ক্রিজ ছেড়ে ততক্ষণে মিটার চারেক বেরিয়ে গিয়েছেন সেলিম জাফর। নন স্ট্রাইকিং এন্ড থেকে যত দ্রুত সম্ভব দৌড়ে ওপারে গিয়ে একটা রান ঝুলিতে ভরাই তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু ওই সেকেন্ডের ভগ্নাংশে আচমকাই খেয়াল করলেন, বলটাই তো করা হয়নি। অথচ কোর্টনি দৌড় শুরু করলেন। উইকেটের পাশে এসে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে লাফ দিয়ে ঠিক যখন ডেলিভারি করতে চলেছেন, তখনই তো দৌড় শুরু করেছেন জাফর। তাহলে!
চকিতে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলেন, দাঁড়িয়ে আছেন কোর্টনি ওয়ালশ। হাতে বল। বেল ফেলে জাফরকে প্যাভিলিয়নের রাস্তা দেখানো তখন মুহূর্তের অপেক্ষা মাত্র।
আর তা হওয়ারই কথা। যদি একটু পিছন ফিরে তাকাই দেখব, সময়টা ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য মোটে সুবিধার যাচ্ছে না। প্রায় দশ বছরের উপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রাজত্ব করার পর, ১৯৮৭-র বিশ্বকাপের প্রথমবারের জন্য হট ফেভারিট হিসেবে ধরা হয়নি তাঁদের। লয়েড, গার্নার, হোল্ডিং, ল্যারি গোমেজ অবসর নিয়েছেন।
গর্ডন গ্রিনিজ ও ম্যালকম মার্শালও দলে নেই। এই অবস্থায়, ভিভের নেতৃত্বে পেস বোলিং-এর দায়িত্বে আছেন প্যাট্রিক প্যাটারসন, এলডিন ব্যাপটিস্ট, কার্লিস্লে বেস্ট এবং এক ৬ ফুট পাঁচ ইঞ্চির জামাইকান। হাবেভাবে এবং বোলিং-এর মসৃণতায় সদ্য অবসৃত মাইকেল হোল্ডিং-এর কথা মনে করানো কোর্টনি ওয়ালস। কিছুদিন আগেই শারজায় শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ১ রানে ৫ উইকেট নিয়েছেন তিনি।
যে বিশ্বকাপের গল্প দিয়ে শুরু হল এই লেখা, তার প্রথম ম্যাচে ইংল্যন্ডের বিরুদ্ধে তাঁর শেষ ন-খানা বলেই অ্যালান ল্যাম্বের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে ম্যাচ খুইয়েছেন কোর্টনি। তৃতীয় ম্যাচে মুখোমুখি ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং সেই বিশ্বকাপের যুগ্ম আয়োজক এবং অন্যতম ফেভারিট পাকিস্তান। লাহোরে ফিল সিমন্স এবং অধিনায়ক ভিভ রিচার্ডসের অর্ধ শতরানের দৌলতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করেছে ২১৬।
তাড়া করতে নেমে পাকিস্তানও যে খুব ভালো জায়গায় আছে তা নয়; শেষ ওভারে জয়ের জন্য চাই ১৪ রান; আইপিএল উন্মাদনা-রহিত সেই যুগে এই রান তোলা মোটেও জলভাত হয়ে যায়নি। বরং বেশ শক্তই। আর, ক্রিজেও তেমন সেট ব্যাটসমান কেউ নেই। আছেন, লেগস্পিনার আব্দুল কাদির এবং বাঁ-হাতি পেসার সেলিম জাফর। প্রথম পাঁচ বলে উঠেছে ১,১,৬,২ ও ২। ফলে, জাফরের রানের জন্য পড়িমরি দৌড় প্রায় অবধারিতই ছিল। এবং তিনি দৌড় শুরুও করে দিয়েছিলেন।
