দ্য আনকনভেনশনাল বিস্ট

দশ পা দৌড়ে এসে বল ছুঁড়তেন ডেরেক। অ্যাকশন, রানআপ, বলের গতি দেখলে মনেই হবে না স্পিনার, মনে হবে মিডিয়াম পেসার। প্রথাগত স্পিনারদের মত ফ্লাইট-লুপের মুন্সিয়ানা তাঁর ছিল না, গতির সাথে অ্যাকুরেসি আর কন্সিস্টেন্সিই ছিল প্রধান অস্ত্র। আর ছিল ইনসুইঙ্গিং আর্ম বলের মত ভয়ানক উইকেট টেকিং ডেলিভারি! যে ডেলিভারি দিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে বোল্ড এবং এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেলেছেন অসংখ্যবার।

ট্রেন্টব্রিজ, ১৯৬৬। একুশ বছর বয়সী ডেরেক আন্ডারউডের যেদিন অভিষেক হল, বিশিষ্ট ক্রীড়া লেখক ব্রায়ান স্কোভেল দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘ইংল্যান্ডে আজকাল স্পিনারের এতই আকাল পড়েছে যে শেষ পর্যন্ত কিনা নির্বাচকরা বেছে নিল এমন একজনকে যে আসলে সত্যিকারের স্পিনারই না! একজন বাঁ-হাতি স্লো মিডিয়াম বোলার যে কিনা ‘কাটার’ আর ‘ফ্লোটার’ ছাড়া কিছুই পারে না, তাকে আর যাই হোক স্পিনার বলা যায় না!’

তিনি নাকি খুব জোরে বল করেন, বলে নাকি একদমই ফ্লাইট দিতে চান না, উইকেট নেয়ার চেয়ে রান আটকানোর দিকেই বেশি মনোযোগ — পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে এরকম অসংখ্য সমালোচনা ও তির্যক মন্তব্যের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে।

ডেরেক আন্ডারউডের বোলিং নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও কম হয় নি। কলিন কাউড্রে, অ্যালেক বেডসাররা মিলে তাঁর বোলিং স্টাইলকে মডিফাই করার বিভিন্ন রকম প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘কেবলমাত্র ডানহাতে বোলিং করা বাদে যত রকম এক্সপেরিমেন্ট সম্ভব, তার সবই করা হয়েছে আমার ওপর।’

বেশি না, মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে এই আনকনভেনশনাল স্পিনারটিই হয়ে উঠল ইংল্যান্ডের অ্যাশেজ হিরো! ১৯৬৮ সালের বৃষ্টিবিঘ্নিত ওভাল টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৫০ রানে নিলেন সাত উইকেট, খেলা শেষের মাত্র কয়েক মিনিট আগে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এনে দিলেন শ্বাসরূদ্ধকর এক জয়। শেষ ৪ উইকেট নিয়েছিলেন মাত্র ২১ বলে!

দশ পা দৌড়ে এসে বল ছুঁড়তেন ডেরেক। অ্যাকশন, রানআপ, বলের গতি দেখলে মনেই হবে না স্পিনার, মনে হবে মিডিয়াম পেসার। প্রথাগত স্পিনারদের মত ফ্লাইট-লুপের মুন্সিয়ানা তাঁর ছিল না, গতির সাথে অ্যাকুরেসি আর কন্সিস্টেন্সিই ছিল প্রধান অস্ত্র। আর ছিল ইনসুইঙ্গিং আর্ম বলের মত ভয়ানক উইকেট টেকিং ডেলিভারি! যে ডেলিভারি দিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে বোল্ড এবং এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেলেছেন অসংখ্যবার।

কথিত আছে, টানা একই জায়গায় বল ফেলতে ফেলতে নাকি পিচে গর্ত বানিয়ে ফেলতেন!

