ইউরোপে এশিয়ান ফুটবলারদের পথচলা কখনোই সহজ ছিল না। ভাষা, আবহাওয়া, শারীরিকতা সবকিছু যেন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবুও কেউ কেউ সেই বাধা ভেঙে বিশ্বমঞ্চে নিজের নাম তুলেছেন ইতিহাসের পাতায়।
ফুটবল যে শুধু ইউরোপ বা দক্ষিণ আমেরিকার খেলা নয়, এশিয়াও জন্ম দিয়েছে কিছু বিশ্বমানের ফুটবলারের, যারা নিজ নিজ সময়ে গড়ে তুলেছেন নিজেদের লিগ্যাসি। তবে প্রশ্ন একটাই, সর্বকালের সেরা এশিয়ান ফুটবলার কে?
প্রথমেই বলতে হয় পাউলিনো আলকান্তারার কথা। ১৮৯৬ সালে জন্ম নেওয়া এই ফিলিপিনো-স্প্যানিশ স্ট্রাইকার মাত্র ১৫ বছর বয়সে বার্সেলোনার হয়ে খেলেন এবং ৩৯৯ ম্যাচে ৩৯৫ গোল করেন। বার্সার ইতিহাসে এক সময় তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা।
জাতীয় পর্যায়ে তিনি স্পেনের হয়ে ১৪ ম্যাচে ১৯ গোল এবং ফিলিপাইনের হয়ে ১১ ম্যাচে ১৪ গোল করেন। এমনকি কাতালোনিয়ার হয়ে খেলেছেন ৭ ম্যাচ এবং গোল করেছেন ৮ টি। সেই সময়ে, যখন এশিয়ানদের নামমাত্র উপস্থিতি ছিল ইউরোপে, ‘দ্য নেট ব্রেকার’ নামে পরিচিতি পেয়ে যান তিনি।
ফিলিপাইনের ইতিহাসে জাপানকে ১৫-২ ব্যবধানে হারানোই আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবচেয়ে বড় ব্যবধানের জয়, যে ম্যাচে খেলেছিলেন পাউলিনো। ১৯২৭ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে চিকিৎসক হয়ে যান। যদিও পরবর্তীতে ১৯৩১-১৯৩৪ এর মাঝে বার্সেলোনার ক্লাব ডিরেক্টর ছিলেন।
এরপর আসেন চা বুম-কুন, যিনি কোরিয়ান ফুটবলের প্রথম ইউরোপিয়ান আইকন। জার্মান বুন্দেসলিগায় তিনি খেলেছেন আইনট্রাখট ফ্র্যাঙ্কফুর্ট এবং লেভারকুজেনের হয়ে। ফ্র্যাঙ্কফুর্ট এর হয়ে ১২২ ম্যাচে ৪৬ গোল, লেভারকুসেনের হয়ে ১৮৫ ম্যাচে ৫২ গোল করেন, জিতেছেন উয়েফা কাপ।
জাতীয় দলে তার নামের পাশে আছে ১৩০ ম্যাচ ও ৫৬ গোল। ‘চা বুম’ নামে পরিচিত এই কিংবদন্তি ইউরোপে ১০০+ গোল করা প্রথম এশিয়ান। ১৯৭০–৮০’র দশকে ইউরোপের মাঠে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম শকওয়েভ ছিলেন তিনি। সেই সময়ের এশিয়ান ফুটবলের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ফরোয়ার্ড এবং প্রথম বড় স্টার ছিলেন তিনি।
এরপর আসে হিদেতোশি নাকাতা। নব্বই দশকের শেষে জাপান থেকে সিরি আ’র স্টেজে আগমন। জাপানের এই মিডফিল্ডার ১৯৯৮ বিশ্বকাপের পর ইতালির সিরি আ লিগে পার্মা, রোমা, ফিওরেন্টিনার মতো ক্লাবে খেলেছেন। পার্মার হয়ে ৬৭ ম্যাচে ৫ গোল, রোমার হয়ে ৩০ ম্যাচে ৫ গোল।
