ম্যাচের আগে থেকেই চলছিল যতসব জল্পনা-কল্পনা। কেনই বা চলবে না, একদিকে ইতালিয়ান লিগে ত্রাস করে বেড়ানো আতালান্তা, অন্যদিকে চোটজর্জর রিয়াল মাদ্রিদ।
জিদানের সামনে ঝুলছে বহিষ্কার হওয়ার খড়্গ। দিন ভালো যাচ্ছে না লা লিগায়। আর কোপা দেল রেকে তো বিদায়ই বলে দেওয়া হয়েছে আগে। এমনকি অবশ্যম্ভাবী একটা ট্রফিও হাতছাড়া হয়েছে রিয়ালের হাত থেকে। সবদিকে আতালান্তা যখন শিখরে, রিয়াল তখন শূন্যে। কিন্তু কথায় আছে, ‘ওস্তাদের মার শেষ রাত্রে’।
চ্যাম্পিয়নস লিগের নক-আউট স্টেজের প্রথম লেগের শেষরাতে সেটাই যেন করে দেখালো রিয়াল মাদ্রিদ। কীভাবে সম্ভব হলো স্ট্যাটিস্টিক্যালি ইতালিয়ান লিগের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দলের বিপক্ষে রিয়ালের জয়?
আন্দ্রে লুনিন, ডিয়েগো অ্যালটিউব, সার্জিও আরিব্বাস, ভিক্টর ক্রাস্ট, অ্যান্তোনিও ব্লাংকো, হুগো দুরো, মিগুয়েল ওর্তেগা; নামগুলো শুনে ভড়কে যাওয়ার মতো অবস্থা হতে পারে আপনার। এমনকি পাড় রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদেরও। অথচ এরাই গতকাল ছিল জিদানের বেঞ্চে। ঘুনাঘরেও নাম না শোনা এই খেলোয়াড়ের মধ্যে লুনিন বাদে কেউই জিদানের খেলোয়ার নন। এরা বরং রাউলের খেলোয়াড়। রিয়াল মাদ্রিদের যুব দল কাস্তিয়া থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অতালিতে। কারণ রিয়ালের বেঞ্চে জায়গা করে নেওয়ার মতন কোনো খেলোয়াড় আর বাকি নেই।
দলের অধিনায়ক, সহ-অধিনায়ক, এমনকি তৃতীয় অধিনায়ক বেনজেমা পর্যন্ত দলের বাইরে চোটের কারণে। আঙ্গুলগুনে মূল দলের ২৫ জনের মধ্যে ১০ জনই মাঠের বাইরে চোট নিয়ে। তবুও ৮৬ মিনিটে ফেরল্যান্ড মেন্ডির দূরপাল্লার শট থেকে মূল্যবান অ্যাওয়ে গোল আর জয় নিয়ে ফিরে রিয়াল মাদ্রিদ। মুখে বলতে যতটা সোজা লাগছে, ইঞ্জুরি জর্জর রিয়ালের জন্য ম্যাচটা মোটেই সহজ ছিল না।
চোটজর্জর দলের অ্যাভেইলেবল সকল খেলোয়াড় নিয়েই জিদান সাজিয়েছিলেন তার একাদশ। দলে গত তিন ম্যাচ ধরে ভরসার পাত্র হয়ে থাকা নাচো-ভারানের সাথে ছিলেন মেন্ডি আর ভাজকেজ। টিপিক্যাল ৪-৩-৩ ফরমেশন থেকে সরে এসে খেলেছেন ৪-৩-১-২ ফরমেশনে, যেখানে ইসকো ছিলেন ‘ফলস নাইন’। বলা বাহুল্য ২০১৭-১৮ মৌসুমে ইসকোকে ফলস নাইন খেলিয়ে বেশ অনেক ম্যাচ বের করে এনেছিলেন জিদান। ফর্ম চলে গেলেও ওল্ড গার্ডের উপর ভরসা ছিল ঠিকই। অ্যাসেন্সিও আর ভিনিসিয়ুসকে সাহায্য করার জন্য তো দুই উইংব্যাক ছিলই।
