সাম্রাজ্য উদ্ধারের কান্ডারি

ক্রিকেটে তার হাতেখড়ি ভারতের মাটিতেই, চেন্নাইয়ের বিখ্যাত চিপক স্টেডিয়ামে।

তাঁর বাবা জাওয়াদ হুসেইন ছিলেন মাদ্রাজ রাজ্য দলের একজন ক্রিকেটার। তিনি মাদ্রাজের হয়ে একটি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছিলেন। কিন্তু এখানে ক্রিকেটে ক্যারিয়ার না গড়ে ১৯৬৩ সালে তিনি পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। এরপর একবার ফিরে এসেছিলেন। তবে ১৯৭৫ সালে স্বপরিবারে ইংল্যান্ডে স্থায়ী হবার জন্য পাড়ি জমান তিনি।

আর এখানেই বড় হয়ে ওঠেন ইংল্যান্ডের অন্যতম সফল অধিনায়ক নাসের হুসেইন।

জাওয়াদ হুসেইনের তিন ছেলে নাসের হুসেইন, মেল হুসেইন এবং আব্বাস হুসেইন তিনজনই ক্রিকেট খেলতেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে শুধুমাত্র নাসের হুসেইন ইংল্যান্ড জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। ইংল্যান্ড দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি শুধু ইংল্যান্ড দলকে নেতৃত্ব দেননি তিনি হয়েছিলেন ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা অধিনায়ক।

চেন্নাই থেকে ইংল্যান্ডে আসার পর এখানেই নিজের ক্রিকেটকে চালিয়ে যেতে থাকেন নাসের হুসেইন। এসেক্স অনুর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে মাত্র ১২ বছর বয়সেই খেলা শুরু করেছেন। শুরুর দিকে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন একজন ব্যাটসম্যান এবং লেগ স্পিনার হিসেবে। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তাঁর স্পিন বোলিংটা ছেড়ে দেন। নাসের নিজে মনে করতেন, লেগস্পিনারের তুলনায় তিনি একটু বেশি লম্বা।

নাসের হুসেইন সব সময় চাইতেন ইংল্যান্ড দলের হয়ে খেলতে। এর জন্য তিনি নিজের স্বাভাবিক ব্যাটিং স্টাইলকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি ব্যাট চালিয়ে বল থার্ড ম্যান অঞ্চলে পাঠিয়ে রান করতেন। আর এই কারণেই টেস্টে বেশ সফল ছিলেন তিনি। তাঁর সাফল্য ছিল চরম ইচ্ছা শক্তির জয়। তিনি ব্যাটিংয়ে টেকনিক্যাল দিক থেকে পিছিয়ে থেকেও শুধুমাত্র ইচ্ছা শক্তির জোরেই এত দূর এগিয়ে আসতে পেরেছেন।

নাসের হুসেইনের টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ১৯৯০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। কিন্তু এই সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ হারে ইংল্যান্ড। সাথে দল থেকেও বাদ পড়েন তিনি। তিনি খারাপ পারফর্ম করার জন্য বাদ পড়েননি। তিনি বাদ পড়েছেন ইংল্যান্ড দলের ক্রিকেটার নির্বাচনের বিভিন্ন নীতির কারণে। এরপর আবারো জাতীয় দলে ফেরেন তিন বছর বাদে।

১৯৯৩ সালে অ্যাশেজের তৃতীয় টেস্টে মাঠে নামেন তিনি। এই টেস্টে দুই ইনিংসে করেন ৭১ এবং ৪৭ রান। এরপরেও সিরিজ শেষে আবারও দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। এরপর জাতীয় দলে ফেরেন ১৯৯৬ সালে। এবার দলে ফিরে ভারতের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি করেন এবং একই সিরিজে আবারো সেঞ্চুরি করেন। সিরিজে দুই সেঞ্চুরি করার কারণে ম্যান অফ দ্যা সিরিজ নির্বাচিত হন তিনি। এরপরেই জাতীয় দলের তিন নাম্বার অবস্থানটা পাকা করে ফেলেন নাসের হুসেইন।

