১৯৭১ সালের অ্যাশেজ! ব্রিসবেন-পার্থে প্রথম দুই টেস্টে বিরক্তিকর ড্রয়ের পরে মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্ট ভেঁসে গেল বৃষ্টিতে। সেই মেলবোর্নেই চতুর্থ টেস্টে প্রথম দু’দিনও নষ্ট হল বৃষ্টিতে। ততক্ষনে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ডের পঁচিশ হাজার পাউন্ড লোকসান হয়ে গিয়েছে। তৃতীয়, চতুর্থ দিনেও যখন একটি বলও গড়াল না, সবাইকে অবাক করে দিয়ে পঞ্চম দিনে ফকফকা রোদ আর সঙ্গে উপরিপাওনা উপচে পড়া দর্শক!
অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত এক ‘ভদ্রলোক’ মেলবোর্নের প্রেস বক্সের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসে সাংবাদিকদের সামনে ঘোষণা করলেন, ‘এই টেস্টও পরিত্যক্ত হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। দর্শকদের কথা ভেবে দু’দলের মধ্যে একটি ওয়ানডে ম্যাচ করার কথা আমরা ভেবেছি।’ সঙ্গে সঙ্গে অফিশিয়ালি সেটাই হয়ে থাকল প্রথম এক দিনের ম্যাচ। তখন কে ভাবতে পেরেছিল, এক দিন সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস হয়ে উঠবে এই ওয়ানডে ক্রিকেটই!
সেই এক দিনের ম্যাচ দেখতে মেলবোর্নে ৪৬ হাজার লোক এসেছিল। গোটা সিরিজ মিলিয়ে যে জমায়েত দেখা যায়নি। আর মেলবোর্নের সিঁড়ি বেয়ে প্রেস বক্সে উঠে আসা সেই ভদ্রলোক?
– স্যার ডন ব্র্যাডম্যান!
সেদিন ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা কিংবদন্তির হাতে শিশু হিসেবে আচমকা জন্ম নিয়েছিল ‘ওয়ানডে ক্রিকেট’, শৈশব কৈশোর পেরিয়ে ওয়ানডে এখন ক্রিকেট সূচির অবিচ্ছেদ্য অংশ!
ঠিক তার পরের বছর, ১৯৭১ সালে যখন অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডে গেল, ষষ্ঠ টেস্ট আর রাখা হল না। তার জায়গায় স্থান পেল তিনটি ওয়ান ডে ম্যাচ। ১৯৭৫-এ হল প্রথম বিশ্বকাপ। মেলবোর্নে হঠাৎ করে আয়োজিত সেই প্রথম স্বীকৃত ওয়ান ডে ম্যাচের অধিনায়ক বিল লরি পরে বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়, ব্র্যাডম্যান ওয়ান ডে ম্যাচটা করার কথা ভেবেছিলেন স্রেফ পয়সা তোলার কথা ভেবে। ওই ব্যাপারটা উনি খুব ভাল বুঝতেন!’
টাকার ব্যাপারটা ভালো বুঝতেন কিনা জানা নেই, তবে বিচক্ষণ ডন ব্র্যাডম্যান সময়ের ডাক বুঝতে দেরি করেননি এটা মানবেন যে কেউ। ক্রিকেটের বিবর্তনের শুরুটাও তাই ক্রিকেটের সেরার হাত ধরেই।
ক্রিকেট কিসের খেলা? এমন সহজ প্রশ্নে অনেক ডিপ্লোম্যাটিক উত্তর খুজে পাওয়া যায় প্রায়শই! কেউ কেউ বলেন মাইন্ড গেম, কেউ বলেন টিম স্পিরিট। কেউ ব্যাখ্যা করেন মাঠের মধ্যে লড়াইয়ের মাধ্যমে। তবে দিনশেষে সকল মাইন্ড গেম, ট্যাকটিক্স, টিম স্পিরিট আশ্রয় নেয় একই মেরুতে- “রান”! ক্রিকেটে জয়-পরাজয়-শ্রেষ্ঠত্বের চাবিকাঠি একটাই- রান! তাই স্বাভাবিকভাবেই অনেকে ক্রিকেটকে বলে থাকেন ব্যাটসম্যান গেইম!
যার ফলে খেলাটার একক শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্ন উঠলে স্বাভাবিকভাবেই আসবে ব্যাটসম্যানদের নাম। প্রসঙ্গ সেটা না, আমার লেখার বিষয়বস্তুও শ্রেষ্ঠত্ব খোঁজা না, আমার লেখায় যারা পরিসংখ্যান খুঁজবেন তাদের এক বুক হতাশা ছাড়া আর কিছুই দেওয়ার নেই আমার! শ্রেষ্ঠত্বের যেসব মানদণ্ড ধরা হয় তাতে সেসব যোগ্যতা পেরিয়ে অসম্ভবে পৌঁছেছেন ডন! নামের মতোই বাইশ গজ কিংবা বাইশ গজের বাইরেও তিনি ছিলেন ডন!
