‘যাব তাক বাল্লা চাল রাহা হ্যায়, ঠাঁট হ্যায়, যাব নেহি চালেগা…’
সময় অনেকটা ইলাস্টিকের মতো। স্মৃতির আঙুল তাকে টেনে নিয়ে যেতে পারে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। শচীন টেন্ডুলকারের স্ট্রেটড্রাইভ ও তাই। সৌরভ গাঙ্গুলির বাপি বাড়ি যা কিংবা রাহুল দ্রাবিড়ের জমাট ডিফেন্স ও তো ভিন্ন নয়।
যুবরাজ সিং তখন সদ্য এসেছেন। উড়নচন্ডী বাউন্ডুলে। আমাদেরই মতো। পাড়া জুড়ে একটা স্কুল স্কুল গন্ধ তখন। গন্ধ তখন ফ্রি পাওয়া মাইলো ব্যাটের, সবুজ ক্যাম্বিসের, বিকেলের ল্যান্ডফোনে বেজে ওঠা মাঠে যাবার সবুজের ডাক। যুবরাজ মানে তখন আমরাই। বেহিসেবি।
শচীনের ব্যাট অনেকটা বাবার টিভির সামনে খেলা দেখতে বসে পড়ার মতো, ধীরস্থির, লক্ষ্যে অবিচল। আমরা তখন টিভির সামনে বসতে শিখিনি, উঠে পড়তে চাইতাম বারবার, প্রতিটা বলের পর অস্থির হয়ে পড়ার অদ্ভুত ছটফটানি। যুবরাজ তখন ক্রিজে থিতু হবার কথা বলেন নি।
কিন্তু, আমরা জানি, ছেলেটা নেমেই, অভিষেক ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়ার জেসন গিলেস্পিকে বাঁ পায়ে কম্পাসের মতো ঘুরে একটা চাবুক পুলে আছড়ে ফেলে দেবেন গ্যালারিতে, আমরা জানি ছেলেটা স্টিভ ওয়কে ফ্রন্টফুটে মিডউইকেটের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দেবে, গ্লেন ম্যাকগ্রাকে অবলীলায় স্কয়ার কাট করে দেবে, হয়ত ফসকাবে, হয়ত আউট হয়ে যাবে কিন্তু আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচিয়ে দেবে ঠিক!
ম্যাচ ফিক্সিং-এর ফাটলের ভেতর দিয়ে যুবরাজ ঢুকে পড়েছিলেন জাতীয় দলে, আর চিড় খেয়ে যাওয়া কনফিডেন্সটার ওপর লেপে দিলেন পঞ্জাব কা পুত্তরের চেনা মস্তানি, তাঁর বিখ্যাত ডায়লগের মতোই- ‘যাব তাক বাল্লা চাল রাহা হ্যায়, ঠাঁট হ্যায়, যাব নেহি চালেগা…’- বাকিটা আমরা শুনতে চাইনি। ইচ্ছে করেই চাইনি।
তার বদলে ব্যাটের ওপর সেঁটে নিতাম হিরো হোন্ডার স্টিকার। পাড়ায় পাড়ায় খাটোলেঙথের বলে ঐ ক্যারিবিয়ানদের মতো ব্যাট সুইং করে পার করে দিতে চেয়েছি বাউন্ডারি, শৈশব থেকে কৈশোরের জমে থাকা কত কিসসার পাঁচিল!
যুবরাজ ন্যাটওয়েস্ট ফাইনালে খেললেন একটা ইনিংস, আমরা দেখলাম, এভাবেও জিতে যাওয়া যায়? কেমন যেন মনে হল ১৪৬-৫ থেকে বাকি রূপকথাটা তো আমরাই লিখলাম, অন্তত আমাদের হয়ে কেউ তো লিখল, সচিন-সৌরভ-দ্রাবিড়-মোঙ্গিয়ার গাম্ভীর্য যেখানে শেষ সেখানে আমাদের দামালপনা শুরু।
একেবারে স্কুলের মাঠ থেকে হাজার হাজার দস্যিপনার ঘেমো গন্ধটা কেউ পৌঁছে দিল লর্ডসের মাঠে, ব্রিটিশ ঔদ্ধত্যের ওপর কেউ বিছিয়ে দিল উদাসীন তাচ্ছিল্য- বিরাটীয় আগ্রাসনের অনেক আগেই আমরা যুবরাজের চোখ দেখে শিখেছি শিকারের সামনে শিকারিকে ঠিক কেমন দেখতে লাগে, ওয়াংখেড়ের ফাইনালে কুমার সাঙ্গাকারার উইকেট নেওয়ার পর যুবরাজের সেই চোখ- বাঘের সামনে এভাবেই কি চেয়ে থাকতেন জিম করবেট?
যুবি বিশ্বকাপ জেতালেন, একবার নয় দুবার। ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসকে একুশ শতকের আধুনিকতার রাংতায় মুড়ে দিলেন যুবি, টিটোয়েন্টির আঁচ শুষে নিলেন নিজের গায়ে কিন্তু এতকিছুর পরেও যুবি আসলে আমাদের নিয়ে বুড়িয়ে যাচ্ছিল, আমরা বুঝিনি, আমাদের মর্ণিং স্কুল থেকে ডে স্কুল, বিকেলের সবুজ যত মিলিয়ে এল কোচিং ক্লাসে, বুঝলাম যেভাবে পয়েন্টের পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া বলটা থামিয়ে দিতেন সেভাবে ছেলেটা সময়টাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি!
সময় অনেকটা ইলাস্টিকের মতো। এত বছর পর যুবির ছক্কা আমাদের নিয়ে যায় একটা রিলক্যাসেটের পৃথিবীতে৷ একটু একটু করে ছাপ ফেলা কালার টিভির পৃথিবীতে, রিস্টব্যান্ড আর বাবুলগামের পৃথিবীতে, ট্রাম্পকার্ডের পৃথিবীতে, ফাঁকা রাস্তায় হাত ঘোরানোর পৃথিবীতে আর এই টাইমমেশিনের কোনো কাল হয় না, দশক হয় না।
‘যাব তাক বাল্লা চাল রাহা হ্যায়, ঠাঁট হ্যায়, যাব নেহি চালেগা…’ – বাকিটা? কিছু গল্প অসম্পূর্ণই থাক না, তার গায়ে লেগে থাকুক না কিছুটা সময়ের ধুলো, আলো হয়ে থাক একটা প্রজন্ম, সেই অসমাপ্ত পাণ্ডু থেকে মনকেমনের সময় তারা উলটে পালটে দেখে নিক নিজেদের হলদে কৈশোর।