ইংল্যান্ডের ভেজা সিমিং উইকেটে তিনি ছিলেন কার্যত আনপ্লেয়েবল। এ কারণে তাঁকে ‘ওয়েট পিচ ডেমন’ বলেও ডাকতেন অনেকে। বৃষ্টির দিনে ইংল্যান্ডকে নাকি ছাতার মত আগলে রাখতেন আন্ডারউড — এমন একটা কথাও প্রচলিত ছিল সমর্থক মহলে।

আন্ডারউড যে কেবল ভেজা উইকেটেই কার্যকর ছিলেন তা কিন্তু নয়, বরং শুকনো উইকেটেও ছিলেন সমান কার্যকর। তাঁর হোম এবং এওয়ে গড়ের পার্থক্যও খুব বেশি না। দেশের মাটিতে যেখানে ১৪৫ উইকেট নিতে ওভারপ্রতি তিনি খরচ করেছেন ২৪ রান, সেখানে বিদেশের মাটিতে ১৫২ উইকেট নিয়েছেন ২৭ গড়ে।

১৯৭৬-৭৭ সালের ঐতিহাসিক ভারত সফরের কথাই ধরুন। ভারতের মাটিতে তাদের বিখ্যাত স্পিন কোয়ার্টেটের ঘূর্ণিফাঁদ উপেক্ষা করে ৩-১ এ সিরিজ জিতেছিল ইংল্যান্ড। যার নেপথ্যে ছিলেন ডেরেক আন্ডারউড।

বিষেণ সিং বেদী (২৫), ভগবৎ চন্দ্রশেখর (১৯) আর এরাপল্লী প্রসন্নকে (১৮) পেছনে ফেলে সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হয়েছিলেন ডেরেক আন্ডারউড (১৭.৫৫ গড়ে ২৯ উইকেট)! তাও কাদের বিপক্ষে? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্পিন খেলা বিশ্বনাথ, ভেংসরকার, গাভাস্কারদের বিপক্ষে, তাদেরই ঘরের মাটিতে! এক গাভাস্কারকেই আউট করেছিলেন ছয়বার!

মিডিয়ার চাপে পড়েই হোক আর বৈচিত্র‍্যের সন্ধানেই হোক, আন্ডারউডের বিকল্প খোঁজার চেষ্টা অনেকবারই করেছে ইংল্যান্ড। প্রথাগত ফ্লাইট ও টার্ন নির্ভর বেশ কয়েকজন স্পিনারকে পরখ করে দেখেছে তাঁর জায়গায়। যে কারণে একটা সিরিজের সবগুলো ম্যাচ খেলার সুযোগ খুব কমই পেয়েছেন জীবনে! মজার ব্যাপার হল, আন্ডারউডের অর্ধেকের সমান সাফল্যও কেউ বয়ে আনতে পারে নি।

সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বোধ হয় নরম্যান গিফোর্ড। ‘ন্যাচারাল টার্নার’ খ্যাত এই বাঁহাতি স্পিনারের শিকার ১৫ টেস্টে মাত্র ৩৩ উইকেট।

এতকিছুর পরেও ৮৬ টেস্টে আন্ডারউডের শিকার ২৯৭ উইকেট, মাত্র ২৫.৮৩ গড়ে! ইকোনমি রেট ২.১১! ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ১৭ বার, ম্যাচে ১০ উইকেট ৬ বার। সেরা বোলিং ৫১ রানে ৮ উইকেট, পাকিস্তানের বিপক্ষে লর্ডসে।

১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৩ সালের আগস্ট — আইসিসি র‍্যাংকিং অনুসারে টানা চার বছর বিশ্বের এক নম্বর বোলার ছিলেন ডেরেক আন্ডারউড। এই চার বছরে তাঁর অর্জন মাত্র ২৩ গড়ে ১০৯ উইকেট! ইংল্যান্ডের টেস্ট ইতিহাসের সফলতম স্লো বোলার (যদি স্পিনার বলতে আপত্তি থাকে) হিসেবে তাঁকে না মেনে আপনি যাবেন কোথায়?

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...