নামের মতো কাজেও ছিলেন ডন! আর একজন ডন কখনোই দায়িত্ববোধকে অবজ্ঞা করেন না। ১৯৩৬-৩৭ মৌসুমের অ্যাশেজের ঘটনা। একদিন পরেই অ্যাডিলেড টেস্ট শুরু। সন্ধ্যা পর্যন্ত বিল ও’রিলি ও নেভিল কার্ভাসের সঙ্গে আলোচনা করেন ম্যাচের পরিকল্পনা নিয়ে। মর্যাদার লড়াইয়ে কিছুতেই হারা যাবে না ইংল্যান্ডের কাছে! দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অধিনায়ক ব্র্যাডম্যান রাত এগারোটার দিকে বাড়ি ফেরার সময় হাসপাতালের সামনে গাড়ি থামিয়ে তাদের বললেন, ‘ছোট্ট একটা কাজ আছে!’
তারপর হাসপাতাল থেকে দ্রুত ঘুরে বেরিয়েও এলেন। খুবই স্বাভাবিক ব্র্যাডম্যান। কাউকে কিছুই বুঝতে দিলেন না। পরের দিন সবজায়গায় পাওয়া যায়, ব্র্যাডম্যানের সন্তানের মৃত্যু সংবাদ! এতটা দায়িত্ত্ববোধ আয়ত্ত করেছেন বিধায় তিনি হয়েছেন ডন!
ব্র্যাডম্যানের ক্যারিয়ার তখন মধ্যগগনে। পৃথিবীতে ততদিনে বেজে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা ! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ করেননি ডন। তবুও যুদ্ধের ময়দানে উচ্চারিত হয়েছিল তার নাম! ১৯৪৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে যুদ্ধ। ইটালির মন্টে ক্যাসিনো আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে মিত্রবাহিনী, শুধু একটি সংকেতের অপেক্ষা। সেটি হলো, ‘ব্র্যাডম্যান ব্যাটিং টুমরো।’ মানে বার্তাবাহক এই সঙ্কেত নিয়ে এলেই আক্রমণ করবে মিত্রবাহিনী! সমস্যা করলো আবহাওয়া। আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে সংকেত এলো ‘ব্র্যাডম্যান নট ব্যাটিং।’
প্রায় তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেল। এই সময় গোপন সংকেতের মাধ্যমে ভেসে এলো সেই বার্তা। অবশেষে ব্যাট করতে নামছেন ব্র্যাডম্যান!
যুদ্ধে কী হলো তা জানা নেই, জানার প্রয়োজনও নেই। তবে এ গল্প থেকে বোঝা যায়, ব্র্যাডম্যান ছিলেন এমনই একজন, যিনি না থেকেও ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। ডন ছিলেন সবখানেই!
নেলসন ম্যান্ডেলাকে চেনে না এমন কেউ নেই বোধহয়! টানা ২৭ বছর কারাবন্দী ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। কারাভোগের ২২তম বছরে, ১৯৮৬ সালে তার সাথে দেখা করতে যান তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম ফ্রেজার। আলাপকালে ফ্রেজারকে আচমকা ভিন্ন এক প্রশ্ন করে বসেন ম্যান্ডেলা, ‘মি. ফ্রেজার, ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান কি এখনও বেঁচে আছেন?’
এই ঘটনার ৭বছর পরে আবার দেখা হয় তাদের। তখন আর বন্দী অবস্থায় ছিলেন না ম্যান্ডেলা। ফ্রেজার তাকে ব্র্যাডম্যানের অটোগ্রাফ সম্বলিত একটা ব্যাট উপহার দেন। সেখানে লেখা ছিল,
‘নেলসন ম্যান্ডেলার দুর্দান্ত অসমাপ্ত ইনিংসের স্বীকৃতিস্বরূপ।
– ডন ব্র্যাডম্যান’
সাত সংখ্যাটা ম্যান্ডেলার জন্য লাকি নাম্বার, কেননা ফ্রেজারের সঙ্গে সাক্ষাতের সাত বছর পর সেই বিখ্যাত উপহার পেয়েছিলেন তিনি। সেভেনকে আসলেই ধরা হয় লাকি নাম্বার হিসেবে, সেজন্যই উপমা আছে, “লাকি সেভেন”! তবে সাত ডনের কাছে হয়তো কখনোই লাকি নাম্বার ছিল না।
ব্র্যাডম্যানের ক্যারিয়ারের সর্বমোট রান ৬৯৯৬। চার রানের জন্য ছোয়া হয় নি সাত হাজারের ল্যান্ডমার্ক! সঙ্গে সঙ্গে ছোয়া হয় নি গড়ের একশও ! ‘লাকি-সেভেন’ কথাটা ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে যায় না আরেকটি কারণেও, কেননা ক্রিকেটের এই মহানায়ক তার ক্যারিয়ারে শূন্য রানে আউট হয়েছেন কতবার জানেন? -সাতবার!
