জি ট্রফিতে রানের ফোয়ারা ফুটতে থাকে তাঁর ব্যাট থেকে। ফলে ১৯৮৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে আবার দলে ডাক পান তিনি।

কার্টলি অ্যামব্রোস, কোর্টনি ওয়ার্লশ ও ইয়ান বিশপদের বিধ্বংসী সেই বোলিং লাইন আপের বিরুদ্দে ৬৮ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলে ভারত। তবে নিজের জমাট টেকনিক দিয়ে সেদিন ১০৮ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন তিনি।

ওই সিরিজে আরো কয়েকটি ভালো ইনিংস এসেছিল তাঁর ব্যাট থেকে। ফলে সহজেই পাকিস্তান সফরের জন্য দলে জায়গা পেয়ে যান তিনি। এছাড়াও দলে তখন নতুন যোগ হয়েছে ১৬ বছরের এক কিশোর শচীন টেন্ডুলকার।

পাকিস্তানে রীতিমত রানের ফোয়ারা খুলে বসেছিলেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার। প্রথম টেস্টে করাচিতে খেলেন ১১৩ রানের ইনিংস। দ্বিতীয় টেস্টে শচীন টেন্ডুলকারের সাথে ১৪৩ রানের জুটি গড়েন সঞ্জয়। লাহোরে তৃতীয় টেস্টে পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি।

প্রায় সাড়ে নয় ঘন্টা ব্যাট করে খেলেছিলেন ২১৮ রানের সেই ইনিংস। শেষ টেস্টেও ৭২ রানের একটি ইনিংস খেলেন তিনি। এই সিরিজ শেষেই শচীন ও সঞ্জয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন সুনীল গাভাস্কার। অনেকে সঞ্জয়ের টেকনিককে তুলনা করছিলেন স্বয়ং সুনীল গাভাস্কারের সাথে। ভাবা হচ্ছিল পরবর্তী দশকে ভারতের ব্যাটিং লাইন আপের স্তম্ভ হবেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার।

তবে সেই স্বপ্ন দিনদিন দিবা স্বপ্নে পরিণত হতে লাগলো। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের ব্যাটের ধাঁর ধরে রাখতে পারলেন না সঞ্জয়। ক্যারিয়ারে প্রথম ৯ টেস্টে ৬০.৩০ গড়ে ৭৮৪ রান করা সঞ্জয় আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে লাগলেন।

ক্যারিয়ারের পরের ২৮ টেস্টে মাত্র ২৯ গড়ে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ১২৫৯ রান। এছাড়া ৭৪ ওয়ানডে ম্যাচ খেলে করেছিলেন ১৯৯৪ রান। ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সমাপ্তি ঘটে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের।

অথচ, এখন কমেন্ট্রি বক্সে ঝড় তোলা সঞ্জয় মাঞ্জরেকারের হওয়ার কথা ছিল ভারত এমনকি বিশ্বক্রিকেটের সেরাদের একজন। তবে ক্রিকেট বিশ্ব এমনকি নিজেকেও বঞ্চিত করে সঞ্জয় মাঞ্জরেকার রেখে গেছেন জমাট টেকনিকের অনন্ত আক্ষেপ।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link