বিরাট, এই বাইশ গজ, তোমার রত্ন সিংহাসন

দিল্লীর ফিরোজ শাহ কোটলার নাম শুনলেই মনে প্রথম কী মনে আসে আমাদের? হয়ত নব্বইভাগ ভারতীয়ই একবাক্যে বলে দেবেন একটাই ঘটনা- ‘অনিল কুম্বলের দশ উইকেট’- নব্বই-এর দশকে বেড়ে ওঠা একটা শৈশবগুলোকে সকালে খবরের কাগজটা পিছন থেকে পড়তে শিখিয়েছেন যে ক্রিকেট প্রজন্ম সেই সৌরভ-শচীন-দ্রাবিড় জমানার অতন্দ্র সেপাই ছিলেন জাম্বো।

আমাদের মতোই একটা ছেলে উৎসুক চোখ নিয়ে তাকিয়ে ছিল সেদিন এই ফিরোজ শাহ কোটলার দিকে। ২০০১ সাল। জিম্বাবোয়ে টেস্ট চলছে।লোহার জালটার বাইরে থেকে দেখছিল বাউন্ডারির ধারে ফিল্ডিং করছে যুবরাজ-বীরু-জাভাগাল শ্রীনাথরা৷ রাজকুমার স্যারের ক্রিকেট একাডেমি থেকে কয়েকটা ফ্রি টিকিটে খেলা দেখতে এসেছে ওরা। ছেলেটা হাতে একটা সাদা ডায়েরি নিয়ে জালের ভিতর হাত গলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারাদিন। একটা অটোগ্রাফের আশায় বসে আছে সদ্য নেটে ব্যাট হাতে নামা ছোট্ট ছেলেটা, যার আইকনরা তখন ফিরোজ শাহ কোটলায় ভারতের টেস্ট ক্যাপটা পরে লড়ছে।

ডিসেম্বরের কনকনে ঠাণ্ডায় রাত নয়টায় এলো টেলিফোনটা। ২০০৬ সাল তাই মোবাইলের বাড়বাড়ন্ত আজকের মতো ছিল না। ছেলেটা সারাদিন ব্যাট করে ক্লান্ত। ঘুমের ঘোরেই ফোনটা ধরে বিছানায় সোজা হয়ে বসল সে। দিল্লীর বাকি টিমমেটরা কিছু বোঝার আগেই ফোনটা কেটে দিল। বালিশের খুঁটটা আঙুলে মুড়িয়ে একবার শক্ত করে মুঠোটা বিছানায় ছুঁড়ে মারল,কান্না ? না!

পরদিন সকালে রঞ্জির গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দিল্লীর কোচ যখন কর্ণাটকের দুঁদে বোলারদের কীভাবে রুখে ফলো অন বাঁচানো যায় সেই নিয়ে চিন্তামগ্ন তখন অধিনায়ক খবর দিলেন, ‘কোহলি আসবে না, ওর বাবা আর নেই,গতকাল রাতেই আচমকা হার্ট অ্যাটাকে…’; ৪০ রানে নট আউট ছিল ছেলেটা, ম্যাচ বাঁচাতে বড় দরকার ছিল ওকে কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তো আর না বলা যায় না কোনোভাবেই।

ম্যাচ শুরুর আগে কোচ নেটে প্র্যাক্টিস করালেন বাঁ-হাতি এক মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান কে, ক্রিজে নামার ঠিক কিছুক্ষণ আগেই কোচ দেখলেন নিজের কিটব্যাগটা টানতে টানতে একটা ক্লান্ত ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে মাঠের বাইরে। কোচ কিছু বলার আগেই সে নিজে এসে জিজ্ঞেস করল – ‘আমি নামছি তো?’

ঠিক কী ভেবেছিলেন তখন দিল্লীর সেই কোচ? ঐ চোখদুটোই কি যথেষ্ট ছিল না – যে দুটো চোখ মনে করিয়ে দিতে পারত শচীন টেন্ডুলকারের বাবা মারা যাবার পরেও বাইশগজে দাঁড়িয়ে থাকার তেরঙা ইতিহাসটা? নাকি চোখে একটা আগুন আর কিছুটা চুইয়ে পড়া জল নিয়ে ছেলেটা যখন ৯০ রান করে ফলো অন বাঁচিয়ে দিল সেই মুহুর্তেই সবার অলক্ষ্যে ভারত পেয়ে গিয়েছিল শচীন টেন্ডুলকারের পতাকা বওয়ার চওড়া কাঁধখানা?

