আমি যাকে ঠিকঠাক চিনি না বা বুঝি না তাঁকে নিয়ে বাক্যব্যয় তাঁর মহত্বকে ছোটও করতে পারে, সুবিশাল ব্যক্তিত্বকে পূজনীয় রাখতে সবার বক্তব্যের প্রয়োজন হয় কী?
আমি ছোটবেলা থেকেই কবিতাবিমুখ, পড়িই না, পড়লেও বুঝি না, তবুও কিছু কবিতার লাইন আমাকে মনে রাখতে বাধ্য করেন, শক্তি, তারাপদ, জীবনানন্দ।
আমি যে কবিতায় অভ্যস্ত তাতে অবশ্য মুহুর্মুহু করতালি শুনতে পাবেন।
সন দুই হাজার, সময় এপ্রিল, এমন এক সময়ে ঢাকায় চলা এক ক্রিকেট ম্যাচ টিভিতে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল এই হয়তো জ্বালিয়ে দেবে গোটা গ্যালারি।
তখন গ্যালারি থেকে ব্যাটসম্যানের সাজঘরে ফেরার পথে বাঁধা বলতে ছিল কেবলই খাঁচা।
আমি ভাবতাম ওরা যদি ক্রিকেটারকে মেরেই ফেলে, অতো নামধাম জানতাম না, কিন্তু সেই ম্যাচের স্মৃতি স্পষ্ট মনে আছে, ওয়ারড্রবের ওপর রাখা টেলিভিশনে ম্যাচ দেখতে দেখতে মাথায় শুধু ঘুরছিল এতক্ষণ ব্যাট করতে থাকা লোকটার কী হবে?
গোটা এশিয়া আর বিশ্ব মুখোমুখি, এশিয়া আর বিশ্বের রানের মাঝে ফারাক এক। আর লোকটা একাই করেন একশো পঁচাশি! তখন এগুলা এতো বুঝি নাই।
আমার শুধু মনে হয়েছিল সেদিন বেভানকে এই জনতা পেলে কী করবে, গ্যালারিতে কিছু জায়গায় পরপর আগুন ধরানো, মানুষ চিৎকার করছে!
গোটা ম্যাচই আমি বিশ্ব একাদশের পক্ষে ছিলাম, কেবল এশিয়া ইলেভেনে শোয়েব আখতার ছিল না তাই! কিন্তু এই ম্যাচের চিত্রনাট্যে নায়ক ও ভিলেন একই লোক! ভিলেন বলা অবশ্য বাড়াবাড়ি।
নাম মাইকেল বেভান, পেশা- খেলা শেষ করে আসা, প্রায় সাত হাজার রান, ওয়ানডে ক্রিকেটে এখনো গড়ের খাতায় পঞ্চম সেরা ব্যাটসম্যান।
যখন খেলা ছাড়েন তখন তার সমান গড় তো দূরের কথা, ৫০ গড় কারো ছিল না।
টেস্টে টিকতে পারেননি, চার বছরের ছোট ক্যারিয়ারে বাউন্সে সমস্যা ছিল তার!
ওয়ানডেতে দিয়েছেন ক্রিকেট বিশ্বকে উদাহরণ, দলের জন্য হয়ে উঠেছেন সেই নায়ক যার খোঁজ পাওয়া যায়, ‘আমি এমন কিছু করি নাই’ সংলাপে, পোস্টারে না।
পোর্ট এলিজাবেথে মাইকেল বেভান যেদিন ২০৪ তাড়া করতে নেমে ১৩৫ রানে ৮ উইকেট পড়ে যাওয়া অস্ট্রেলিয়ার খাতায় ৭৬ যোগ করেন সেদিনও বেভান ছিলেন পার্শ্বনায়ক, কারণ আমার আরেক প্রিয় বিকেল এদিন বিশ রানে সাত উইকেটের সাথে ব্যাটেও করেন ৬ রান!
নতুন শতাব্দীর প্রথম এপ্রিলে কিন্তু অপরাজিত লোকটা যখন পরাজিতের বেশে মাঠ ছাড়ছিলেন তখনো গ্যালারির আগুন নেভেনি, বেভানের মুখে তখন কবিতা –
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।