২০০১ সালে রোমার হয়ে সিরি আ শিরোপা জেতেন। জাতীয় দলে খেলে ৭৭ ম্যাচে করেছেন ১১ গোল। শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও ছিলেন ফ্যাশনের মুখ, ‘এশিয়ান বেকহ্যাম’ বলা হতো তাকে। মাত্র ২৮ বছর বয়সে অবসর নেন, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া ছাপ আজও স্পষ্ট।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দক্ষিণ কোরিয়ান সুপারস্টার ছিলেন পার্ক জি-সুং। দক্ষিণ কোরিয়ার এই মিডফিল্ডার খেলেছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ১৩৪ ম্যাচ, করেছেন ১৯ টি গোল। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন তাঁকে বলতেন ‘আ ম্যানেজার্স ড্রিম’।
তাঁর অসীম স্ট্যামিনা, পজিশনিং সেন্স এবং আনসেলফিশ খেলা পার্ককে করে তুলেছিল ইউরোপের সবচেয়ে সম্মানিত এশিয়ান মিডফিল্ডারদের একজন। ২০০8 সালে ম্যানইউর হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেন প্রথম এশিয়ান হিসেবে। এছাড়া তিনটি প্রিমিয়ার লিগ, দুটি লিগ কাপ এবং একটি ক্লাব বিশ্বকাপ জিতেছেন।
জাতীয় দলের হয়ে পার্ক খেলেছেন ১০০ ম্যাচে, করেছেন ১৩ গোল, এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন ২০০২ বিশ্বকাপের সেই ঐতিহাসিক স্কোয়াডকে যারা সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল। সে সময় কোরিয়ার এই সুপারস্টার ‘থ্রি লাঙস’ নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি কারণ তাঁর স্ট্যামিনা ও ওয়ার্করেট ছিল অবিশ্বাস্য।
এশিয়ার ইতিহাসে যদি গোলের কথা বলা হয়, তাহলে নাম আসবে একটিই, আলী দাই। ইরানের এই স্ট্রাইকার ছিলেন আন্তর্জাতিক ফুটবলের সর্বোচ্চ গোলদাতা (১০৮ গোল) ২০২১ সাল পর্যন্ত, যা পরবর্তীতে রোনালদো ভেঙেছেন। জাতীয় দলের হয়ে ১৪৯ ম্যাচে ১০৮ গোল করার পাশাপাশি তিনি ১৯৯৭ এশিয়ান কাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।
ক্লাব ক্যারিয়ারে তিনি খেলেছেন বায়ার্ন মিউনিখ, হার্থা বার্লিন এর মতো ক্লাবে। বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ২৩ ম্যাচে ৬ গোল করলেও, ইউরোপের প্রথম ইরানি খেলোয়াড় হিসেবে তিনি নজর কাড়েন। বুন্দেসলিগা জিতেছেন বায়ার্নের হয়ে, চ্যাম্পিয়ন্স লীগে ছিলেন রানার আপ। তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় গর্ব একজন এশিয়ান হয়েও ফিফা ওয়ার্ল্ড একাদশে সুযোগ পাওয়া। শুধু গোল নয়, আলি দাই ছিলেন ইরানীয় ফুটবলের জাতীয় প্রতীক।
তালিকার শেষ মানুষটি শুধু কিংবদন্তি নন, তিনি এখন এশিয়ার সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ফুটবলারের প্রতিচ্ছবি। সন হিউং-মিনের ইউরোপ যাত্রা শুরু হয় হামবুর্গ থেকে। এরপর বায়ার লেভারকুসেনে নিজেকে প্রমাণ করে ২০১৫ সালে যোগ দেন টটেনহ্যাম হটস্পারে।