আমাদের গল্পের শুরুও এখানেই; এই শেষ বল করা থেকে। বল করতে ছুটছেন কোর্টনি। ডেলিভারি স্ট্রাইডের শেষ প্রান্তে এসে লাফ দিলেন, বল করতে গিয়েও থেমে গেলেন তিনি। কোমরে হাত। নন স্ট্রাইকিং এন্ডে সেলিম জাফর তখন রান চুরি করার জন্য ক্রিজ ছেড়ে তিন চার মিটার বেরিয়ে গেছেন। ওয়ালশের কাছে সুযোগ ডেলিভারি স্ট্রাইডে উইকেট ভেঙে দেওয়ার। তাহলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেমি ফাইনালে যাওয়ার আশা টিকে থাকে।
এই সেই মুহূর্ত। যেখানে উইকেট থেকে তিন-চার মিটার দূরে দাঁড়িয়ে জাফর আবিষ্কার করলেন, বল করা হয়নি; বরং বল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন কোর্টনি। আর তাঁর উইকেটটি উড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানের আশায় জল ঢেলে দেওয়ার ভিতর অবসর মাত্র মুহূর্তের ভগ্নাংশের।
তবু ওই মুহূর্তের ভগ্নাংশেই ক্রিকেট যেন হয়ে উঠল আভিজাত্যের জলসাঘর। ঝিকিয়ে উঠল নীল রক্তের যাবতীয় বৈভব।
উইকেট ভাঙলেন না কোর্টনি। ভাঙতে পারেন না তিনি। তাঁর ক্রিকেট-শিক্ষা এই কাজ করতে তাঁকে অনুমতি দেয় না; যেমন অস্ত্রহীনকে আঘাত করা মহাকাব্যিক যুদ্ধে না-জায়েজ। বীরের লক্ষ্মণ বলে গণ্য করা হয় না। ঠিক সেরকমই। জামাইকার মের্লবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বল করতে করতে ক্রীড়াবিদসুলভ যে মানসিকতা তৈরি হয়েছে তাঁর, সেখানে বিপক্ষকে চোখে চোখ রেখে হারানো রয়েছে। আইনের ফাঁক খুঁজে, পিছনের দরজা দিয়ে জেতা নেই।
সেলিম জাফর পড়ি-কি-মরি করে ক্রিজে ফিরে এলেন; ওয়ালশ শুধুমাত্র সতর্ক করে ছেড়ে দিলেন তাঁকে। এদিকে শেষ বলে আব্দুল কাদির স্ল্যাশ করে ব্যাকওয়র্ড পয়েন্ট ও গালির মাঝখান দিয়ে বল বার করে দু-রান নিয়ে পাকিস্তানকে জিতিয়ে দিলেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ হেরে গেল; কিন্তু জিতে গেল ক্রিকেট।
পরবর্তী ইংল্যন্ড ম্যাচ হেরে কোর্টনিরা প্রথমবারের জন্য সেমি ফাইনালে প্রবেশ করতে পারলেন না। ১৯৮৩-র বিশ্বকাপের হার ফ্লুক ছিল, ১৯৮৫-র মিনি ওয়র্ল্ড কাপের সেমি ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে হারও। কিন্তু ‘৮৭র সেমিফাইনালে ওঠার অপারগতা বোধহয় সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পতনের প্রথম চিহ্ন হয়ে দেখা দিল। সেই পতনোন্মুখ সাম্রাজ্যের মধ্যেও তবু জেগে থাকল ক্রিকেটের আভিজাত্য। সৌজন্য। রুচি। বীরভাব।
এবারে আরও একটু সময় এগিয়ে যাই। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ক্যারিবিয়ন ঔদ্ধত্য মাটিতে মিশেছে। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট? ১৯৮০ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত ২৯টি টেস্ট সিরিজ হারেনি তারা। সেবারে বর্ডারের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম দুই পেস বোলারও নেই, ক্রেগ ম্যাকডারমট এবং ড্যামিয়েন ফ্লেমিং। কিন্তু নবীন গ্লেন ম্যাকগ্রার ৮ উইকেটের উপর ভরসা করে প্রথম টেস্টই অস্ট্রেলিয়া ১০ উইকেটে জিতে নিয়েছে। দ্বিতীয় টেস্ট ড্র করার পর তৃতীয় টেস্ট।
ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেনের কুইন্স পার্ক ওভাল। প্রথম দুই টেস্টে মৃয়মাণ থাকার পর ৯০এর সেরা বোলার কার্টলি অ্যামব্রোস স্ব-মহিমায়। ১৪ রানে ৩ উইকেট পড়ে যাবার পর উইকেটে নেমেছেন স্টিভ, স্টিভ ওয়। অস্ট্রিয়াল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপনকারী গ্ল্যাডিয়েটর। প্রথম ওভারে স্লটারের উইকেট ওয়ালশ নেওয়ার পরে পরপর দুটি উইকেট তুলে নিয়েছেন কার্টলি। ৬ ফুট ৭ ইঞ্চির লম্বা দানবীয় চেহারাটা হাত দুটো পাকিয়ে বড় বড় পদক্ষেপে ছুটে আসছেন তারপর প্রায় এগারো ফুট উপর থেকে সাইট স্ক্রিনেরও উপরে হাত তুলে কব্জির ঝটকায় গুডলেন্থে বল ফেলে গলার কাছ দিয়ে বার করছেন তিনি। অক্লান্তিকর, অবিরাম, নির্দয়ভাবে একটার পর একটা বল সিম মুভমেন্টে হয় বাইরে যাচ্ছে, নাহলে ভিতরে ঢুকছে।
সেই বলটা অফ স্ট্যাম্পের সামান্য বাইরে পড়ে এক ঝটকায় স্টিভের ব্যাট এবং শরীরের মাঝখানের পথ খুঁজে নিয়ে বেলকে নিজের অবস্থান জানিয়ে উইকেট রক্ষক জুনিয়র মারের দস্তানায়। স্বভাবসিদ্ধ হতাশায় কার্টলি মাঝ উইকেটে এসে কড়া চোখে তাকালেন স্টিভের দিকে। সামান্যক্ষণ, তারপর ফিরে চলে যাচ্ছিলেন। মিড অন থেকে কেনেথ বেঞ্জামিন এসে বললেন কার্টলিকে যে স্টিভ নাকি ছাপার অযোগ্য গালাগাল করেছেন। মাথা গরম হয়ে গেল, ফিরে গেলেন স্টিভকে জিজ্ঞাসা করতে। স্টিভও সে রকম তেঁটিয়া।
৬ ফুট ৭এর দানবীয় আকৃতির তোয়াক্কা না করে বলে দিলেন যে তাঁর ইচ্ছে হলে যা কিছুই বলতে পারেন। এবারে আগুন জ্বলে গেল। আপাত শান্ত, সদাহাস্যমুখ কার্টলি অ্যামব্রোস তাঁর বড়বড় আঙুল প্রায় স্টিভের হেলমেটের ভাইজারে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে গেলেন যে মুণ্ডু উড়িয়ে দেবেন তিনি স্টিভের। আগুন জ্বালানো পারফরম্যান্স। মাত্র ৪৫ রান দিয়ে ৫ উইকেট। অস্ট্রেলিয়া মাত্র ১২৮এ শেষ। কিন্তু স্টিভ ওয়কে টলাতে পারলেন না। ৬৩ রানে অপরাজিত থেকে সম্মুখ সমরের দামামা বাজানো বজায় রাখলেন স্টিভ। সেই টেস্টে কার্টলি মাত্র ৬৫ রানে ৯ উইকেট পেয়ে জেতালেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।
কিন্তু পরের টেস্টেই দ্বিশত-রান করলেন স্টিভ। অস্ট্রেলিয়া টেস্ট জিতল এবং প্রথমবারের জন্য ক্যারিবিয়ান সাম্রাজ্যে ফাটল ধরিয়ে তাদের মাটিতেই সিরিজ জিতল অস্ট্রেলিয়া, ২২ বছর পর।
অথচ এমন নয় যে, এতদিন ধরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সোনার সময় চলছে। লয়েড, ভিভ, গ্রীনিজ, হেন্স একে একে চলে গেছেন। চার জনের পেস ব্যাটারি মার্শালের নয়ের দশের প্রথমদিকে অবসরের সঙ্গে সঙ্গেই ফুরিয়েছে। কিন্তু তবু তো রয়েছে কিছু, ত্রিনিদাদের যুবরাজ ব্রায়ান লারার মঞ্চে প্রবেশ ঘটে গেছে। সঙ্গে আছেন কার্ল হুপার। জিমি অ্যাডামস, কিথ আর্থারটনেরাও আছেন বটে। কিন্তু সাম্রাজ্যের সম্মান বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের পেস বোলাররা। প্যাট্রিক প্যাটারসন, উইনস্টন ও কেনেথ বেঞ্জামিন এবং সামান্য সময়ের জন্য হলেও ইয়ান বিশপ। এবং সাম্রাজ্যের দুই অতন্দ্র প্রহরী, জামাইকান কোর্টনি এবং অ্যান্টিগুয়ান কার্টলি।