আতালান্তাও দল সাজিয়েছিল তাদের পরিচিত ৩-৪-১-২ ফরমেশনে। যদিও খুবই অপরিচিত একটা ফরমেশন। কিন্তু এই ফরমেশনেই সাফল্য পেয়েছেন কোচ জিয়ান পিয়েরো গাসপিরিনি। রিয়ালের বিপক্ষেও ইয়ত্যার নড়চড় হয়নি। নিজেদের নিয়মিত স্ট্রাইকার পাপু গোমেজ দল ছেড়েছেন কোচের সাথে ঝগড়া করে, অনেকেই ভেবেছিলেন আতালান্তার খেলায় প্রভাব পড়বে। কিন্তু গাসপিরিনি সামলেছেন দারুণভাবে।
গাসপিরিনি শুরুও করেছিলেন দারুণভাবে। ম্যাচের প্রথমে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণও নিয়ে ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু ম্যাচের ১৭ মিনিটেই মেন্ডির একটি আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে বাজে ফাউল করে বসেন ফ্রয়েলার। সঙ্গে সঙ্গেই লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেওয়া হয় তাকে। ফলে হুট করেই ১০ জনের দলে পরিণত হয় আতালান্তা। আর গাসপিরিনির ট্যাক্টিসের বিপক্ষে সাজানো জিদানের ট্যাক্টিস কাজে লাগতে শুরু করে। সাথে ১০ জন হয়ে যাওয়া আতালান্তাও চলে যায় ব্যাকফুটে। মূলত অ্যাটাকিং মিডে খেলা মাত্তেও প্যাসেনি সাহায্য করতেন দলের ফ্লুয়েডিটি বজায় রাখতে। তাকে পেছন থেকে ব্যাক-আপ দিতো চার মিডফিল্ডার। কিন্তু ফ্রয়েলার লাল কার্ড দেখায় ডিফেন্সিভ ডিউটিতে মনোযোগ দিতে হয় তাকে। ফলে ভেঙ্গে পরে আতালান্তার আক্রমণভাগ। এছাড়াও ইসকোকে ফলস নাইনে খেলানোর কারণে রিয়ালের মিড ট্রিও ক্রুস-ক্যাসেমিরো-মদ্রিচও পেয়ছে স্বাধীনভাবে খেলার সুযোগ। সবসময় বল প্রোভাইড না করে ব্যাক্তিগত নৈপুণ্য প্রকাশের সুযোগও পেয়েছেন।
যদিও দশ জনের আতালান্তাকে ভাঙ্গতে ৮৬ মিনিট লেগেছে রিয়াল মাদ্রিদের, সেটা সম্পূর্ণই রিয়ালের অ্যাটাকিং লাইন-আপের ব্যর্থতার কারণে। পুরো ম্যাচজুড়ে ভিনিসিয়ুস আর অ্যাসেন্সিও দৃষ্টিকটু মিস, ভুল পাস ত্যক্ত করেছে রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদেরও। শেষদিকে জিনেদিন জিদান পুরো আক্রমণভাগই তুলে নিয়েছেন মাঠ থেকে, নামিয়েছেন নতুন ত্রয়ী মারিয়ানো-আরিব্বাস-দুরো। কিন্তু শেষমেশ ডিফেন্সের চিড় ধরতে পেরেছেন লেফট ব্যাক মেন্ডি। রিয়াল মাদ্রিদের লেফট ব্যাকদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন অসাধারণ আউট অফ দ্যা বক্স শট থেকে। রবার্তো কার্লোস, মার্সেলোদের যোগ্য উত্তরসুরি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে আরেকধাপ এগিয়ে গেলেন যেন ফেরল্যান্ড মেন্ডি।
