অপার প্রতিভার সাথে আসে বিশাল প্রত্যাশার চাপ। সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে আসে সার্মথ্য নিয়ে প্রশ্নও। ঠিক এমনই ভাবনা জেঁকে বসেছে পৃথ্বী শ’কে ঘিরে। বয়স এখনো ২৫ হয়নি। কিন্তু প্রায় এক যুগ আগে বিশ্বক্রিকেটে আলোড়ন তোলা পৃথ্বী কোথায় যেন হারিয়েই গেলেন। একসময় যাকে নেক্সট শচীন টেন্ডুলকার ভাবা হত, আজ ভারতীয় ক্রিকেটে তার অস্তিত্বটুকু খুঁজে পাওয়া দায়। এই ছোট্ট জীবনের উত্থান-পতনের গ্রাফটা যেন উত্তাল সাগরের ঢেউ থেকেও এলোমেলো।
বহুদিন যাবতই ভারতীয় জাতীয় দলের বিবেচনার বাইরে তিনি। অবিক্রিত থেকেছেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) ২০২৫ নিলামেও। চলতি বছরের রঞ্জি ট্রফিতেও শ’ মুম্বাইয়ের হয়ে খেলেছেন মোটে দুই ম্যাচ। ফর্মের অভাবে পুরো টুর্নামেন্ট কাটিয়েছেন সাইডলাইনে বসেই। ফর্মহীনতা এর সাথে যুক্ত হয়েছে শৃঙ্খলাহীনতা আর ফিটনেস না থাকাটাও। এবার তো বাদ পড়লেন মুম্বাইয়ের লিস্ট এ টুর্নামেন্ট বিজয় হাজরা থেকেও।
অথচ কি নিদারুণ ভাবেই ক্রিকেটীয় যাত্রাটা শুরু হয়েছিল তার। থানের সরু গলির মাত্র তিন বছর এক বাচ্চা। কিন্তু মনে হবে যেন ব্যাট করছেন স্বয়ং ভারতের ক্রিকেট ইশ্বর শচীন। তখনই পাড়ার ক্রিকেটে তার প্রতিভা নজরে পড়ে এক কোচের। বাবা পঙ্কজ শ’ নিজের ক্যারিয়ার ছেড়ে পুরোপুরি নেমে পড়লেন ছেলের স্বপ্ন পূরণে। ১০ বছর বয়সেই যোগ দিলেন মুম্বাইয়ের এমআইজি ক্রিকেট ক্লাবে। থানে শহর থেকে সেখানে প্রাক্টিস করতে যেতে প্রতিদিন ৭০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতেন শ’।
২০১৩ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে হ্যারিস শিল্ডে ৩৩০ বলে ৫৪৬ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলে রাতারাতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন তিনি। শচীনের রেকর্ড ছুঁয়ে রঞ্জি আর দুলিপ ট্রফিতে অভিষেকেই হাঁকান সেঞ্চুরি । আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও ভাগ বসালেন শচীনের রেকর্ডে। ২০১৮ সালে ভারতীয় টেস্ট দলে অভিষেক হয় তার। অভিষেক টেস্টেই সেঞ্চুরি , যে রেকর্ড এতদিন ছিল শুধুই শচীনের নামের পাশে।
সে বছরই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। ভারত অনূর্ধ্ব ১৯ দলকে নেতৃত্ব দিয়ে অর্জন করেন অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব। এরপরেই পেয়ে যান আইপিএল দলও। রান, ট্রফি,খ্যাতি,যশ সবই যেন আছড়ে পড়ছিল তার পদস্থলে। কিন্তু হঠাৎই ছন্দ পতন, শৃঙ্খলার অভাব ধীরে ধীরে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দরজা বন্ধ করতে থাকে।
২০১৯ সালে ডোপ টেস্টে ধরা পড়ে আট মাসের জন্য নির্বাসিত হন। ২০২০ এ আবারও বির্তকিত হন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে এক প্রাক্টিস ম্যাচের আগে অধিনায়ক আজিঙ্কা রাহানে রাহানে বুঝতে পারেন ফিল্ডিং করতে অনীহা থেকেই তিনি ইনজুরির নাটক করতেন।
২০২১ আইপিএলেও রিকি পন্টিংয়ের মত বিশ্বগুরুর নির্দেশনাও মানেননি তিনি। নেটে অতিরিক্ত সময় কসরত করতে বলেছিলেন পন্টিং তাকে। কিন্তু তা অগ্রাহ্য করেন তিনি। ভারতীয় ক্রিকেট ম্যানেজমেন্টেরও তার প্রতি আশ্বাস উঠে যায় এখান থেকেই। তা নিয়েই খবরের শিরোনামে আসেন তিনি।
প্রতিভা জন্মগত হতে পারে, কিন্তু শৃঙ্খলা ও অধ্যবসায় ছাড়া সেই প্রতিভার স্থায়িত্ব হয় না। পৃথ্বী শ’য়ের গল্প আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে শুধুমাত্র প্রতিভা দিয়ে শীর্ষে পৌঁছানো যায় না, শীর্ষে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন মাটি কামড়ে টিকে থাকার ক্ষমতা।
পৃথ্বীর এই পথচলা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবন এক প্রবাহমান নদী, প্রতিভার তরী বেয়ে তাকে এগোতে হয়। কিন্তু সেই তরীকে বাঁচিয়ে রাখে একমাত্র শৃঙ্খলার হাল আর অধ্যবসায়ের বৈঠা। জীবনের নৌকার দক্ষ মাঝি কি হতে পারবেন তিনি! নাকি তার গল্পটা থেকে যাবে অপূর্ণ মহাকাব্য হিসেবে? প্রশ্নটা জমা রইলো আপাতত সময়ের কাছেই।