আবার ফিরে যাই ১৯৯২-এর ব্রিজটাউনে। দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মূলস্রোতে সবে ফিরেছে। একমাত্র টেস্ট খেলতে তারা বার্বাডোজে। রিচার্ড স্নেলের আট উইকেট, সাদা বিদ্যুৎ অ্যালান ডোনাল্ডের ৬ উইকেট আর ওপেনার অ্যান্ড্রু হাডসনের ১৬৩’র দৌলতে তারা ঐতিহাসিক জয়ের দোরগোড়ায়। শেষ দিনে মাত্র ৭৯ রান দরকার, হাতে ৮ উইকেট। টিম মিটিং-এ ওয়ালস এবং অ্যামব্রোস দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, যে ম্যাচ যদি হারিও আমরা তবু বলটা আমাদের হাতেই থাকবে। কী হয়! কী হয়? পরের দিন সকালে বাজান পিচে যেন ঝড় বয়ে গেল। পিচটা একটু খারাপ হয়ে এসেছিল আর পুরো ফায়দা তুললেন অ্যামব্রোস আর ওয়ালশ।
ওয়েসেলসের এর আগে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অভিষেকে সেঞ্চুরি ছিল আট বছর আগে। প্রথম ইনিংসে ৫০ করে দ্বিতীয় ইনিংসেও ৭৪এ। বিরল রেকর্ড আর ঐতিহাসিক জয়ের সামনাসামনি তিনি। সঙ্গে পিটার কার্স্টেন, দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের সবথেকে স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান বলা হয় তাঁকে। শুরু করলেন ওয়ালশই, বড় সিম মুভমেন্টে প্রথমে অধিনায়ক কেপলার ওয়েসেলসের ব্যাটের কানা।
এবারে অ্যামব্রোস, আগের দিনের ২ উইকেটের সঙ্গে হ্যান্সি ক্রনিয়ে, মেরিক প্রিঙ্গল আর ডেভ রিচার্ডসন। মাঝে ওয়ালশ পিটার কার্স্টেনকে কোণাকুণি বল ফেলে ফ্লিক মারতে লোভ দেখিয়ে আউট স্যুইং-এ অফস্টাম্প ছিটকে দিলেন। তারপর তুললেন বিপজ্জনক অলরাউন্ডার অ্যাড্রিয়ান কুইপার এবং রিচার্ড স্নেলকে। দিন শুরু হবার পর মাত্র ২৬ রান হল। এর মধ্যে কার্স্টেনই শুধু দুটো চার মেরেছেন। শেষ উইকেটে কার্টলির সিমে পড়ে ভিতরে ছিটকে আসা বিদ্যুতের হদিস পাননি সাদা বিদ্যুতও। সাম্রাজ্যের উপর যে দুর্দিনের মেঘ ঘোরাঘুরি করছিল। কোর্টনি ও কার্টলির দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে গেল তাকে আটলান্টিকের পারে।
এভাবে যে কতবার, ইংল্যন্ডের বিরুদ্ধে ত্রিনিদাদ, ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে বার্বাডোজ, অস্ট্রেলিয়াকে সিডনিতে, পাকিস্তানকেও দেশের মাটিতে। বারবার বারবার পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন কার্টলি ও কোর্টনি।
অথচ কোর্টনির শুরুটা সেরকম ছিল না। গার্নার রবার্টস অবসৃত। তরুণ কোর্টনি শুরু করলেন প্রথম চেঞ্জ বা দ্বিতীয় চেঞ্জ বোলার হিসেবে। অ্যাকশনে মসৃণতা ছিল হোল্ডিং-এর মতোই, কিন্তু জোর ছিল না হোল্ডিং-এর মতো। বরং পরবর্তীতে নিয়মিত কাউন্টি খেলার মাধ্যমে নিজের আউটস্যুইং এবং গতিতে শান দিলেন তিনি। গ্লস্টারশায়ারে অবসর নেওয়া পর্যন্ত খেলে গেছেন তিনি। জিমি অ্যান্ডারসন ভেঙে দেবার আগে পর্যন্ত পেস বোলার হিসাবে সর্বাধিক বল করার রেকর্ডটাও ছিল ওয়ালশের।