১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে অ্যালেক স্টুয়ার্টের কাছ থেকে অধিনায়কত্ব পান নাসের হুসেইন। দায়িত্ব পেয়েই মাইক বেয়ারলির পর নিজেকে অন্যতম সেরা অধিনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। নাসের হুসেইনের নেতৃত্বে ইংল্যান্ড দল টানা চারটি টেস্ট সিরিজে জয় লাভ করে।

মাইক বেয়ারলির অধিনায়কত্বের পর এই ঘটনা ছিল প্রথম। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) টেস্ট র‍্যাঙ্কিং চালু করার আগে র‍্যাঙ্কিং চালু ছিল উইজডেন টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ নামে। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে এই র‍্যাঙ্কিংয়ের নবম এবং শেষ স্থানে ছিল ইংল্যান্ড। এরপর যখন আইসিসি টেস্ট র‍্যাঙ্কিং চালু করে তখন ইংল্যান্ডকে র‍্যাঙ্কিংয়ে তিনে তুলে নিয়ে আসেন নাসের হুসেইন। নাসের হুসেইনের অধিনায়কত্বে সব সময় তাঁর ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠে। তিনি কখনো একই বিষয়ে স্থির ছিলেন না। তিনি ছিলেন শক্তি এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধারণাতে পূর্ণ।

সামধান খুঁজতে গিয়ে তিনি এক ওভারে চারবার ফিল্ডিং পরিবর্তন করার জন্য অনেক বেশি পরিচিত ছিলেন। বিশেষ করে ডানহাতি পেসারদের ক্ষেত্রে নিজের কল্পিত জায়গায় ফিল্ডার বসিয়ে আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে তাঁর ব্যাটিংয়ে ভালো-মন্দ দুই দিকই দেখেছিলেন তিনি। ইংলিশ ক্রিকেটে নাসের হুসাইন নিজের ব্যাটিং দিয়ে প্রভাব রাখতে পারেননি। তিনি প্রভাব রেখেছিলেন নিজের দুর্দান্ত অধিনায়কত্ব দিয়ে।

তবুও অধিনায়ক হিসেবে যোগ্য হবার কারণে দলে তাঁর জায়গা নিয়ে কখনো প্রশ্ন ওঠেনি। ২০০১ এবং ২০০২-০৩ টানা দুই অ্যাশেজ সিরিজে খারাপ খেলার পরও তার উপর কোনো প্রকার চাপ ছিল না।

২০০৩ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বাজে পারফর্মেন্সের পর ওয়ানডে থেকে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন তিনি । একই বছর গ্রীষ্মের পর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে সময় টেস্টেও অধিনায়ক হিসেবে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের কারণ হিসেবে নাসের হুসেইন জানান, তিনি অধিনায়কত্ব করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।

অধিনায়কত্ব ছাড়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের পর তিনি বাংলাদেশ, শ্রীলংকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর করেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন। তাঁর পারফর্মেন্সের উপর ভিত্তি করে ৩৬ বছর পর ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে সিরিজ জেতে ইংল্যান্ড। এরপর ২০০৪ সালের মে মাসে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। অবসর ঘোষণা দেওয়ার মাত্র তিন দিন আগে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডসে অপরাজিত সেঞ্চুরি করেন তিনি।

ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর যোগ দেন ইংলিশ মিডিয়া স্কাই স্পোর্টসের ধারাভাষ্যকার হিসেবে। যোগ দেয়ার কিছু দিনে মধ্যে স্কাই স্পোর্টসের অন্যতম সেরা ধারাভাষ্যকার হন তিনি।

নাসের হুসেইন হয়েছিলেন ইংল্যান্ডের অন্যতম ভাগ্যবান অধিনায়ক, তিনি ভাগ্যের সাথে তাঁর অধিয়ানায়কত্বের গুনাবলির জন্যই সফল হতে পেরেছিলেন। তিনি ভাগ্যবান হয়েছিলেন টস দিয়ে নয়, তার সময়ে ইংলিশ ক্রিকেটে চালু হয়েছিল কেন্দ্রীয় চুক্তি। এই সময়ে তিনি কোচ হিসেবে পেয়েছিলেন ডানকান ফ্লেচারকে। নাসের হুসেইন সব সময় বিবেচিত হবেন ইংলিশ ক্রিকেটের সেরা অধিনায়ক হিসেবে।

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link