বিচিত্র সমস্যার বলি বিরল প্রতিভা

একটা সময় বাংলাদেশের বড় বড় ক্রিকেট প্রতিভারা আসতেন চট্টগ্রাম থেকে। সেই ধারাবাহিকতায় এসেছিলেন তিনিও। কিন্তু, কিছু বিচিত্র ও ভূতুড়ে সমস্যা ছিল তাঁর।

দক্ষিণ আফ্রিকান পেসার মরনে মরকেলকে খেলতে সমস্যা হতো! অস্ট্রেলিয়ান পেসারদের খেলতেও ভয় পেতেন। একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন টিভিতে খেলা দেখালে নার্ভাস থাকতেন তিনি, পেস বোলারদের মোকাবেলা করতে মূলত ভয়ে থাকতেন!

অথচ, এক সময়ে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশেরই শুধু নয়, বিশ্বের সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের মালিক ছিলেন তিনি। সেটাও আবার পাকিস্তানের মোহাম্মদ আসিফ, শোয়েব আখতারদের পিটিয়ে। সেই তিনিই আবার এশিয়া কাপ ফাইনালে স্লথ একটা ইনিংস খেলে দুর্ভাগ্যের কারণ হন দলের জন্য। তিনি হলেন নাজিমউদ্দিন।

মাত্র ১৬ বছর বয়সেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় নাজিমউদ্দিনের। এরপর অনূর্ধ্ব-১৯ ও বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে খেলার জন্য ডাক পান তিনি। ২০০৭ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তাঁর। মূলত চমকপ্রদ ব্যাটিং প্রতিভার কারণেই নির্বাচকদের নজর কাড়তে সক্ষম হন তিনি।

দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ২০০৭ বিশ্বকাপের দলেও জায়গা পান এই ডান হাতি ওপেনার। এরপর পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮১ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে চমক লাগিয়ে দেন তিনি। তৎকালীন সময়ে টি-টোয়েন্টিতে সেটিই ছিল যে কোনো ওপেনারের সেরা ইনিংস। যদিও, নয় দিনের মধ্যে সেঞ্চুরি করে সেই রেকর্ড ভাঙেন স্বয়ং ক্রিস গেইল। মূলত ওই ৮১ রানের ইনিংসটির জন্যই ক্রিকেট ক্যারিয়ারে যা কিছু সুনাম কুড়িয়েছিলেন!

তবে এরপর নিজেকে আর মেলে ধরতে পারেননি। পরের বছর ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হয় নাজিমউদ্দিনের। একই বছর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে ডাক পান তিনি, তবে চোটে সে সিরিজে খেলা হয়নি তার। অবশ্য এতে তার জন্য অনেকটা সুবিধেই হয়েছিল বলা চলে! তখন অস্ট্রেলিয়ান পেসারদের চরম ভয় পেতেন তিনি, এমন কি একবার এক সাক্ষাৎকারে অস্ট্রেলিয়ান পেসারদের ভয় পাবার কথা অকপটে শিকারও করেন তিনি।

এছাড়া নাজিমউদ্দিনের ক্যারিয়ারের অন্যতম ভয় ছিল মরনে মরকেল। কোনো পেসারকে খেলতে ভয় লেগেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘মরনে মরকেলের বল মোকাবেলা করতে সমস্যা হয়েছিলো। খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।’

তবে, সবচেয়ে ভূতুড়ে ব্যাপার হল টিভিতে খেলা দেখানোর ব্যাপারটা মাথায় রাখা। বলেছিলেন, ‘টিভিতে নিজের খেলা দেখালেও নার্ভাস থাকতাম। পেস বোলারদের মোকাবেলা করতেও ভয় হতো।’

নিষিদ্ধ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে (আইসিএল) খেলতে যাওয়া বাংলাদেশিদের মধ্যে নাজিমউদ্দিন ছিলেন অন্যতম। মূলত আইসিএলে যাওয়াই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্যান্য খেলোয়াড়দের মত তার ক্যারিয়ারটাও প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। অন্যান্যদের মত ১০ বছরের নিষেধাজ্ঞায় পড়েন তিনিও। তবে ২০০৯ সালে আইসিএলকে ত্যাগ করে তিনি ফিরে আসেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তার সিদ্ধান্তে কিছুটা খুশি হয়ে তার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।

এরপর পুনরায় আবার জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পান তিনি। ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই টেস্টের জন্য ডাক পান নাজিমউদ্দিন। ডিসেম্বরে চট্রগ্রামে প্রথম টেস্টে সাদা পোশাকে পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক হয় তার৷ সে ম্যাচেও জাতীয় দলের হয়ে ওপেনিং করেন তিনি।

অনেক প্রতিভা থাকলেও তার ছিটেফোঁটাও দেখাতে পারেননি জাতীয় দলের জার্সি গায়ে। সাদা পোশাকে মাত্র খেলেছেন তিন ম্যাচ! যার মধ্যে আছে মাত্র এক ফিফটিতে ২১ গড়ে ১২৫ রান। ওয়ানডেতে ১১ ম্যাচে করেছেন ১৪৭ রান, নেই কোনো শতক কিংবা অর্ধশতক।

আর ৭ টি-টোয়েন্টিতে করেছেন ১৪৭ রান, আছে পাকিস্তানের বিপক্ষে করা ৮১ রানের দুর্দান্ত সেই অর্ধশতক। তবে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ঠিকই প্রতিভার যথাযথ প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন জাতীয় দলে দুর্ভাগা এই ওপেনার। ১২ শতক আর ৩৬ অর্ধশতক প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১০৪ ম্যাচে করেছেন ৬২৬৯ রান! আছে ডাবল শতকও, সর্বোচ্চ স্কোর ২০৫ রান। লিস্ট-এ তে ১২১ ম্যাচে আছে ২৬৩৬ রান, আছে ১ শতক ও ১৭ অর্ধশতক। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান ১০৮।

ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটি খেলেছেন তিনি ২০১২ সালের এশিয়া কাপের ফাইনাল ম্যাচে। ৫২ বলে ১৬ রান করেন। ‍দুই রানে হারে বাংলাদেশ। তিনি আরেকটু দ্রুত খেললে যে নির্ঘাত জিততো বাংলাদেশ – সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এরপর আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরা হয়নি তার। ২০১৯ সালে ঘরোয়া ক্রিকেট থেকেও অবসরে যান এই ব্যাটসম্যান।

জাতীয় দলের জার্সি গায়ে নিজের অসামান্য প্রতিভার ছিটেফোঁটাও দেখাতে পারেননি এই ওপেনার। সাবেকদের ক্রিকেটে ইরফান পাঠানদের বিপক্ষে তাঁর ঝড় তোলা সেই আক্ষেপটা যেন আরও বাড়িয়ে দেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link