অ্যাডেলেড ১৯৯০, এই ম্যাচে পাকিস্তানের সর্বকালের সেরা একজন বোলার জয় এনে দেননি ঠিক কিন্তু ছিলেন অতিমানবীয়। প্রথমে পাকিস্তানকে এনে দেন ২৫৭ রানের ফার্স্ট ইনিংস পুঁজি! যেখানে তাঁর অবদান ৫২ রান।
এরপরে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসে তুলে নেন পাঁচ উইকেট! এরপর আবার ক্লাসিক ব্যাটিং বিপর্যয়ে পাকিস্তান, সাত রানে তিনটা, ২২ রানে চারটা, ৯০ রানে পাঁচটা উইকেট নাই।
হাল ধরলেন পাকিস্তান ক্রিকেট ইতিহাসের দুই মহানায়ক! ব্যাট হাতে! ১৯১ রানের জুটি গড়লেন ইমরান খান ও ওয়াসিম আকরাম! অস্ট্রেলিয়াকে দিলেন ৩০৪ রানের টার্গেট। এটাই বিশেষ ক্রিকেটারের বৈশিষ্ট্য, দলের প্রয়োজনে আপনি ভুলে যাবেন আপনার বিশেষায়িত পরিচয়টা কী?
ওয়াসিম আকরাম সম্পর্কে দুই চার লাইন লিখতে গেলে পুরোনো লেখা ও অন্য লেখকদের শরণাপন্ন হতে হয়। তাই ক্রিকিনফোর স্ট্যাট এনালাইসিসে ঢু মেরে পেলাম ওয়াসিম কখনোই শুধু বোলার হিসেবে থাকতে চাননি। বল হাতে ভূমিকা পালন শেষে ব্যাটিং নিয়ে ভাবতেন, নতুন শট শিখতে চাইতেন, এরপর দুটোতেই সাফল্য লাভের পরে অধিনায়কত্বটা রপ্ত করার চেষ্টা করেন, একেবারে ব্যর্থ বললে অন্যায় হবে। দলকে ফাইনালে তোলেন তো অন্তত।
একটা বিশ্বকাপ নিজ হাতে জেতান আর একটায় ফাইনালে তোলেন নেতা হয়ে! তার সমালোচনার খুব বেশি জায়গা রাখেননি তিনি।
আমার ক্রিকেট স্মৃতির গালিচায় আমি ওয়াসিমের সবচেয়ে খারাপ সময়টাই দেখেছি। দুর্ভাগ্য বটে। ২০০৩ সালে বিশেষত! পাকিস্তান যেভাবে বাদ পড়ে, এর রেশ ছিল আরো পাঁচ বছর। তবে ঠিক তার আগের সময়টা ভাবেন। একটা প্রপার ব্যাটিং ইউনিট কল্পনা করলে এই দলের বিপক্ষে নামা যে কোন দলকে করুণই লাগার কথা। ওয়ামিস-ওয়াকার-শোয়েব-সাকলাইন-রাজ্জাক। এডিশনাল আফ্রিদি/মালিক।এই দলের লিডার ছিলেন ওয়াসিম আকরাম। বিশ্বে গোটা তিনেক দল আছে যারা গুণেমানে সর্বজয়ী হলেও বিশ্বকাপ
হাতে পায়নি। ৭৮ এ নেদারল্যান্ডস, ৮২তে ব্রাজিল, ৯৯তে পাকিস্তান। পাকিস্তানের সমস্যা হচ্ছে তারা শুধু হারেনি কলাপ্স করেছে। যেন ডিনামাইট সেট করা কোন পরিত্যক্ত ভবন যার কোন প্রয়োজন নাই। এই বিশ্বকাপের ট্র্যাজিক লিডার ছিলেন ওয়াসিম আকরাম।
ওয়াসিম একজন সর্বজয়ী যোদ্ধা। নি:সন্দেহে বলা যায় টি টোয়েন্টি যুগে ওয়াসিম হতে পারতেন বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। আজ মূলত তাকে নিয়েই আলাপ। সাকিব আল হাসান এই মুহূর্তে ওয়াসিমের সাথে একটা রেকর্ডে ভাগাভাগি অবস্থানে আছেন। একই মাঠে ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেট! শারজায় ওয়াসিমের ১২২ উইকেট, মিরপুরে সাকিবের ১২২ উইকেট। তবে সাকিব প্রায় ৬০-৭০ ওভার বেশি বল করেছেন এই যা।
ওয়াসিম আকরাম নিয়ে কথা বলতে প্রথমে যা বলতে হয় সেটা হচ্ছে সব ধরনের উইকেটে চূড়ান্ত আধিপত্য। হোক সে মেলবোর্ন, হোক সে লর্ডস, হোক সেটা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। গুলিস্তানের এই মাঠেও ওয়াসিম ৫০ ওভার মতো বল করে নিয়েছেন ১২টি উইকেট। নিউজিল্যান্ডের মাঠ পেলে তো কথাই নেই, বেসিন রিজার্ভে তার ২৭ ওভারে ১০ উইকেট। ইডেন পার্কে ৫১ ওভারে ১১টি।
অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড-ইংল্যান্ডের মাঠে ওয়াসিম পাকিস্তানকে প্রায়ই হোম টিম অ্যাডভান্টেজের অনুভব দিয়েছেন।
ওয়াসিম আকরামের প্রত্যেকটা বিষয়ই অল্প অল্প করে ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। ওয়াসিম ছিলেন লুধিয়ানার পাড়ার বোলার। সেখান থেকে যখন জাভেদ মিয়াঁদাদকে নেটে বল করে অবাক করে দিয়ে ওয়ানডে দলে সুযোগ পান, ওয়াসিম ভাবতেও পারেননি ক্রিকেট খেলার বদলে পাকিস্তানের ক্রিকেট বোর্ড তাকে বেতন দিতে পারে! এই ওয়াসিম সাত বছরের মাথায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বেতনের ক্রিকেটারে পরিণত হন। ল্যাংকাশায়ারে, তথা ইংলিশ কাউন্টিতে তাঁর জয়জয়কার।
তখন আসে অ্যাডেলেডের সেই বিখ্যাত ইনিংস। ইমরান খান ঘোষণাই দিয়ে বসেন ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার ওয়াসিম আকরাম। ইমরানের ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু বোলার ওয়াসিম যা করে গেছেন তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। ওয়ানডে হোক কিংবা টেস্ট ওয়াসিম তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটিয়েছেন ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭।
এই সময়ে ওয়াসিম টেস্টে ২০ ও ওয়ানডেতে ২১ গড়ে বল করেছেন। ওয়াসিম টেস্টে ২৫ বার পাঁচ উইকেট নিয়েছেন, ২০ বার চার। ওয়ানডেতে ছয়বার পাঁচ উইকেট নিয়েছেন, ১৭ বার চার। ওয়ানডে ক্রিকেটে ৫০২ উইকেট ওয়াসিমের। যার মধ্যে ২২৯টি টপ অর্ডার ও ১৪৬টি মিডল অর্ডার উইকেট। অর্থাৎ ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ওয়াসিমের ৭৫ শতাংশ উইকেটই স্বীকৃত ব্যাটসম্যানকে আউট করে। ওয়াসিমের ৫০২ উইকেটের মধ্যে ১৭৬টিই বোল্ড!
টেস্টে দুর্দান্ত বল করতে থাকা ওয়াসিমের অবশ্য প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট নিয়ে অনাগ্রহও ছিল। ওয়ানডে ক্রিকেটে ওয়াসিম ব্যাট বা বল হাতে ২-৩ ওভারে খেলার চেহারা বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখতেন। ওয়াসিমের সাথে অবধারিতভাবেই আসে ওয়াকার ইউনুসের নাম। টেস্ট ক্রিকেটে ওয়াকারকে ছাড়া ওয়াসিমের পরিসংখ্যান দেখলে অবাকই হবেন। ৬১টি টেস্ট ম্যাচে ওয়াসিম ও ওয়াকার একসাথে বল করেছেন। যেখানে ওয়াসিমের বোলিং গড় ২১!
আর ৪৩টিতে ওয়াকার ছিলেন না, সেখানে ওয়াসিমের বোলিং গড় ২৮! অবিশ্বাস্য জুটি নির্ভরতা!
ব্যাটসম্যানদের আধিপত্যে থাকা ম্যাচ সেরার পুরস্কারেও ভাগ বসিয়েছেন ওয়াসিম ২২ বার। বোলারদের মধ্যে এই রেকর্ডে ওয়াসিমের সাথে ভাগ বসিয়েছেন কেবল শন পোলক। আগেই বলে রেখেছি ওয়াসিমের সেরা ঝলক, সেরা রূপ দেখা হয়নি।
যে ওয়াসিমকে দেখেছি তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ, এমনকি ম্যাচ গড়াপেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল! যে ওয়াসিমকে দেখেছি, সে ব্যর্থতার দায় নিয়ে ক্রিকেট খেলাই ছেড়ে দেন ২০০৩ বিশ্বকাপের পরে। ওয়াসিমের আরেকটি রূপও চমৎকার লাগে আমার, সুযোগ পেলেই তিনি ক্রিকেটারদের গুরু বনে যেতে ভালোবাসেন!