‘অঘটনঘটনপটীয়সী’ বাংলা ব্যাকরণে এক কথায় প্রকাশের ক্ষেত্রে এই শব্দটা অনেকেই দেখেছেন। যার অর্থ যে অঘটন ঘটানোতে বেশি পটু বা দক্ষ। ফুটবলকে অঘটনঘটনপটীয়সী বললে কী খুব একটা ভুল হবে?
ফুটবলের আবির্ভাবের পর থেকে কম ঘটনার জন্ম দেয়নি ফুটবল, মাঠে ঢুস মারা থেকে শুরু করে একই মাঠে খেলে অ্যাওয়ে গোলে বাদ পরা, ফুটবলের মাঠে অবিশ্বাস্য ঘটনা নিত্যনৈমিত্যিক। কিন্তু ফুটবল মাঠে এমন ঘটনা হয়তো এর আগে কখনোই দেখেনি বিশ্ব। আর সেটাই করার সুযোগ করে দিয়েছে বর্তমানের অস্থির পৃথিবী। গোলরক্ষক ছাড়াই মাঠে নেমেছিল রিভার প্লেট!
প্রশ্নটা আসছেই স্বভাবত, এটা কখনও হয় নাকি? ফুটবলের নিয়মেই তো মাঠে একজন গোলরক্ষক রাখা প্রয়োজন। হ্যাঁ, ফুটবল মাঠে অবশ্যই একজন গ্লাভস হাতে ভদ্রলোকের থাকার প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু রিভার প্লেটের গল্পটা বুঝতে হলে আরেকটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে আমাদের।
পৃথিবীজুড়ে আস্তে আস্তে কমে এসেছে কোভিড-১৯ এর থাবা। কয়েক জায়গায় অনেকটাই সামাল দেওয়া গিয়েছে চ্যাক্সিনেশনের মাধ্যমে। কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকায় এই ধাক্কা সামলানোই যাচ্ছে না। বিশেষ করে আর্জেন্টিনায়। গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি কোভিড-পজিটিভ ও মৃত্যুর রেকর্ডের দিক দিয়ে তৃতীয়তে আছে তাঁরা।
আর তার প্রভাব পরেছে ফুটবল দলের উপরেও। আর্জেন্টিনার রিভার প্লেটের খেলোয়াড়েরাও বাদ যাননি। একজন খেলোয়াড় থেকে পুরো দলের মাঝে ছড়িয়ে গিয়েছে কোভিড। পুরো দলের ২০ জন খেলোয়াড় কোভিড-পজিটিভ হয়ে এখন আইসোলেশনে। আর তার মধ্যে আছেন দলের তিন গোলরক্ষকও।
ফলে একেবারে ভাণ্ডার শূন্য হয়ে পরেছে আর্জেন্টিনার দলটির। রিভার প্লেটের কাছে দলে খেলাবার মতন যথেষ্ট খেলোয়াড়ই নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও জোড়াতালি দিয়ে কোনোভাবে লিগে নিজেদের খেলা চালিয়ে নিয়েছে তারা। অভিষেক করিয়েছে ১৭ বছর বয়সী গোলরক্ষকের। কিন্তু ঝামেলা তৈরি হয়েছে গতকাল।
কোপা লিবার্তোদোরেসের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে কলম্বিয়ান ক্লাব সান্তা ফের মুখোমুখি হয়েছিল রিভার প্লেট। আর তাতেই যত বাধা বিপত্তির শুরু। মাঠে নামানোর জন্য কাঁটায় কাঁটায় ১১ জন খেলোয়াড়ই আছে তাদের। আর তার মধ্যে নেই কোনো গোলরক্ষক।
কোভিড টেস্ট সময়মতো না করতে পারায় আনা যায়নি নিজেদের যুব দলের গোলরক্ষককে। ফলে কলম্বিয়ায় কোচ মার্সেলো গ্যালার্দো নিজেকে আবিষ্কার করলেন ৬ জন মূল দলের খেলোয়াড়সহ ১১ জনের এক বহর, যাদের মধ্যে নেই কোনো গোলরক্ষক।
সাথে সাথে কমনেবলের কাছে আবেদন করা হয় জরুরিভিত্তিতে গোলরক্ষককে উড়িয়ে আনার জন্য। কিন্তু বাজে অবস্থার জন্য সে সুযোগও হয়নি। ফলে প্রেসের সামনে এসে গোমড়া মুখ করে এসে কোচ জানালেন, আগামী ম্যাচের জন্য হাতে গ্লাভস তুলে নিচ্ছেন মিডফিল্ডার এনজো পেরেজ!