রিয়ালের আক্রমণ যদি ঘুমিয়ে থাকে, তবে তার সম্পূর্ণ বৈপরীত্য ছিল রিয়ালের ডিফেন্সে। গত দুই মৌসুমে রামোসবিহীন রিয়ালের ডিফেন্স ছিল দেখার মতন। একবার আয়াক্স, অন্যবার ম্যানচেস্টার সিটি; রামোসবিহীন রিয়ালের ডিফেন্স যেন ছিল ‘অমাবস্যার চাঁদ’ কিন্তু এই ম্যাচে যেন রিয়ালের ডিফেন্স ছিল অনন্য। ভারানে-নাচো জুটি চার ম্যাচ ধরে রেখেছেন ক্লিনশিট। ভাজকেজের মতন মেইক-শিফট রাইটব্যাক দিয়েই খেল দেখিয়েছেন। এমনকি গোলকিপার কোর্তোয়াও লিখেছেন, এমন শান্তির ম্যাচ আমি খুব কম খেলেছি।
পুরো ম্যাচে আতালান্তা মাত্র একবার শট নিতে পেরেছে গোলমুখে। চারজনের ডিফেন্সকে ভাঙতে দেখা গিয়েছে খুব কম সময়েই। যখন ওভারল্যাপ করে এগিয়েছেন দুই উইংব্যাক, নেমে এসেছেন ক্যাসেমিরো। আর আক্রমণে ইসকো খেলেছেন ফলস নাইন হিসেবে। আতালান্তার ডিফেন্স আর মিডলাইনের ঠিক মাঝ বরাবর খেলা চালিয়েছেন তিনি। যদিও ম্যাচে বলার মতন কিছু করে দেখাতে পারেননি, কিন্তু আতালান্তাকে ঠিকই বিচলিত করতে পেরেছেন। ম্যাচের শেষমুহুর্তে ইসকোর জায়গায় নেমে খেল দেখিয়েছেন আরিব্বাস। আর সেই সাথে সেই ফাঁকা দিয়েই মূল্যবান গোল বের করে নিয়েছে রিয়াল।
দশ জনের আতালান্তাকে উড়িয়ে দিতে পারেনি রিয়াল মাদ্রিদ। একমাত্র গোলটাও এসেছে কষ্টে-শিষ্টে। লাল কার্ড নিয়েও আঙ্গুল তুলেছেন প্রতিপক্ষ কোচ। কিন্তু জিদানের উত্তর সোজাসাপ্টা, ‘আমি জয় নিয়ে ভাবি। কীভাবে জয়টা এল, সেটি আমার বিষয় নয়। আতালান্তার বিপক্ষে শেষ পর্যন্ত আমরা জিতেছি, এটিই বড় কথা। তবে এটা ঠিক, ম্যাচে আমরা মোটেও ভালো খেলতে পারিনি।’
জিদানের শেষমুহুর্তের হাসি অবশ্য সে কথা বলেনি। জিদান ভালোভাবেই জানতেন, এভাবে জিতে ফেরত আসা কম কঠিন কার্য নয়। কিন্তু জিদানের ওল্ড গার্ড আর নতুন খেলোয়াড়; সবাই মিলে জিদানকে যে জয় এনে দিয়েছে, তা রিয়ালের অবশ্যই প্রাপ্য।
এমন দিনেও রেকর্ড গড়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। প্রথম ও একমাত্র দল হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগে নক-আউট পর্বে ১০০ ম্যাচ খেলার রেকর্ড রিয়াল মাদ্রিদের। কোচ হিসেবে জিনেদিন জিদানের রেকর্ডের অভাব নেই। খেলোয়াড়-কোচ, মাঠের আশেপাশে থাকলেই যেন রেকর্ড নিজে এসে লুটিয়ে পরে তার পায়ে। জিনেদিন জিদান মানুষটা এমনই। আজকের এই জয় রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা জিনেদিন জিদানের ক্যারিয়ারে বড় করে লিখে রাখার মতন কিছুই না। কিন্তু জিনেদিন জিদান নিজের হৃদয়ে এই ম্যাচটাকে খুব ভালোভাবেই স্মরণে রাখবেন। মূল একাদশের ডিফেন্স-অ্যাটাক ছাড়া যেভাবে ভঙ্গুর রিয়াল মাদ্রিদকে শুধুমাত্র নিজের ট্যাক্টিসের জোরে ইতালি থেকে জিতে ফিরলেন, তাতে জিদানের একটা বাহ্বা প্রাপ্যই।