বিশ্বস্ত হাত জোড়া

বাবা ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের ক্যাশিয়ার। বোম্বের জমিদার পরিবারের এই সন্তান বিশ্বস্ত হস্তে ব্রিটিশদের টাকার হিসাব রেখেছেন। তাঁর ছেলে অবশ্য ক্যাশিয়ার হননি। তবে তাঁর ছেলেও বিশ্বস্ত জোড়া হাত দিয়ে নাম কুড়িয়েছিলেন গোটা ক্রিকেট বিশ্বে।

তাঁর কিপিং নিয়ে ভারতের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান বিজয় মার্চেন্ট বলেছিলেন তাঁর কিপিং গ্লাভস নাকি ব্রিটিশদের ব্যাংকের চেয়েও নিরাপদ। ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার, কিরণ মোড়ে কিংবা হালের মহেন্দ্র সিং ধোনিরা যেই ঐতিহ্যের যেই ধারা বয়ে চলেছেন তাঁর আদি নাম নরেন্দ্র শঙ্কর তামানে।

১৯৩১ সালের ৪ আগস্ট বোম্বের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন তামানে হয়ে ওঠেন ভারতের সেরা উইকেট কিপার। সেই সময়ে বিশ্বমানের স্পিনারদের বলে কিপিং করাটাকে রীতিমত ডাল-ভাত বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। ঘুর্ণি খাওয়া সব বলগুলো গ্লাভস বন্দি করার জন্য তাঁকে খুব কমই নিজেকে ছুঁড়ে ফেলতে দেখা যেত। তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই কোনো না কোনো ভাবে বলের লাইনে চলে আসতেন। তিনি বোলারের হাতের দিকে তাকিয়েই বুঝতেন বোলার কী বল করতে যাচ্ছেন।

সেই সময়ে দ্য হিন্দু এর এক প্রতিনিধি লিখেছিলেন, ‘বিশ্বের যে কোনো অধিনায়ক তামানে কে তাঁর দলে চাইবে। তাঁর মধ্যে অতিরঞ্জিত কিছু ছিল না তবে টেকনিক্যালি তিনি ছিলেন ভীষণ রকমের নিখুঁত।’

ওদিকে অস্ট্রেলিয়ার উইকেটকিপার ওয়ালি গ্রাউট তাঁকে তুলনা করেছিলেন ডন ট্যালনের সাথে। ডন ট্যালনকে ডন ব্র্যাডম্যানসহ অনেক ক্রিকেট বোদ্ধাই সর্বকালের সেরা উইকেট কিপার বলে ঘোষণা করেছেন।

নরেন তামানের সময়ে ভারতের বোলিং লাইন আপে ছিল রহস্যময়ী তিন স্পিনার। গুলাম আহমেদ, সুভাষ গুপ্তে ও ভিনো মানকাদের ঘুর্নিতে দিশেহারা হতো দলগুলো। অর্থডোক্স স্পিনার, বাঁহাতি অফ স্পিনার ও আরেক লেগ স্পিনারের সেই কম্বিনেশনে যে কোনো উইকেট কিপারই ঘাবড়ে যেতে পারেন। তবে তাঁদের ভীষণ সহজাভাবেই সামাল দিয়েছিলেন এই উইকেটরক্ষক।

বিশেষ করে সুভাষ গুপ্তের লেগ স্পিন ছিল এক রহস্যের মত। তিনি গুগলিই করতেন দুই রকমের। একটি গুগলে সামন্য বাঁক নিয়ে ভিতরের দিকে ঢুকতো আরেকটি একেবারে তীব্র বাঁক নিয়ে চলে আসতো স্ট্যাম্পের দিকে। কিন্তু এসব কিছুই নরেন তামানের জন্য কোনো অসুবিধা ছিল না।

তাঁকে নিয়ে পলি উমড়িগর বলেছিলেন, ‘তামানে বোলারের হাতের গ্রিপ দেখেই বলে দিতে পারতো বোলার কি করতে চাইছে। এমনকি শুভাষ গুপ্তের মত বোলারের রান দেখেও সে বুঝতো কি বল করতে যাচ্ছে।’

তাঁর জায়গায় ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার আসার আগে আর কোনো উইকেট কিপার ভারতের হয়ে তাঁর চেয়ে বেশি টেস্ট খেলেছিল। ১৯৫৫ সালে ঢাকায় পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষিক্ত হওয়ার পর ভারতের হয়ে মোট ২১ টি টেস্ট খেলেছেন। সেখানে উইকেটের পিছে দাঁড়িয়ে ধরেছেন ৩৫ টি ক্যাচ ও স্ট্যাম্পিং করেছেন মোট ১৬ বার।

পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টেই ৩টি ক্যাচ ও ২ টি স্ট্যাম্পিং করে রেকর্ড করেছিলেন। পরবর্তীকালে কিরণ মোরে, নমন ওঝা ও ঋষাভ পান্ত এই রেকর্ড করেন। এছাড়া সেই টেস্ট সিরিজে মোট ১৯ টি ডিসমিসাল করেন এই কিপার। যা এক সিরিজে কোনো উইকেটকিপারের সর্বোচ্চ ডিসমিসাল।

অসাধারণ এই উইকেট কিপারের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি হয় ১৯৬০ সালে। ওপেনিং ব্যাটসম্যান ও উইকেট কিপার বুধি কুন্দেরানের কাছে জায়গা হারান তিনি। ব্যাটসম্যান হিসেবে বুধি ভালো হলেও কিপিং এ তামানের কাছাকাছিও ছিলেন না এই কিপার ব্যাটসম্যান। তবে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলে যান নরেন তামানে। তিনিই প্রথম কিপার হিসেবে রঞ্জি ট্রফিতে ১০০ টি ডিসমিসাল করেন।

ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পরে নির্বাচক কমিটির হয়েও কাজ করেন তিনি। ১৯৯১ সালে নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যানও হন তামানে। এক কিশোর ছেলেকে জাতীয় দলে ডাকার জন্য অনেক সমালোচিতও হয়েছিলেন তিনি।

সেই ছেলেটির নাম ছিল শচীন টেন্ডুলকার। শুরুর দিকে শচীন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খুব একটা ভালো করতে না পারায় নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল এই নির্বাচককে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন, ‘অপেক্ষা করুন টেন্ডুলকার কখনো হারে না।’

ভারতের ক্রিকেটের এই কিংবদন্তি আরো নানা ভাবে অবদান রেখেছিলেন দেশের ক্রিকেটে। সর্বশেষ ২০০২ সালে মুম্বাই এ ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এই ক্রিকেটার। ততদিনে টেন্ডুলকারও অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফেলেছেন, বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান বনে গেছেন। ভুল বলেননি তামানে!

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link