তবে অ্যামব্রোস এসে সঙ্গী হবার পর থেকেই যেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং-এর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন ওয়ালশ। ইনস্যুইং তো ছিলই, সঙ্গে যোগ হল ক্রিজের কোণ থেকে ছাড়া আউটস্যুইং। অ্যামব্রোসের সিম মুভমেন্ট না থাকলেও ওয়ালশের স্যুইং এবং একটা অসাধারণ স্লোয়ার উইকেট পেতে সাহায্য করত। মাঝে কিছুদিনের জন্য ইয়ান বিশপ এসে যাওয়ায় ওয়ালশ আবার ওয়ান চেঞ্জে চলে গেছিলেন। কিন্তু যখনই দরকার পড়েছে কোর্টনি বল হাতে তৈরি।
১৯৮৭র দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা, ১৯৯৩’র ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভের ১৩ উইকেট বা ২০০০ সালে ইংল্যন্ডের বিরুদ্ধে লর্ডসে ১০ উইকেট। ওয়ালশ যেন পুরনো মদ। যিনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাদু হয়ে উঠেছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে বহুবছর ধরে কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমস্যা চলে আসছে খেলোয়াড়দের, ম্যাচ ফি এবং অন্যান্য সুবিধার প্রশ্নে। একটা সময় ওয়ালশ ক্রিকেটারদের মুখপাত্র হিসেবে বড় দায়িত্বও নিয়েছিলেন।
কিন্তু ক্রিকেটার হিসেবে, বিশেষত বোলার হিসেবে লেজেন্ডের পর্যায়ভুক্ত হওয়া তাঁর অনেক বেশি বয়সে। এমনকি ২০০০ সালে আটত্রিশ বছর বয়সে এসে অভূতপূর্ব ৬৬টি উইকেটও নিয়েছেন।
সেই ২০০০এর ইংল্যন্ড সিরিজেই অবশ্য অবসর নিয়েছেন কার্টলি অ্যামব্রোস। দীর্ঘদিনের সঙ্গী। অবশ্য অ্যামব্রোসের জার্নিটা অন্যরকম। অ্যান্টিগুয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম তাঁর। ২০ বছর বয়স পর্যন্ত ভাবেনইনি যে ক্রিকেট খেলবেন। শেষে মায়ের ইচ্ছে রাখতে পছন্দের বাস্কেটবল ছেড়ে ক্রিকেটে আসেন তিনি।
অ্যান্টিগা ভিভ রিচার্ডসের, অ্যান্ডি রবার্টসের। তাঁদের পরামর্শেই অ্যামব্রোস মাইনর কাউন্টি খেলা শুরু করেন। শেষে ১৯৮৮তে গরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর, জোয়েল গার্নারের স্থলাভিষিক্ত হতে ডাক পড়ে কার্টলির। জোয়েলকে বলা হত বিগবার্ড, তার সঙ্গে মিলিয়ে কার্টলিকে ডাকা হতে লাগল লিটল বার্ড।
আপাতভাবে হাসিখুশি, সমস্যাহীন কার্টলি যদি ক্ষেপে যান তো এক অন্য গল্প। একে তো ওই অদ্ভুত রিস্ট অ্যাকশন। ক্য়ারিয়ারের শুরুতে শেল শিল্ডে নো বল ডেকে দিয়েছিলেন আম্পায়ার, বল ছুঁড়ছেন মনে করে। তবে অচিরেই ভুল ভাঙে সকলের। বড় বড় লম্বা লম্বা হাত, লম্বা লম্বা পায়ে উড়ন্ত ঘোড়ার মত ছুটে আসা তারপর মাথার উপর হাত তুলে শেষে কব্জির জোরে বলটাকে সঠিক জায়গায় ফেলা। এবং সিমের উপর নির্ভর করে ব্যাটসম্যানের নাভিশ্বাস তোলা।
