ক্রিকেটের আশ্রিত যুবরাজ

ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জমজমাট প্রতিযোগিতার নাম রঞ্জি ট্রফি, এটা সবার জানা। কিন্তু সেটা কার নামে, সেটা জেনেছি অনেক পরে। ২০১৭ সালে (উৎপল) শুভ্রদার ‘কল্পলোকে ক্রিকেটের গল্প’ পড়ার মাধ্যমে সেই ব্যক্তির সাথে আমার পরিচয়। কুমার শ্রী রণজিৎসিংজি, যার ব্যাটিংকে নেভিল কার্ডাস অভিহিত করেছিলেন, ‘মধ্য গ্রীষ্মের রাতে ক্রিকেটের স্বপ্ন’ বলে।

কিছুদিন আগে গৌরব কাপুর আর অজয় জাদেজার আলোচনা শুনছিলাম। সেখানে রণজিৎসিংজিকে নিয়ে বিস্ময়কর কিছু তথ্য জানতে পারি। অজয় জাদেজা বলেছিলেন যে, রঞ্জিকে আসলে দত্তক নেয়া হয়েছিল। পরে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে যা জানতে পেরেছিলাম তার সারমর্ম এমন।

১৮৫২ সালে উত্তরাধিকারসূত্রে জামনগরের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন বিভাজি। একটু বেশিই উপভোগ করার স্বভাব ছিল বোধহয় তার, তাই বিয়ে করেছিলেন গুণে গুণে চৌদ্দটি। কিন্তু নিজের উত্তরাধিকার নিয়ে দুশ্চিন্তাটা তাঁর রয়েই গিয়েছিল, কেননা চৌদ্দজনের কেউই পুত্রসন্তান জন্ম দেয়নি।

এদিকে বিভাজির হঠাৎ নজর পড়ে এক মুসলিম সিন্ধি মহিলা দিনমজুর ধনবাইয়ের উপর। কিন্তু ধনবাই সাফ বলে দিল, বিবাহবহির্ভূত কোনো সম্পর্কে তার আগ্রহ নেই।

বিভাজি এবার নতুন প্রথা চালু করলেন৷ ধনবাইকে বিয়ে করলেন ঠিকই, কিন্তু নিম্নস্তরের স্ত্রীর মর্যাদা দিলেন। অর্থাৎ, ধনবাই বা তাঁর কোনো সন্তান বিভাজির উত্তরাধিকার হবেনা বা সহায়-সম্পত্তির ভাগ পাবেনা। আর ধনবাইয়ের তিন বোন প্রবেশ করল বিভাজির হারেমে।

ধনবাই কোলাভা নামের এক ছেলে জন্ম দেয়। গুজব ছিল যে, বিভাজি তাঁকে বিয়ে করার সময় সন্তানসম্ভবা ছিল সে। এদিকে বিভাজির উত্তরাধিকার নেই, আদৌ হবে কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই। অগত্যা প্রথা ভেঙে কোলাভাকে উত্তরাধিকার মেনে নেন বিভাজি।

কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, তা প্রমাণিত হয় যখন বিভাজির খাবারে বিষ মেশাতে গিয়ে ধরা পড়ে কোলাভা। তাকে বংশচ্যুত করে দেন বিভাজি।

এবার উত্তরাধিকারের জন্য বিভাজি তার সেনাবাহিনীর বীর যোদ্ধা জামালসিংজির শরণাপন্ন হন। জামালসিংজির এক ছেলে উমেদসিংজিকে দত্তক নেন বিভাজি, নাম বদলে তার নাম রাখেন রায়সিংজি।

এদিকে কোলাভাকে বংশচ্যুত করার সিদ্ধান্তে ফু্ঁসছিল তার মা ধনবাই। তাই দত্তক নেয়ার এক বছরের মধ্যেই তাকে বিষপ্রয়োগ করে মেরে ফেলে ধনবাই।

বিভাজি আবারও তার সেনাসদস্য জামালসিংজির কাছে উত্তরাধিকার চান। এবার তার পছন্দ ছিল জামালসিংজির সাত বছর বয়সী নাতি রণজিৎসিংজি ওরফে রঞ্জি। এবার আর কোনো সুযোগ না নিয়ে একজন কর্ণেলকে নিযুক্ত করেন রঞ্জির দেখভাল করার জন্যে।

এদিকে ব্রিটিশরা রাজকোটে হবু রাজপুত্রদের জন্য ‘রাজকুমার কলেজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করে, যা বিখ্যাত মায়ো কলেজের অধিভুক্ত ছিল। কলেজে যোগ দেয়ার আগে রঞ্জি রাজকোটের এক বাংলোতে থাকতেন, যেখানে তাঁর পরিচারকের সংখ্যা ছিল ১৭!

১৪ বছর বয়সে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার জন্য ফার্গুসন স্বর্ণপদক পান রণজিৎসিংজি। কিন্তু কলেজে পড়ার সময় ঘটে আরেক ঘটনা।

হারেমে থাকা ধনবাইয়ের তিন বোনের একজন ছিল জানবাই৷ সে হঠাৎ দাবি করে বসে যে, তার ছেলের বাবা বিভাজি। এটা প্রায় নিশ্চিত ছিল যে, জানবাই বাচ্চাটাকে হারেমের বাইরে থেকে এনেছিল। কিন্তু চার উচ্চাকাঙ্খী মহিলার সাথে পেরে উঠতে পারেননি বিভাজি। ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড রিপনের সহায়তা নিয়ে পূর্বের সিদ্ধান্ত বদল করে জানবাইয়ের ছেলেকে উত্তরাধিকার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু রঞ্জির প্রতি স্নেহপরবশ হয়ে বিভাজি বোম্বে প্রেসিডেন্সিকে তার শিক্ষাদীক্ষার দেখভাল করার দায়িত্ব দেন।

রাজকুমার কলেজ থেকে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান রঞ্জি। সেখানে গিয়ে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করতে পারেননি, ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন – সে গল্প পরে কখনো করব।

ভারতের প্রধান দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট তার নামে হলেও রণজিৎসিংজি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন ইংল্যান্ডের হয়ে, কাউন্টি ক্রিকেটে খেলেছেন সাসেক্সের হয়ে। ১৫ টেস্টে ৪৫ গড়ে দুই শতক ও ছয় অর্ধশতকে করেছিলেন ৯৮৯ রান। সাসেক্সের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩০৭ ম্যাচে ৭২ শতকের সাহায্যে ৫৬ গড়ে তার সংগ্রহ ২৪,৬৯২ রান। লেগ গ্ল্যান্সের প্রবর্তক হিসেবে ধরা হয় রণজিৎসিংজিকে।

ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা আরেক কিংবদন্তি দুলীপসিংজি, যার নামে ভারতে দুলীপ ট্রফি খেলা হয়, তিনি সম্পর্কে ভাতিজা হন রণজিৎসিংজির। বংশগত ও অঞ্চলগত সূত্রে তাদের সাথে সম্পর্ক রয়েছে ভারতের হয়ে খেলা অজয় জাদেজা ও রবীন্দ্র জাদেজারও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link