আউটফিল্ড খেলোয়াড়দের জন্য হাতে গ্লাভস তুলে নেওয়া নতুন কিছু নয়, গোলরক্ষক লাল কার্ড দেখার কারণে হ্যারি কেইন, জন টেরিদের দেখা গিয়েছে হাতে গ্লাভস তুলে নিতে, কিন্তু সেটা খানিকের জন্য। পুরো ম্যাচ একজন আউটসাইড খেলোয়াড় খেলে যাবেন গ্লাভস পরে, এমনটা ভাবাও যে অসম্ভব।
এতো আর পাড়া-মহল্লার খেলা নয়, যে কেউ একজন দাঁড়িয়ে গেলেই হবে। তার উপর কোপা লিবার্তোদোরেসের ম্যাচ, হেরে গেলে নড়বড়ে হয়ে পড়বে দক্ষিণ আমেরিকার জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট জেতা।
এনজো পেরেজ সে কাজটাই করলেন, ম্যাচের প্রথম মিনিট থেকেই নেমে পরলেন গোলরক্ষক হিসেবে। পেরেজও যে পুরোপুরি ম্যাচ ফিট তা কিন্তু নয়, বরং ক্র্যাম্প নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন শেষ ম্যাচে। এজন্যই সম্ভবত তার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল সে দায়িত্ব।
ম্যাচের ফলাফল? রিভার প্লেট শত প্রতিকূলতা পার করে ম্যাচ জিতে নিয়েছে ২-১ গোলে। গোল্পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে ম্যাচ জিতিয়ে ফিরেছেন এনজো পেরেজ। তবে এর ক্রেডিটটা দিতে হবে দলের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দেরই। ম্যাচের ৬ মিনিটের মাথাতেই ফ্যাব্রিজিও অ্যানগিলেরি আর হুলিয়ান আলভারেজ ২-০ গোলে এগিয়ে নিয়ে যান রিভার প্লেটকে।
এরপর বাকি সময়টা এনজোকে সঙ্গ দিয়ে গিয়েছেন তারা। একেবারে হেভি বাসপার্ক যাকে বলে। যদিও ৭৩ মিনিটে সেই বাসপার্ক ফসকে একটা বল জালে জড়িয়ে গিয়েছে তাদের। তবুও দিনশেষে জয় নিয়ে তো ফিরেছে? তাই যথেষ্ট এনজোর জন্য। এমন ঘটনার দরুণ ম্যাচ সেরারা পুরষ্কারটাও বাগিয়ে নিয়েছেন এনজো।
পেরেজের গল্পটা কম আশাজাগানিয়া নয়, ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছেন মেসির সঙ্গে। সামান্যর জন্য বিশ্বকাপ ছোঁয়া হয়নি তার। সেখান থেকে দুই বছর আগে বোকা জুনিয়র্সের জয়ে কোপা লিবার্তোদোরেস জেতা আর আজ চোট নিয়েও রিভার প্লেটের গোলবারের নিচে দাঁড়ানো। একের পর এক বিষ্ময় জাগিয়েই যাচ্ছেন পেরেজ।
সামনের ২৫ তারিখ আবারও কোপা লিবার্তোদোরেসের ম্যাচে মাঠে নামবে রিভার প্লেট। ততদিনে বাকি ৪ গোলরক্ষকের মধ্যে একজনের সুস্থ হওয়াটা বড্ড জরুরি। কথায় আছে বাজি একবার লাগে, বারবার নয়। কোপা লিবার্তোদোরেসে এগোতে গোলরক্ষকের সুস্থতা তাই বড্ড প্রয়োজন রিভার প্লেটের।