বল টেম্পারিং: কী, কেন, কীভাবে

পুরো পৃথিবী কেঁপে উঠেছিলো সেদিন।

অস্ট্রেলিয়ার তিন ক্রিকেটার জড়িয়েছিলেন ‘স্যান্ডপেপারগেট’ কেলেঙ্কারিতে। এই স্যান্ডপেপারগেট ব্যাপারটা কী? সোজা কথায় সিরিজ কাগজ গিয়ে বলে পরিবর্তন আনা। আরও সোজা করে বললে-বল টেম্পারিং।

বোঝা যাচ্ছে, বল টেম্পারিং ব্যাপারটা বেশ অন্যায়। কিন্তু এই বল টেম্পারিং ব্যাপারটা আসলে কী? কিভাবে বল টেম্পারিং করতে হয়? সবচেয়ে বড় কথা, বল টেম্পারিং করে লাভ কী?

আসুন, সরল করে জেনে নেই ব্যাপারগুলো।

  • কী?

বল টেম্পারিং মানে হলো, বলের অবস্থা পরিবর্তণ করা।

আইসিসির আইনে বলা আছে, কোনো কৃত্রিম বস্তু ব্যবহার করে বা শরীরের কোনো অঙ্গ দিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে বলকে বিকৃত, আকার পরিবর্তন ও অবস্থা পরিবর্তণ করা যাবে না। সোজা কথায়, বলকে তার স্বাভাবিক নিয়মে চলতে দিতে হবে।

খেলা এগোনোর সাথে সাথে নতুন বলের চরিত্রর, আকারের ও বৈশিষ্ট্যের কিছু পরিবর্তন হতে থাকে। এটাই ক্রিকেট খেলাটার একটা সৌন্দর্য। বল সময়ের সাথে সাথে সিম-এর (সেলাই) তীক্ষতা হারায়, ওজন বাড়তে থাকে।

এ অবস্থায় কিছু কাজ করার অনুমোদন আবার আছে।

আইসিসির আইনেই বলা আছে, ‘সময় ও বলের আকার’ নষ্ট না করে বলকে পলিশ করা যাবে। আম্পায়ারের উপস্থিতিতে বল খেদে কাঁদা বা ময়লা তোলা যাবে। কিন্তু কিছুতেই নখ দিয়ে খোচানো থেকে শুরু করে অন্য কোনো কিছু করা যাবে না, যাতে বল তার স্বাভাবিক গতির চেয়ে একটু বেশী পরিবর্তিত হয়। এই আইন না মেনে বলের আকার বা চরিত্র বদলে ফেলাটাই বল টেম্পারিং।

  • কেন?

বল টেম্পারিং করার মূখ্য উদ্দেশ্য আসলে একটি-পুরোনো বলকে নতুন বলের মতো ও নতুন বলকে পুরোনো বলের মতো করে সুইং করানো!

হ্যাঁ, সংক্ষেপে ব্যাপারটা এই।

প্রথমে আমরা ক্রিকেট বলের চরিত্রটা একটু বুঝি।

ক্রিকেট বলের ওপরটা তৈরী হয় দুই টুকরো একট চামড়াকে জুড়ে দিয়ে। এই জুড়ে দেওয়ার জায়গায় দুই প্রস্ত ভারী সেলাই থাকে। একেবারে মাঝ বরাবর যে সেলাইটা থাকে, তাকে বলে সিম; কারণ ওখানে জায়গাটা একটু উচু হয়ে থাকে। আর সিমের ঠিক নিচেয় আরেকটা সেলাই থাকে, নাম কোয়ার্টার সিম।

নতুন বলে যাবতীয় সুইং হয় এই সিম ব্যবহার করে। সিমকে উইকেটে আঘাত করিয়ে বলকে ডানে বা বামে পাঠিয়ে দেন বোলাররা।

পুরোনো বলে এই সিম আস্তে আস্তে অগুরুত্বপূর্ন হয়ে যায়। তখন আর সিমের তীক্ষ্নতা থাকে না। ফলে নতুন ধরণের একটা সুইং করাতে হয়। সিমের বদলে এবারের সুইংটা হয় বলের ওজন কাজে লাগিয়ে।

শুরু থেকে বৈধভাবে বলের এক পাশকে উজ্জল রাখা হয়, আরেক পাশ প্রাকৃতিকভাবে ভারী হতে থাকে। এরকম পুরোনো বলকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে তার দুই পাশের নষ্ট হয়ে যাওয়া ভারসাম্যের কারণে একটা সুইং পান কোনো কোনো বোলার। এই সুইংকে বলে রিভার্স সুইং।

