অজি আধিপত্যের জনক

এই বল টেম্পারিং কাণ্ডের পর থেকে সেই উগ্রতা, সেই দাম্ভিকতায় যেনো একটু ভাটা পড়েছে। কিন্তু এর আগের অন্তত তিনটি দশক ধরে বিশ্বকে চোখ রাঙিয়েছে এই অস্ট্রেলিয়ানিজম। সোজা কথায় চোখে চোখ রেখে শাসিয়ে কথা বলা। কিংবা আপনার ক্রিকেট জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলা। আর ক্রিকেটে এই ঔদ্ধত্যের নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অ্যালান বোর্ডার; অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট অধিনায়ক।

তাঁরা বলেন – অস্ট্রেলিয়ানিজম।

এই বল টেম্পারিং কাণ্ডের পর থেকে সেই উগ্রতা, সেই দাম্ভিকতায় যেনো একটু ভাটা পড়েছে। কিন্তু এর আগের অন্তত তিনটি দশক ধরে বিশ্বকে চোখ রাঙিয়েছে এই অস্ট্রেলিয়ানিজম। সোজা কথায় চোখে চোখ রেখে শাসিয়ে কথা বলা। কিংবা আপনার ক্রিকেট জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলা।

আর ক্রিকেটে এই ঔদ্ধত্যের নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অ্যালান বোর্ডার; অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট অধিনায়ক।

অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ জয়ী প্রথম অধিনায়ক হলেন অ্যালান বোর্ডার। তিনি অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা অধিনায়কদের মধ্যে একজন। ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্যের সূচনাটা তিনিই করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরষ্কারটা অ্যালান বোর্ডারের নামেই দেওয়া হয়। এছাড়াও বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির বোর্ডারও হলেন অ্যালান বোর্ডার।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলেছেন ১৫৬ টেস্ট এবং ২৭৩ ওয়ানডে। এর মধ্যে ১৫৩ টি টেস্ট খেলেছেন কোনো বিরতি ছাড়া। এই রেকর্ড পরবর্তীতে নিজের করে নেন ইংলিশ কিংবদন্তি অ্যালিস্টার কুক। অ্যালান বোর্ডার অধিনায়ক হিসেবে অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ২৭১ ম্যাচে। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া দলের পেয়েছে ১৩৯ ম্যাচে। তাঁর নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ার সাফল্যের হার ৫১.২৯ শতাংশ। এর থেকেই বোঝা যায় তিনি কতটুকু কার্যকর ছিলেন অধিনায়ক হিসেবে।

অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যে ২৭ জুন জন্মগ্রহণ করেন অ্যালান বোর্ডার। সেখানেই ক্রিকেটের হাতে খড়ি তাঁর। সেখান থেকেই এসেছেন অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলে।

অ্যালান বোর্ডার জাতীয় দলে এমন সময়ে আসেন যখন ক্যারি পেকার আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজে যোগ দিয়েছিলো অনেক ক্রিকেটার। ক্যারি পেকার থেকে তিনিও অফার পেয়েছিলেন, কিন্তু সেই অফার ছেড়ে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়া দলে।

অ্যালান বোর্ডারের ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারের ছিলেন মূলত একজন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। দলের প্রয়োজনে মাঝে মাঝে স্পিন বোলিং করতেন। বোলিংয়েও কিছুটা সাফল্য পেয়েছিলেন তিনি। বোর্ডারের মূলমন্ত্র ছিলো অস্ট্রেলিয়া দলের জন্য জান প্রাণ দিয়ে খেলা। আর সেভাবেই খেলেই তিনি অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের একজন কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন।

অ্যালান বোর্ডার অন্য ক্রিকেটারদের মত খুব সাবলীল ভাবে ক্রিকেট খেলতেন না। তিনি বেশ বিরক্তিকর ভাবে ব্যাটিং করতেন। আর এই ভাবে ব্যাটিং করেই তিনি বেশ কার্যকর হয়েছেন। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটে আগ্রাসী মনোভার তৈরি করার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিলো অ্যালান বোর্ডারের।

অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ১৫৬ টেস্টে করেছিলেন ১১,১৭৪ রান। এর সময়ে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিলো ৫০.৫৬। এছাড়াও ক্যারিয়ারে ২৭ সেঞ্চুরি এবং ৬৩ হাফ সেঞ্চুরি করেন। টেস্টে তাঁর ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস ছিলো ২০৫।

ওয়ানডেতেও বেশ সফল ছিলেন অ্যালান বোর্ডার। তিনি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সীমিত পোষাকে মাঠে নামেন ২৭৩ ওয়ানডেতে। ২৭৩ ওয়ানডেতে ৩০.৬২ গড় এবং ৭১.৪২ স্ট্রাইক রেটে রান করেছিলেন ৬৫২৪ রান।

মাইকেল হোল্ডিং, জোয়েল গার্নার, অ্যান্ডি রবার্টস এবং ম্যালকম মার্শাল এদের নাম শুনলেও ব্যাটসম্যানদের শরীর সিউরে উঠতো। আর এই বোলারদের বিপক্ষে অ্যালান বোর্ডার ভেঙ্গেছেন কিন্তু মচকাননি। এদের বিরুদ্ধে ব্যাটিং করতে গিয়ে আঘাত পেয়েছেন কিন্তু তাঁদের বিপক্ষে বড় রানও করেছেন তিনি। ১৯৮৪ সালে কিম হিউজের অধীনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়ে এই বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেন তিনি।