প্রিমিয়ার লিগে এখন পর্যন্ত তিনি করেছেন ১২৭ গোল, সর্বকালের সর্বোচ্চদের তালিকায় যা ১৭ নম্বর। ২০২১-২২ মৌসুমে গোল্ডেন বুট জয়ী হন এশিয়ার প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে। জার্মানি আর ইংল্যান্ড মিলিয়ে ক্লাব ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত তাঁর রয়েছে ৪৫০+ ম্যাচে প্রায় ১৬০+ লিগ গোল। টটেনহ্যামের অধিনায়ক হিসেবে ইউরোপা লিগ জিতে ক্লাবের ১৭ বছরের মেজর শিরোপা এবং ৪১ বছরের ইউরোপিয়ান শিরোপার খরা ঘোচালেন।
প্রথম এশিয়ান অধিনায়ক হিসেবে কোন ইউরোপিয়ান শিরোপা জিতেছেন। স্পার্সের হয়ে সন যা করেছেন তা আজীবনের জন্য তাকে ক্লাব লিজেন্ড তো বটেই প্রিমিয়ার লিগ কিংবদন্তিও বানিয়েছে। জাতীয় দলের হয়ে সন করেছেন ১৩৩ ম্যাচে ৫১ গোল, এবং জিতেছেন এশিয়ান গেমস গোল্ড মেডেল।
বিশ্বকাপে করেছেন গোল, নেতৃত্ব দিয়েছেন দলকে, এবং নিজের কাঁধে বয়ে চলেছেন একটি প্রজন্মের স্বপ্ন। খেলার ধরণে তিনি অ্যাথলেটিক, ট্যাকটিকালি অ্যাডভান্সড এবং এক্সপ্লোসিভ। সন শুধু একজন ফুটবলার নন, তিনি এখন এশিয়ার গ্লোবাল অ্যাম্বাসেডর।
এই সুপার সিক্সের বাইরে শিনজি কাগাওয়া ছিলেন জার্মান ফুটবলের পোস্টার বয়। ডর্টমুণ্ডের এর হয়ে দুইবার জিতেছেন বুন্দেসলিগা, এবং ছিলেন জার্মানির অন্যতম জনপ্রিয় অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। এরপর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডেও খেলেছেন, ইংলিশ মিডিয়ায় ‘এশিয়ান ওজিল’ নাম পেয়েছিলেন।
কেইসুকে হোন্ডা ছিলেন জাপানের বিশ্বকাপ পারফরম্যান্সের মুখ। সিএসকেএ মস্কো ও এসি মিলান এর হয়ে নিয়মিত খেলেছেন। বিশ্বকাপে জাপানের হয়ে তিনটি আসরে গোল করে এশিয়ার অন্যতম সফল বিশ্বকাপ পারফরমার হয়ে উঠেছিলেন। আলি করিমি ছিলেন ইরানের ‘এশিয়ান ম্যারাডোনা’।
বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে খেলেছেন ২০০৫-২০০৭ পর্যন্ত। তাঁর বল কন্ট্রোল, ড্রিবলিং ও কারিশমা তাকে ইরানি ফুটবলের সবচেয়ে আইকনিক মুখে পরিণত করেছিল। লি ইয়ং-পিও ছিলেন পিএসভি আইন্দোভেন ও টটেনহ্যামে খেলা একজন নির্ভরযোগ্য লেফটব্যাক। সান জিহাই প্রথম চাইনিজ খেলোয়াড় হিসেবে প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে। তার উপস্থিতিও এশিয়ান ফুটবলের জন্য একটি বড় ব্রেকথ্রু ছিল।
সবাই পথ দেখিয়েছেন, কেউ কেউ পথ গড়েছেন। কিন্তু সন হিউং-মিন সেই নাম, যিনি পথ পেরিয়ে এখন নিজেই এক মানদণ্ড। তিনি শুধু এশিয়ার গর্ব নন, বিশ্বফুটবলের সম্মানের প্রতীক। সর্বকালের সেরা এশিয়ান ফুটবলার? উত্তরটা একটাই, কোরিয়ান প্রিন্স সন হিউং-মিন!