ক্রিকেটের সেরাদের প্রশ্ন উঠলে সেই লিস্টে থাকবে তার নামও। তিনি শচীন টেন্ডুলকার। সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি কিংবা টেস্ট-ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক নয়, টেন্ডুলকারের জন্য সব থেকে বড় প্রাপ্তি ব্র্যাডম্যানের তাঁর ব্যাটিং নিয়ে মন্তব্য। এক সময় তিনি বলেছিলেন, শচিনের ব্যাটিং স্টাইল দেখে নাকি তাঁর নিজের কথাই মনে পরে।
ব্র্যাডম্যান শচিন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি টিভিতে ওর খেলা দেখেছি এবং ওর টেকনিকে আটকে গিয়েছি, তাই আমার স্ত্রীকে ডেকে বলি ওর খেলা দেখতে। এখন আর আমি নিজেকে খেলতে দেখি না। কিন্তু আমার মনে হয়, এই প্লেয়ারটি অনেকটা আমার মতো খেলে। এবং আমার স্ত্রী টিভিতে শচীনের খেলা দেখে বলল, হ্যাঁ, দু’জনের মধ্যে মিল আছে, অনেক মিল আছে।’
ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে শচীনকে নিয়ে আরো একটি মিথ প্রচলিত আছে, ১৯৯৮ সালের দিকে ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে দেখা করেন টেন্ডুলকার। ব্র্যাডম্যানকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি এখন ক্রিকেট খেললে আপনার গড় কত হতো?’
-৭০!
– শুধু সত্তর কেনো? এর থেকে বেশি কেন নয়?
– একজন নব্বই বছরের ব্যক্তির সত্তর গড়ই মানানসই নয় কি?
এমনই হাস্যরসিক ছিলেন ব্র্যাডম্যান!
ডিজনির একটা বিখ্যাত কার্টুন সিরিজ আছে ডোনাল্ড ডাক! কার নাম অনুসারে কার্টুনটির নাম হয়েছে জানলে চোখ কপালে উঠে যেতে পারে। ডন ব্র্যাডম্যান ছিলেন এই নামের পেছনের চরিত্র!
অস্ট্রেলিয়ার সমস্ত প্রদেশ এবং প্রদেশের রাজধানীতে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটবোর্ডের যে অফিস আছে সব অফিসের পোস্টঅফিস নাম্বার ৯৯৯৪। কেন জানেন?
স্যার ডনের ব্যাটিং গড় ৯৯.৯৪ এর সম্মানে এই নাম্বার।
অস্ট্রিয়ার সাবেক ফর্মুলা ওয়ান নিকি লাউডা প্রতিষ্ঠা করেন লাউডা এয়ারলাইন্স। সেই এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমানের নাম ছিল, ‘স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান!’
ডনের ছোয়া পাওয়া যায় বায়োলজিতেও! ডালিয়া ফুলের একটা বিশেষ জাতের নামকরণ করা হয়েছে স্যার ডনের নামানুসারে।
১৯৪৮ সালের ভারতের কাঠিয়াওয়ার নামক জায়গার এক আঞ্চলিক দলের সাথে ক্রিকেট খেলছিলো মহারাষ্ট্রের দল। সেই খেলায় নিম্বলকর নামক এক ব্যাটসম্যান যখন ৪৪৩ রানে অপরাজিত তখন দুই দল এবং আম্পায়ার মিলে সেই ম্যাচটি আর না খেলার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মনে করছিলো স্যার ডনের রেকর্ড অতিক্রম করাটা উচিত হবে না।
এই ধরণের কাজ আরেকবার করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক মার্ক টেলর। কোন এক টেস্টে ৩৩৪ রানে তিনি যখন অপরাজিত, তখন তিনি আর ব্যাট না করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরও মনে হয়েছিল, ‘স্যার’কে অতিক্রম করাটা উচিত হবে না।
উল্লেখ্য, প্রথমশ্রেণীর এবং টেস্ট ক্রিকেটে স্যার ডনের সর্বোচ্চ সংগ্রহ যথাক্রমে ৪৫২ এবং ৩৩৪!
বাইশ গজে কখনো নার্ভাস নাইন্টিজের আক্ষেপে পুড়তে হয় নি ডনকে। তবে জীবনে দুইবার নার্ভাস নাইন্টিজের আক্ষেপে পুড়িয়েছেন ক্রিকেট বিশ্বকে! ব্র্যাডম্যানের প্রসঙ্গ আসলেই যে বিষয় চলে আসে, সেই মহাকাব্যিক গড় ছিল ৯৯.৯৪! প্রথমবার নার্ভাস নাইন্টিজের আগুনে ঘি তার জীবনের শেষ মুহূর্তে। কেননা ৯২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আক্ষেপের আগুন দাউ দাউ করে জ্বালান ব্র্যাডম্যান! হয়তো সেই কারণেই এত আলোচিত ব্র্যাডম্যান। নাহলে তিনি যে হতেন ‘পারফেক্টলি পারফেক্ট!’ পারফেক্টলি পারফেক্ট শুধু একজনই, ওই উপরে যিনি বসে আছেন!