কিম হিউজের পর অস্ট্রেলিয়া দলের দায়িত্ব নেন অ্যালান বোর্ডার। তিনি যখন অস্ট্রেলিয়া দলে দায়িত্ব নেন তখন অস্ট্রেলিয়া দলে ছিলো বেশ কোন্দল। নিজের ব্যাটিংয়ের মত করে দলকে সামলেছেন তিনি। আর নিজের দলকে এনে দিয়েছেন বড় সাফল্য।

১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত অ্যাশেজকে বলা হয় বোথাম’স অ্যাশেজ। এই অ্যাশেজে দূর্দান্ত অলরাউন্ড পারফর্ম করেন কিংবদন্তি ইংলিশ অলরাউন্ডার ইয়ান বোথাম। তাঁর দূর্দান্ত অলরাউন্ড পারফর্মের উপর ভিত্তি করে ৩-১ ব্যবধানে অ্যাশেজ সিরিজ জিতে নেয় ইংল্যান্ড। কিন্তু এই সিরিজে বেশ দূর্দান্ত পারফর্ম করেছিলেন অ্যালান বোর্ডার। তিনি এই সিরিজে ৫৯.২ গড়ে রান করেছিলেন ৫৩৩ রান।

বর্তমান সময়ের অধিকাংশ ক্রিকেটার খেলায় ভালো করার আগেই পরিচিতি পেতে চান। কিন্তু অ্যালান বোর্ডার ছিলেন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। তিনি পরিচিতি চাইতেন না। তিনি চাইতেন সাফল্য। কোনো সাফল্যের জন্য কখনই প্রচুর উপহার পাওয়াটা বেশ অপছন্দ করতেন তিনি।

অ্যালান বোর্ডার কম সংখ্যক ক্রিকেটারদের মধ্যে একজন যিনি ক্যারি পেকারের কতৃক আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ক্রিকেটে সিরিজে অংশ নেননি। এখানে অংশ গ্রহণ করার জন্য ক্যারি পেকার তাঁকে খালি চেক দিয়েছিলো। ওয়ার্ল্ড ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করার থেকে জাতীয় দলে নিজেকে ভালো ভাবে পাকাপোক্ত করতে বেশি নজর দিয়েছিলেন তিনি। আর তিনি পরিণত হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়া দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে।

কিম হিউজের নেতৃত্বে গায়ানায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেন তিনি। এই সেঞ্চুরি করার জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই ভয়ংকর পেস আক্রমণকে সামলাতে হয়েছে। তাঁর অপরাজিত সেঞ্চুরিতে ভর করে ক্যারিবিয়ানদের ম্যাচ ড্র করে অস্ট্রেলিয়া।

কলকাতায় ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে অ্যালান বোর্ডারের করা বাঁহাতি স্পিন স্মরনীয় হয়ে থাকবে। তিনি বাঁহাতি স্পিনে শিকার করেন ইংল্যান্ডে অধিনায়ক মাইক গ্যাটিংকে। তিনি ক্রিকেটে সবচেয়ে বিপদজনক শট প্যাডেল সুইপ করতে গিয়ে বোর্ডারের বলে আউট হন।

অস্ট্রেলিয়া দলের খেলার সময়ে কিম হিউজ এবং অ্যালান বোর্ডারের মধ্যে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় বিদ্রোহী সিরিজ খেলার জন্য অস্ট্রেলিয়ার প্রায় পুরো দল নিয়ে যান হিউজ। এই সময়ে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পান অ্যালান বোর্ডার। তিনি যখন দায়িত্ব নেন, তখন সেই দল ছিলো অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় সারির দল।

অ্যালান বোর্ডার বিদেশের মাটিতে ভালো খেলতেন। অস্ট্রেলিয়ার অন্য যেকোনো ক্রিকেটারের থেকে বিদেশের মাটিতে তাঁর রেকর্ড বেশ ভালো।

অ্যালান বোর্ডার এবং ভারতীয় কিংবদন্তি ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কারের নামে চালু করা হয়েছে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি। যা মূলত ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে টেস্ট সিরিজ।

অ্যালান বোর্ডারের সময়ই প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোচ দেখা যায়। তখন অস্ট্রেলিয়ার কোচ হিসেবে নিয়োগ পান বব সিম্পসন। সিম্পসনকে মূলত নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো অ্যালান বোর্ডারের কাজের চাপ কমানোর জন্য। আর বব সিম্পসনের দলে কোচ হিসেবে আসাটা বেশ ভালো ভাবে মেনে নেন।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টানা জয়ের রেকর্ড গড়েন অ্যালান বোর্ডার। পরবর্তীতে এই রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেন তারই উত্তরসূরী স্টিভ ওয়াহ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বোর্ডারের হাত ধরেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠার যাত্রা শুরু করে।

১৯৮৯ সালের অ্যাশেজ জয়ের পর তাকে ‘ক্যাপ্টেন গ্রাম্পি’ বলে ডাকা হত। যদিও এই অ্যাশেজে বলার মত পারফর্ম করতে পারেননি তিনি। তবুও মেনে নেওয়া যায়, কারণ অধিনায়ক হিসেবে তিনি ৪-০ ব্যবধানে অ্যাশেজ সিরিজ জিতিয়েছেন।

এতো সাফল্যমন্ডিত ক্যারিয়ার শেষ করে ক্রিকেটকে ছাড়তে পারেননি। ক্রিকেটকে ছেড়ে জড়িয়েছিলেন ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হিসেবে। আজো অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে তিনি শ্রদ্ধার পাত্র।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...