দুটো ঘটনার চিত্রনাট্যের টুকরো জুড়লে ভেসে ওঠে দুটো চোখ৷ হার না মানা দুটো চোখ। যে স্বপ্ন ঘুমোতে দেয় না এমন স্বপ্ন দেখে চলা দুটো চোখ।

আজ যে কোহলির কাঁধে ১৩৫ কোটি ভারতবাসী তুলে দিয়েছে তাঁদের বহুযুদ্ধের রক্তিম তেরঙ্গা, আজকে যে বিরাট পৃথিবীর সমস্ত বোলারের ত্রাস, আজ যে ছেলেটা একা হাতে শেষ করে দিতে পারে ওভারসিজের যেকোনো দলকে,আজ যে ছেলেটা এক দশকে ২০ হাজার রান করে পিছনে ফেলে দিয়েছে বিশ্বের সমস্ত ব্যাটসম্যানকে সেই ছেলেটা কিন্তু একদিনে ‘বিরাট কোহলি’ হয় নি; ১৩ বছর আগে কোন এক সকাল ৭ টায় দুটো লালচোখ নিয়ে,একবুক আগুন নিয়ে যেদিন কোচের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল একটা ১৮ বছরের ছোট্ট ছেলে, সেদিন একরত্তি ছেলেটা বুঝিয়ে দিয়েছিল দেশের পতাকা বইবার জন্য শুধু ক্রিকেটের প্রতিভা নয় দরকার বলিদান দেবার চওড়া খাঁচা- সেইদিন, ঠিক সেইদিন ভারতের হৃদয়পুরমাঝে এসেছিল নতুন সম্রাট !

মুচকি হেসে শচীন টেন্ডুলকার নিজের আঁকড়ে রাখা তেরঙ্গাটা তুলে দিয়েছিলেন যে নতুন সম্রাটের চওড়া কাঁধে…
সেই ফিরোজ শাহ কোটলা রয়েছে, সেই সবুজের উদ্যানে বিরাট কোহলি ব্যাট হাতে নামেন আজ। অটোগ্রাফ চাওয়ার পেন আর খাতাটা পালটে গেছে এম আর এফ ব্যাটে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাত্র তিরিশ বছর বয়সে কোনো খেলোয়াড়ের সম্মানে স্ট্যান্ড তৈরী হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে।

সুনীল গাভাস্কার-শচীন তেণ্ডুলকরদের অবসরের পর তাঁদের নামাঙ্কিত স্ট্যান্ড হয়েছিল, প্রথম কোনো ক্রিকেটার নিজের ক্রিকেটীয় কেরিয়ারের মধ্যগগনে থাকাকালীন এই বিরল সম্মানের অধিকারী হলেন। সম্রাটের মুকুটে জুড়ল পালক, সেদিনের সেই অটোগ্রাফ চাইতে থাকা ছেলেটার অদম্য অধ্যাবসায় জন্ম দিল একজন বিরাট কোহলির, সকলে প্র্যাকটিস সেরে বাড়ি চলে গেলো যে ছেলেটা বল-মেশিনের সামনে ঠায় ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে নিজের টেকনিক ঠিক করত, নিজের খেলাকে সর্বোত্তম পর্যায়ে নিয়ে যেতে যে ছেলেটা ডায়েট চার্টের কঠিন জালে নিজেকে বেঁধে ফেলেছে এক দশকেরও বেশি সময়ে, নিজের সমস্ত ব্যক্তিগত ভালবাসার আগে রেখেছে ক্রিকেটব্যাটের চকচকে ফেসটাকে সেই ছেলেটাই আজকের বিরাট কোহলি হয়ে ফিরে এলেন।

জালের বাইরে থেকে হাত বাড়িয়ে অটোগ্রাফ চাওয়া থেকে নিজের নামাঙ্কিত স্ট্যান্ড- জীবনের দুই উইকেটের মাঝে এই রানিং বিটউইন দ্য উইকেটস, এই অনন্ত যাত্রাপথের নামই যে বিরাট কোহলি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link