টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার পর কেটে গেছে ২৬ বছর। সমান ২২ পরাজয়-ড্র করতে পারলেও তখনো জয়ের মুখ দেখেনি কিউই ক্রিকেট। নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট খেলা উচিত কিনা সেটা নিয়েই কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে চারিদিকে। এমন সময়েই চার ম্যাচ সিরিজ খেলতে নিউজিল্যান্ডে আসে মহাপরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গ্যারি সোবার্স-এভারটন উইকসদের বিশ্বজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দাপটের সাথেই জিতে নেয় প্রথম তিন ম্যাচ। কোনো ম্যাচেই বিন্দুমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড।
হোয়াইটওয়াশ এড়ানোর লক্ষ্যে অকল্যান্ডে শুরু হওয়া চতুর্থ টেস্টে টস জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় কিউইরা। ৮৭ রানের মধ্যেই টপ অর্ডারের চার ব্যাটসম্যান ফিরে গেলে ব্যাটিংয়ে নামেন অধিনায়ক নিজে। এসেই শুরু করলেন পাল্টা আক্রমণ। চোখজুড়ানো সব শটে সীমানাছাড়া করতে লাগলেন বলকে। অবশেষে ৮৪ রান করে যখন প্যাভিলিয়নে ফিরলেন ততক্ষণে দল পেয়ে গেছে সম্মানজনক স্কোর।
সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা হচ্ছে দমে গেছে তৎকালীন সেরা ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সারা বিশ্ব জয় করে এই দ্বীপরাষ্ট্রে কেউ যে চোখে চোখ রেখে তাদের সাথে লড়াই করবে সেটা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। পুরো ম্যাচটা জুড়েই এই হতবিহ্বল ভাব থেকে বেরোতে পারলো নাহ ক্যারিবিয়রা। অ্যাটকিনসন যখন উপড়ে ফেললেন জ্যাক অ্যালবাস্টারের স্ট্যাম্প ততক্ষণে লেখা হয়ে গেছে বিজয়কাব্য। পরাজয়ের কালিমা লেপনের উল্লাসে মেতে উঠেছে পুরো কিউইবাসী।
সেই অধিনায়ক ছিলেন জন রিড; নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্রিকেট মস্তিষ্ক।
১৯২৮ সালের তিন জুন রাগবি খেলোয়াড় নরম্যান রিড ও গানের শিক্ষিকা আইরিশ রিডের কোলজুড়ে আসে এক রাজপুত্র। নাম রাখা হয় জন রিচার্ড রিড। বাবার মতো হতে চাওয়া জন ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে যেতেন রাগবির মাঠে। একটু বড় হয়েই খেলতে শুরু করেন রাগবি লিগে। কিন্তু বিধিবাম!
সুখ বেশিদিন চিরস্থায়ী হলো না। রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে, আক্রান্ত হলেন বাতজ্বরে পাশাপাশি ধরা পড়লো হৃদযন্ত্রের সমস্যাও। ডাক্তারদের পরামর্শে ছেড়ে দিলেন রাগবি। কিন্তু যার রক্তে আছে খেলাধুলা, তিনি কিভাবে ঘরে বসে থাকেন। ব্যস আরকি, শুরু করলেন নিউজিল্যান্ডে তুলনামূলক কম জনপ্রিয় ক্রিকেট।
ব্যাট-বল দুজায়গাতেই সমান পারদর্শী ছিলেন রিড। ব্যাট হাতে খেলতে পারতেন দায়িত্বশীল ইনিংস। ডান হাতে পেস বোলিং করার পাশাপাশি অবস্থা বুঝে হয়ে যেতেন অফস্পিনার। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ছিলেন তার সময়ের অন্যতম গতিশীল বোলার। পরের দিকে অবশ্য কাটার আর সুইংয়ের দিকে মনোযোগী হন।
ফিল্ডার হিসেবেও ছিলেন তুখোড়, স্লিপ আর কাভারে দাঁড়িয়ে দারুণ ক্ষীপ্রতায় লুফে নিতেন অনবদ্য সব ক্যাচ। এমনকি ১৯৪৯ সালে ইংল্যান্ড সফরে দলের মূল উইকেটরক্ষক ইনজুরিতে পড়লে, গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনেও দাঁড়ান তিনি। ১৯৫৯ সালে উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন তিনি।
ক্যারিয়ারে ৫৮ টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ২২ অর্ধশতক এবং ৬ শতকে সংগ্রহ করেন ৩,৪২৮ রান। সর্বোচ্চ সংগ্রহ ছিল ১৪২। বল হাতে নেন ৮৫ উইকেট। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২৪৬ ম্যাচ খেলে ৩৯ শতক এবং ৮৩ অর্ধশতকে রান করেন ১৬,১২৮। বল হাতে নেন ৪৮৬ উইকেট।
তাঁর সময়ে তিনি ছিলেন নিউজিল্যান্ডের একমাত্র পারফর্মার। দলগত খেলায় আসলে একা খেললেই হয় নাহ, সবাইকেই খেলতে হয়। একটা উদাহরণ দেই, ১৯৬৩ সালে ইংল্যান্ড সফরে প্রথম ইনিংসে লিড নেয় নিউজিল্যান্ড। দ্বিতীয় ইনিংসে তার সেঞ্চুরি সত্ত্বেও কিউইরা অলআউট হয় মাত্র ১৫৯ রানে। ক্রিকেট ইতিহাসে কেউ সেঞ্চুরি করার পর এটাই দলীয় সর্বনিম্ন স্কোর।
ক্রিকেট থেকে অবসরের পর ১৯৬৯ সালে তিনি সর্বপ্রথম দক্ষিণ মেরুতে ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজনের উদ্যোগ নেন। এরপর নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলের নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চার বছর। পরবর্তীতে আইসিসি ম্যাচ রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রায় ১০ বছর। ২০০৩ সালে তিনি নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
ক্রিকেট মাঠে ছিলেন সব্যসাচী এক ক্রিকেটার, অবসরের পরও তাই। সেখানেই ক্রিকেট সেখানেই ছিলেন এই ক্রিকেটপ্রেমী। ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন পুরো পৃথিবীতে। ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর ৯২ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন এই আজন্ম ক্রিকেটপ্রেমী।