২০০৩ সাল। বাংলাদেশ দলের পাকিস্তান সফর। সেই সফরটা কখনোই হয়তো ভুলবার নয়। সেবার মুলতানে প্রথমবারের মত টেস্ট জয়ের খুব দারুণ সুযোগ ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু, ইনজামাম উল হকের ব্যাটিং দৃঢ়তায় মাত্র এক উইকেটে জিতে যায় পাকিস্তান।
সেটা অন্য আলোচনা। সে বছর এই মুলতানে, বাংলাদেশের বিপক্ষেই অভিষেক হয় এক পাকিস্তানি পেসারের। তিনি জুনাইদ জিয়া, আপনি খুব প্রবল ক্রিকেট ভক্ত হলেও তাঁকে মনে রাখার কোনো কারন নেই। মুলতান টেস্টে নয়, মুলতানে সেবারের বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার ওয়ানডে সিরিজে।
এর ঠিক আগের বছরই অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ খেলেন তিনি। সেই আসরে ১৩ টি উইকেট পেয়েছিলেন পাকিস্তানের সেরা বোলার। তবে, তিনি ঠিক এক বছরের মধ্যেই পাকিস্তানের জাতীয় দলে খেলে ফেলার মত যোগ্য ছিলেন না।
তারপরও কেন তিনি খেললেন? কারণ, ওই সময়ে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) প্রধান হলেন তৌকির জিয়া। তৌকির জিয়া হলেন এই জুনায়েদ জিয়ার বাবা। ফলে, তিনি খেলে ফেললেন, তাও রীতিমত আন্তর্জাতিক ম্যাচ। তখন প্রথম শ্রেণি বলেন, কিংবা লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেট – কোনোটাতেই খুব বড় কিছু করতে পারেননি এই জিয়া।
ফলে সেই নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হল। তখন পিসিবির প্রধান নির্বাচক ছিলেন সাবেক ওপেনার আমির সোহেল। তিনি অবশ্য জুনাইদ জিয়ার গুণমুগ্ধ ছিলেন। তিনি সংবাদ মাধ্যমে বলেছিলেন জুনাইদের মত পরিশ্রমী ক্রিকেটার তিনি আজ পর্যন্ত দেখেননি।
তা, সে পরিশ্রম দিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে কি ছিল তাঁর পারফরম্যান্স? চার ম্যাচ খেলেন, এর মধ্যে তিনটা ম্যাচেই ছিলেন উইকেটশূন্য। ফয়সালাবাদে পান তিন উইকেট।
এমন পারফরম্যান্সের কারণে পরের দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজেই তিনি বাদ পড়েন। যদিও, এক সিরিজ বাদেই নভেম্বরে তিনি ফেরেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২৩ জনের প্রাথমিক দলে না থাকলেও হুট করে তিনি ১৫ জনের দলে ঢুকে পড়েন।
নির্বাচক আমির সোহেল ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘কোচ ও অধিনায়কই ওকে চাইছে। তাই স্কোয়াডে রাখা হয়েছে।’
তাহলে ২৩ জনের প্রাথমিক স্কোয়াডে কেন ছিলেন না? আমির বলেন, ‘বাংলাদেশের বিপক্ষে ওকে রেখে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছি। এরপর সে ইমার্জিং দলের হয়ে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে টুর্নামেন্ট জিতেছে। সেরা খেলোয়াড় হয়েছে। ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ছিল না। কিন্তু, এবার পারফরম্যান্স দিয়েই ফিরেছে।’
তবে, সমালোচনা পাকিস্তান জুড়ে এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। তবে, কারণ দেখানো হয় – পরীক্ষার কারণে তিনি খেলতে পারবেন না। অতিপক্ষপাতিত্বের কারণে তখন তৌকির জিয়ার মসনদও কেঁপে উঠেছিল। ব্যাপারটা একটা ওপেন সিক্রেট ছিল যে জিয়ার ইন্ধনেই আমির সোহেলের নির্বাচক প্যানেল বারবার ডাকছে জুনাইদকে।
সেই বছর নভেম্বরে পদত্যাগ করে ফেলেন তৌকির জিয়া। এর আগে পাকিস্তানের বিশ্বকাপ ব্যর্থতার জন্য পদত্যাগ না করলেও এবার সন্তানের জন্য তিনি পদত্যাগ করেন।
পদত্যাগের ব্যাখ্যা দিয়ে অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার পদত্যাগের একটা কারণ হল আমার ছেলে। এটা এমন একটা অহেতুক বিতর্ক। আমার ছেলে খুব সেন্সিটিভ। আমি চাই না আমার পজিশনের কারণে ও কোনো চাপের মুখে পড়ুক।’
তবে, বাবার পদত্যাগের পর আনুষ্ঠানিক ভাবে লম্বা সময়ের জন্য জাতীয় দল থেকে জায়গা হারান জুনাইদ। তিনি অবশ্য এর মধ্যেও ফিরেছিলেন।
২০০৮ সালে কায়েদ-ই-আজম ট্রফিতে এক মৌসুমে ৪৬ টি উইকেট পাওয়ার সুবাদে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে স্কোয়াডে জায়গা পান। তবে, এবার আর কোনো ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। পরে ঘরোয়া ক্রিকেটেও বোলিং অ্যাকশন নিয়ে সন্দেহভাজনের শিকার হন। ফলে, চারটি ওয়ানডেতেই থেমে যায় তাঁর ক্যারিয়ার।
২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেন। অভিজ্ঞতার অভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলাটা যার প্রশ্নবিদ্ধ ছিল – তিনি একটা সময় ঘরোয়া ক্রিকেট শেষ করেন অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে। ৯০ টি প্রথম শ্রেনির ম্যাচে ২৮২ টি উইকেট, ১০৯ টি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে ১৪৭ টি উইকেট, ৩৫ টি টি-টোয়েন্টিতে ৪১ উইকেট পান।
পরে তিনিও বোর্ডে যুক্ত হয়েছেন। ২০১৯ সাল থেকে তিনি পিসিবির ডমেস্টিক ক্রিকেট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন তিনি। শুধু পিতৃপরিচয়টা বাদ দিলে তাঁর ক্রিকেটীয় জীবনটা কিন্তু খুব সাদামাটা নয়!