ভালবাসা, তোমার জন্য

‘ভালোবাসা কী?’ এ প্রশ্নের উত্তর কত মহাজন, মহাগুণী কতভাবে দিয়ে গিয়েছেন। তবু ভালোবাসার প্রতিরূপ দেখলে আমরা হাতরে বেড়াই নতুন কোনো উপমার, নতুন কোনো গল্পের। কেউ টানেন শেক্সপিয়ারের রোমিও-জুলিয়েট, কেউ টানেন টাইটানিক। অথচ ভালোবাসা মানে কারো কাছে পাশে থাকার ছোট্ট প্রতিশ্রুতি।

ভাবছেন ফুটবলের মধ্যে ভালোবাসা টানছি কেন? সমর্থকদের কাছে কাছে ফুটবলই ভালোবাসা, রাত জেগে ফুটবল দেখা, প্রিয় দলের গোল দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠা; এটাই ভালোবাসা। তবে ফুটবলের ভেতরের ভালোবাসার গল্পগুলো অনেকসময়ই থেকে যায় অজানা। যেমনটা রালি ডবসনের ভালোবাসার গল্পে।

রালি ডবসন খেলোয়াড় হিসেবে বড় কেউ নন। অস্ট্রেলিয়া নারী দলের রথী-মহারথীদের মধ্যে তার নাম কখনোই আসে না। অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে সেই ২০১৪ সালে একটা ম্যাচ খেলেছিলেন। সেই শুরু, সেই শেষ। আর কখনও আন্তর্জাতিক ফুটবলে পা দেওয়া হয়নি তার। যদিও বয়সটা সবে ২৮, চাইলেই তো ক্যারিয়ারটা বড় করতে পারতেন নিজের মতন করে। সাজিয়ে নিতে পারতেন নিজের জীবনটা। কিন্তু ভালোবাসার কাছে এই ফুটবল ক্যারিয়ার যে তুচ্ছ। ভালোবাসার মানুষের পাশে থাকার জন্য ফুটবলটাই ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি।

গতকাল ছিল অস্ট্রেলিয়ান উইমেন্স লিগের শেষ ম্যাচ। মেলবোর্নের কাছে জয়-পরাজয়ের কোনো সমীকরণ নেই। কিন্তু তবুও ম্যাচটা মেলবোর্নের খেলোয়াড়দের জন্য অতন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই ম্যাচ শেষেই অবসর নিচ্ছেন রালি। গত তিন মৌসুম ধরে মেলবোর্নের ঘরের প্লেয়ার রালি। পার্থ গ্লোরির বিপক্ষে সমাপ্তি টেনেছেন সমাপ্তির মতো করেই।

২-১ গোলের জয়ে করেছেন দলের হয়ে উইনিং গোল। মনে হতে পারে এ আর এমন কী? কিন্তু ঘটনা তো সবে মাত্র শুরু। ম্যাচ শেষেই দেখা গেল তার প্রেমিককে গ্যালারি থেকে নেমে আসতে। পুরো মাঠের সামনেই হাঁটু গেড়ে নিজের প্রেমিকা রালিকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বলসেন ম্যাট স্টোনহ্যাম। অশ্রুসিক্ত রালিও আর না করতে পারেননি। রালির ক্যারিয়ারের শেষ থেকে শুরু হলো তাদের দাম্পত্যের সূচনা।

তাদের গল্পটা জানতে আরো আগে ফেরত যেতে হবে। ৬ বছর ধরে প্রেম চলছে রালি আর ম্যাটের মধ্যে। পরিচয়টাও তাদের ফুটবল মাঠ থেকে। ম্যাটও এককালে ফুটবলার ছিলেন, কিন্তু এক চোটের কারণে তাকে মাঠ থেকেই সরাসরি যেতে হয় হাসপাতালে। আর সেখানেই তার ধরা পরে ব্রেইন ক্যান্সার। ফলে অকালেই ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে হয় তাঁকে। এরপর ক্যামো থেরাপি, সার্জারি করেও কোনোভাবেই সুস্থ করা যাচ্ছিল না তাকে। এ মাসের শুরুতেই আরেকটা সার্জারি করেছেন ম্যাট। এরপর থেকে টানা ১২ মাস এগ্রেসিভ রেডিওথেরাপি নিতে হবে তাঁকে।

আর তার আগেই ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে টেনে নিতে চেয়েছেন ম্যাট। যদিও গত দুই সপ্তাহ ধরে ম্যাটকে দুইবার প্রপোজ করেছেন ডবসন। ম্যাট সেগুলোকে এড়িয়ে দিয়েছেন হেসে। কিন্তু ডবসন সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন আগে থেকেই। বিয়ে করতে রাজি না হলেও এই পুরোটা সময় প্রেমিকের পাশেই থাকবেন তিনি। ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে থাকতে অন্য যেকোনো কিছু ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন রিনি।

সতীর্থরাও না করেনি, বরং তারাও এগিয়ে এসেছে ডবসনকে সাহায্য করতে। যদিও সতীর্থদের জানাতে চাননি ডবসন, তবুও এসব কথা কী আর লুকানো থাকে? ‘আমি চাইছিলাম ওদেরকে না জানাতে। যতটা ভালোভাবে পারা যায় এই মৌসুমটা শেষ করতে। খেলা থেকে যাতের ফোকাস না হারাই আমরা।’

‘সার্জারি শেষ হওয়ার ৫ দিন পরেই ম্যাট আমাকে জোর করে মেলবোর্নে পাঠিয়ে দেয় আর সিজন শেষ করতে। আসার ২ দিন পর জানতে পারি সার্জারি সাকসেসফুল হলেও তা থেকে একটি গ্রেড থ্রী ব্রেইন টিউমার তৈরি হয়েছে।’

শুরুটা করেছিলাম একটা প্রশ্ন দিয়ে, ‘ভালোবাসা কী?’ এ প্রশ্নের উত্তর অনেকে অনেকভাবেই দেন। তবে আমার সবচেয়ে পছন্দের উত্তর সম্ভবত সঞ্জীব সাহার লিরিকসে লেখা, ‘ভালোবাসা মানে আগাম চলার সুর/ভালোবাসা মানে অবিরাম চলা বসা। ভালোবাসা মানে আঁখি পল্লব ছুঁয়ে/চিনতে শেখা শেষ কাব্যির ভাষা।’

ম্যাটকে সুস্থ হতে হলে আরো অনেকটা পথ যেতে হবে, লড়তে হবে অনেকটা পথ একসাথে। সে পথে নিশ্চয় রালি থাকবেন ম্যাটের আঁখি পল্লব ছুঁয়ে। চৌরাসিয়ার বাঁশি হয়ে, আজীবন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link