ওয়ালশ, অ্যামব্রোস উভয়ের বলেই সর্বাধিকবার আউট হয়েছেন আথারটন, মাইকেল আথারটন। তিনি বলছেন, ‘খেলার শুরুতে পিচের উপরে এসে গুডলেন্থের এলাকাটা পর্যবেক্ষণ করে যেতেন কার্টলি। আর দিনের শেষে ব্যাটসম্যানকে ক্ষত-বিক্ষত করার জন্য বলের লাল দাগে ভরে যেত এলাকাটা।
তবে দীর্ঘদেহী মানুষটা রেগে গেলে আগুন লেগে যেত। ডীন জোন্স একবার বুঝেছিলেন কি ভুলটাই না করেছেন তিনি। ১৯৯৩, একদিনের সিরিজ চলছে অস্ট্রেলিয়ায়। সিডনি। ওই যে হ্যারি পটারের বইয়ে আছে না? ‘ঘুমন্ত ড্রাগনকে কাতুকুতু দিতে যেও না’। সাইট স্ক্রিনের উপর থেকে হাত নামছে কার্টলির, সাদা বল দেখতে অসুবিধা হচ্ছে। তার উপর আবার রিস্টব্যান্ড পরা হাতে। আম্পায়ারকে বলে কার্টলির রিস্টব্যান্ড খোলালেন জোন্সি। পরের ব্যাপারটা জোন্স কেন, পুরো অস্ট্রেলিয়া দলের জন্য বিশেষ সুবিধার হল না।
নির্বিষ সিডনি পিচে আগুন ছুটতে শুরু করল। পরের বলটাই আগেরগুলোর থেকে অনেক বেশি জোরে ছুটে এল শরীর লক্ষ্য করে। কোনরকমে ব্যাট সরিয়ে বাঁচলেন ডিন। তারপরেরটা দুম করে হাঁটুতে। এরপর অগ্নিবর্ষা চলতে লাগল। হাতে কাঁধে বুকে বার পাঁচেক লাল বলের চুম্বন খাওয়ার পরে অন্যদিকে, কেনেথ বেঞ্জামিনের বলে আউট হওয়াই ঠিক বলে ডিন বেঁচে গেলেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া বাঁচল না। কাঁচাখেকো অ্যামব্রোস পরম আয়েসে চিবিয়ে খেলেন মার্ক টেলর, ইয়ান হিলিদের।
ওই সময়ে অ্যামব্রোস অসম্ভব বোলিং করছেন। পার্থে, লাঞ্চের পরের প্রথম ইনিংস। লাঞ্চের পরে অস্ট্রেলিয়া ৮৫তে ২। প্রথমে গেলেন মার্ক ওয়, চতুর্থ স্টাম্পের উপরের বলটি অতিরিক্ত বাউন্স করে মার্ক ওয়র ব্যাকফুটে ডিফেন্সের ব্যাটের কানা নিয়ে উইকেট রক্ষক জুনিয়র মারের কাছে। এর পর সেট হয়ে যাওয়া ডেভিড বুন, গুডলেন্থ থেকে বল যেন হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিল যে সে রকেট হবে, অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেও সফল হলেন না তাসমানিয়ান ডেভিল, বল তাঁর ব্যাটের কাঁধ ছুঁয়ে অধিনায়ক রিচার্ডসনের হাতে। বর্ডার এলেন, অধিনায়ক।
অনবদ্য অভ্যর্থনা হল। লেগস্টাম্পের উপর পড়ে বলটা ছরার মতো উইকেট রক্ষকের দিকে ছুটে গেল, মাঝে জাত চিনিয়ে দিয়ে গেল বর্ডারের আউটসাইড এজ ছুঁয়ে। হিলি এলেন, হ্যাটট্রিক বাঁচালেন কিন্তু সর্বনাশ বাঁচল না। প্রথম স্লিপে ব্রায়ান লারার খাতায় লেখা হল একটি ক্যাচ। এরপর ড্যামিয়েন মার্টিন, জো অ্যাঞ্জেল এবং মার্ভ হিউজ। এদের মধ্যে একমাত্র মার্ভ হিউজই জানপ্রাণ লড়িয়ে অ্যামব্রোসকে গ্যালারিতে ফেলতে গিয়ে কভারের হাতে। বাকিরা সকলেই উইকেটের পিছনে।
এমনই আরেকটা ঘটনা। ১৯৯৪, পোর্ট অফ স্পেন। ১৯৪ তাড়া করে ইংল্যন্ড লুটিয়ে পড়ল মাত্র ৪৬ রানে। একমাত্র আলেক স্টুয়ার্ট ১৮ রান করলেন। ওয়ালশ তিন উইকেট পেলেন বটে, কিন্তু অ্যামব্রোস আগুনে দগ্ধ হওয়া ইংল্যন্ড ব্যাটসম্যানেদের একটাও শট উইকেটের সামনে গেল না। টানা ১০ ওভার বল করে ২৪ রানে ৬ উইকেট।