এই অবদি কাজটা বৈধ।

কিন্তু যেসব দলে রিভার্স সুইং করানোর মতো বোলার থাকে, তারা চান প্রাকৃতিকভাবে বল পুরোনো হওয়ার আগেই বলের দুই পাশের ওজনের ভারসাম্য ও মসৃনতার ভারসাম্য নষ্ট করতে। তাতে বল নতুন থাকতেই রিভার্স সুইং করানো সম্ভব।

আরেকটা ঘরানার বোলাররা বল পুরোনো হয়ে যাওয়ার পর টেম্পারিং শুরু করেন। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, বৈধভাবে বলের একটা পাশ আপনি যতই ঘসাঘসি করেণ না কেনো, সময়ের সাথে আসলে পুরো বলটাই পুরোনো হতে থাকে। ফলে পুরোনো বল শুধু বৈধভাবে ঘসে এক পাশ অনেক মসৃন রাখা যাবে না। তখন অনেকে কৃত্রিম কোনো বস্তু দিয়ে ঘসে একটা পাশ মসৃন রাখার চেষ্টা করেন।

আরও দুই ঘরানার টেম্পারিংয়ে সিম ও কোয়ার্টার সিমে বিকৃতি আনার চেষ্টা করা হয়। সিম নখ বা অন্য কিছু দিয়ে খুচে উচু করে পুরোনো বলেই সিম মুভমেন্ট পাওয়ার চেষ্টা করা হয়। এ ছাড়া এক পাশের কেয়ার্টার সিম খুলে ফেলার চেষ্টা করা হয়। তাতে বিশেষত ডে-নাইট ম্যাচে মাঠ থেকে ওই ফাঁকা দিয়ে কিছু আর্দ্রতা প্রবেশ করে বলের এক পাশে; ওজনের ভারসাম্য নষ্ট হয়।

  • কীভাবে?

এতোক্ষনে আমরা বল টেম্পারিংয়ের উদ্দেশ্যগুলো বুঝে ফেলার কথা।

কিন্তু সমস্যা হলো, মাঠের ভেতর আম্পায়ারের চোখের সামনে, দর্শকদের দেখিয়ে দেখিয়ে বা ব্যাটসম্যানকে জানিয়ে তো বলে এসব পরিবর্তণ করা যায় না। তা করতে গেলে আপনি ওয়াসিম আকরাম হোন আর শচীন টেন্ডুলকার; একদম ধরা পড়ে শাস্তি টাস্তি পেতে হবে। সে ক্ষেত্রে বল টেম্পারিং করবেন কী করে?

বল টেম্পারিং যারা করেন, এরা অত্যন্ত ধূর্ত প্রজাতির লোক। এদের বুদ্ধির অভাব নেই। আমরা গত কয়েকদিন আন্তর্জাতিক বল টেম্পারিংয়ের বিভিন্ন কৌশল খোজ নেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটেরও নানা ধরণের বল টেম্পারিংয়ের খোজ নিয়েছি। যতগুলো উপায় জানা গেছে, তা আপনাদের সাথে শেয়ার করা যাক:

১. বোতলের ‍মুখ: সাধারণত কোমল পানীয়র বোতলের মুখ ব্যবহার করা হয় এই কাজে। শুরুতে শুরুতে বাউন্ডারি লাইনে সরাসরি বোতলের মুখ দিয়ে বলের এক পাশ ঘসে ওই পাশটাকে পুরোনো বানিয়ে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। পরে কিছু খেলোয়াড় আবিষ্কার করলেন অন্য বুদ্ধি। তারা পকেটে উল্টো করে রেখে দিতেন বোতলের মুখ। ট্রাউজারের ওপর থেকে সবার সামনেই ওই পকেটের ওপর বল ঘসতেন। ভেতরে ভেতরে বল টেম্পারিং হয়ে যেতো।

২. ডার্ট/তীক্ষ্ন কাচ: ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেট, এমনকি ইংল্যান্ডের আন্তর্জাতিক ম্যাচেও এই ধরণের টেম্পারিংয়ের নজির আছে। পকেটে ডার্ট বা কাচের টুকরো রেখে দিয়ে সেটার ওপরে বল ঘসা। অবশ্য এই ধরণের টেম্পারিংয়ের চেষ্টায় নিজে আহত হওয়ার ভয় থাকে।

৩. সিম খোচানো: এটা খুব সরল একটা টেম্পারিং। আরেকদিকে তাকিয়ে ময়লা পরিষ্কার করছি, এমন একটা ভাব করে মূল সিম বা কোয়ার্টার সিম তোলার চেষ্টা করা। একবারে সবটা তোলা হয় না। এক এক বার বল হাতে পেলে একটু একটু করে।

৪. বুটের স্পাইক: দূর্ঘটনার একটা অভিনয় করা হয়। যেনো অনিচ্ছাকৃত বলের ওপর পা পড়ে গেছে, এমন ভাব করে বলকে স্পাইক দিয়ে আঘাত করা। তবে আনাড়ি লোক করতে গেলে কাঙ্খিত জায়গায় টেম্পারিং না হয়ে উল্টো ফল হবে। পাশাপাশি উল্টে পড়ে গোড়ালি মচকাতে পারে।

৫. কামড়ানো: এই বিচিত্র ধরণের টেম্পারিংয়ের ঘটনা শহীদ খান আফ্রিদি ছাড়া আর কারো জানা নেই। ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়কত্ব করতে থাকা ম্যাচে বল কামড়ে ধরেছিলেন! দুটি ম্যাচ নিষিদ্ধও হয়েছিলেন। এতো স্থুল ও চোখে পড়ার মতো বল টেম্পারিং আর কেউ করে না।

৬. ট্রাউজারের জিপার: বহুল প্রচলিত বল টেম্পারিং। ট্রাউজারের জিপারের ধারালো অংশে সুযোগ পেলেই বল ঘসা।

৭. নখ: খুব সেকেলে উপায়। তবে এখনও এটা বেশ চলে। নখ দিয়ে বেশী সময় সিম খোচানো। তবে নখ দিয়ে বলের এক পাশ অমসৃন করার নজিরও আছে।

৮. অন্তর্বাস/রুমাল: পকেটে একটা ভেজা রুমাল নিয়ে নামেন তারা। বল হাতে এলে পলিশ করার নামে পকেটের ওপর বল চেপে ধরা। এ ছাড়া ভেজা অন্তর্বাস পরে খেলতে নেমে ট্রাউজারের ওপর থেকে বল ভেজানোর চেষ্টা করার নজিরও আছে। ঢাকার ক্রিকেটে একসময় এই দুটো বুদ্ধিই চলতো।

৯. চকলেট/চুইংগাম: আন্তর্জাতিকভাবে এখন সবচেয়ে স্মার্ট ও চালু টেম্পারিং। মুখে যে কোনো মিষ্টি চকলেট বা ক্যান্ডি বা চুইংগাম রাখলেই কাজটা হয়। লালা খুব ঘন ও কেমিক্যালযুক্ত হয়। সেই লালা বের করে বলের এক পাশ খুব চকচকে করে ফেলা যায়। এ ছাড়া আজকাল বিশেষ কিছু ব্র্যান্ডের খুব দামি চুইংগাম পাওয়া যায়। যা ক্রিকেটাররা মূলত টেম্পারিংয়ের জন্য আরও ঘন লালা তৈরীতে ব্যবহার করেন।

১০. পানি খাওয়া: মাঠে পানি খাওয়ায় তো নিষেধ নেই। পানি খেতে গিয়ে একটা কাজ করা যায়। শার্ট ভিজিয়ে ফেলা যাক। বুকের কাছটা ভেজা রাখলে ওখানে বলটাকে চেপে চেপে ধরতে পারলে বল ভিজে যাবে।

১১. শিরিষ কাগজ: এই ব্যাপারটা ঢাকার ক্রিকেটে আমদানি করেছিলেন এক ইংলিশ ক্রিকেটার। আঙুলে প্লাস্টার পরে নামতেন। হাতের মধ্যমা ও অনামিকাতে এক সাথে জোড়া দেওয়া থাকতো প্লাস্টারে। আঙুলে চোট পেলে এভাবে প্লাস্টার করা হয়। ঘটনা হলো হাতের ওপরের দিকে প্লাস্টার থাকলেও ওই প্লাস্টারের সাথে পাতলা করে আটকানো থাকতো শিরিষ কাগজ। যেটা হাতের তালুর দিকে থাকতো। ওপর থেকে কারো পক্ষে অনুমান করা সম্ভব না যে, উল্টো দিকে খসখসে শিরিষ কাগজ আছে। আর সুযোগ পেলেই ওই শিরিষ কাগজ দিয়ে বলের এক পাশে দিবেন ঘসা।

১২. ভেসলিন/জেল: এটাও বহুল প্রচলিত। চুলে বেশী করে জেল দিয়ে মাঠে নামা। মাঝে মাঝে চুলে হাত বুলিয়ে সেটা দিয়ে বল পলিশ করা। আবার ঢাকার ক্রিকেটে প্রচলিত ছিলো, কানের গোড়ায় ভেসলিন নিয়ে নামা। ওই ভেসলিন এনে এনে বল পলিশ করা।

_______________

এখানে ইন্টারনেটে পাওয়া ও বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের জানানো বল টেম্পারিংয়ের উপায়গুলো জানানো হলো। যেগুলো ইতিমধ্যে প্রতিটাই শাস্তির আওতায় এসেছে বিভিন্ন সময়ে। এর বাইরে জানা-অজানা আরও উপায় থাকতে পারে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link