আসলে অ্যামব্রোসের এই অনবরত ব্যাটসম্যানকে তিষ্ঠোতে না দেওয়া একই জায়গা থেকে একটা বল ভিতরে যাচ্ছে আরেকটা বাইরে এবং তাও ১৪০এর উপর গতিতে এবং গুডলেন্থ থেকে প্রায় কাঁধের সমান উচ্চতায়। এই নিয়ন্ত্রণই ৯০ দশকের সেরা পেসার করে রেখেছে তাঁকে। স্কোরবোর্ড তো গাধা। তবু তারা বলে যে উইকেট প্রতি রানের গড়ে একমাত্র মার্শাল ও গার্নারের পরেই আছে ২০.৯৯এ। স্ট্রাইক রেট যদিও ৫৪ তবু কৃপণতার দিক থেকে দেখতে গেলে ২.৩ যা চারশো উইকেট নেওয়া বোলারদের মধ্যে কৃপণতম।
আসলে সত্তরের রথ যখন থামতে শুরু করেছে, নব্বইয়ের গোড়ায় মার্শালও যাচ্ছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বকালের সেরা কমপ্লিট বোলার হিসেবে শুরু করে ইয়ান বিশপও চোট আঘাতে জর্জরিত হয়ে মাত্র ৪৩টা টেস্ট খেলে অবসর নিতে বাধ্য হচ্ছেন। গ্রীনিজ, হেন্স, লয়েড, রিচার্ডস, দুজন চলে যাচ্ছেন আর তাঁর জায়গায় একটা সম্পূর্ণ ব্রায়ান লারা এবং অর্ধেক কার্ল হুপার আর রিচি রিচার্ডসন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের চিরাচরিত সবুজ উইকেটের রঙ ধীরে ধীরে ধূসর হচ্ছে।
ক্রিকেট ছেড়ে ক্যারিবরা চলে যাচ্ছে অ্যামেরিকীয় বাস্কেটবলের দিকে। এই অবস্থাতেও ভবিতব্যকে যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অন্তত পাঁচ বছর পিছনে ঠেলে রাখতে পেরেছিল, তার প্রধান দুই কারিগরই হলে কার্টলি অ্যামব্রোস আর কোর্টনি ওয়ালশ। বোলিং ওপেন করে জুটিতে লোটা উইকেটের সংখ্যায় সর্বাধিক এখনও, তাঁরা।
ভগ্ন সাম্রাজ্যের বুকে দাঁড়িয়ে শেষ দুই ধ্বজাধারী যেন জলসাঘরের ছবি বিশ্বাস। বেলজিয়ান কাঁচের আশরীর আয়না খুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে পেয়াদায়, ভাঁড়ারে চাল বাড়ন্ত, বারান্দায় ঝাঁট পড়ে না কতদিন হল। তবু সদর খিলানের মাথায় গৌরবময় ইতিহাসের পতাকা পতপত করে উড়ছে তখনও। একটা প্যাট্রিক প্যাটারসন, একটা ইয়ান বিশপ, উইনস্টন বেঞ্জামিন, কেনেথ বেঞ্জামিন, ফ্র্যাঙ্কলিন রোজ, ক্যামেরন কাফি নাম এক এক করে আসবে। বিশেষত প্রথম দুজন। তব সব পেরিয়ে রাত গভীরেও ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের ভগ্ন রথের মাথায় হনুমানের পতাকায় নাম লেখা থাকবে এই দুটি কার্টলি অ্যামব্রোস ও কোর্টনি ওয়ালশ।
২০০০ সালে রেকর্ডের তোয়াক্কা না করে থেমেছিলেন অ্যামব্রোস আর তার এক বছর পর সর্বাধিক উইকেট শিকারি হয়ে প্রথম বোলার হিসেবে ৫০০ উইকেট নিয়ে থামলেন কোর্টনি ওয়ালশ। একজন ক্ষুরধার প্যান্থার, বিপক্ষের দুর্গের পতনই যার একমাত্র লক্ষ্য আর অপরজন সদা সতর্ক এবং সজাগ আফ্রিকান হাতি, যার কাঁধে চড়ে গত শতাব্দী পার হয়ে গেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলিং। সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখে।
কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক