টেনিস কাব্যে উপেক্ষিত ‘মিস্টার বরফশীতল’

১৯৫৬ সালের ছয় জুন। স্টকহোমে জন্মেছিলেন টেনিসের এক উদাসীন সন্ন্যাসী – বিয়ন বর্গ।

একটা সময় কোন ম্যাচ হেরে গেলে সেই ব্যথার ফলশ্রুতিতে তিনদিন কোন কথা না বলা এই প্রবাদ আচমকাই মানসিক ভাবে পাল্টে যান ১৯৮১ থেকে, যেবার উইম্বলডন ফাইনালে জন ম্যাকেনরোর কাছে ৬-৪, ৬-৭, ৬-৭, ৪-৬ হারের পরে তিনি বলেছিলেন ‘What shocked me was I wasn’t even upset.’

তখন তার বয়স ছিল সদ্য অতিক্রান্ত পঁচিশ। এই ‘আপসেট’ না হয়ে খেলার ক্ষিদে মরে যাওয়াটাই একসময় চাপের মুখে সেরা টেনিস খেলে যাওয়া তাকে ক্রমশ টেনিসবিমুখ করে তুলেছিল এবং তাঁর অবসরকে করেছিল ত্বরাণ্বিত।তখন থেকেই জন্ম হয়েছিল টেনিসের এই উদাসীন সন্ন্যাসীর।

৬৬টি কেরিয়ার সিঙ্গলস টাইটেল, চারটি ক্যারিয়ার ডাবলস টাইটেল, ৬৪৪-১৩৫ ক্যারিয়ার সিঙ্গলস রেকর্ড, ৮৬-৮১ কেরিয়ার ডাবলস রেকর্ড, ৬টি ফ্রেঞ্চ ওপেন টাইটেল (১৯৭৪, ১৯৭৫, ১৯৭৮, ১৯৭৯, ১৯৮০, ১৯৮১), টানা পাঁচটি উইম্বলডন টাইটেল (১৯৭৬, ১৯৭৭, ১৯৭৮, ১৯৭৯, ১৯৮০) – মোট ১১ টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম টাইটেল দিয়ে তাঁকে মাপা যায় না। মাপা যায় না চারবার ইউএস ওপেন রানার আপ হওয়া (১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৮০, ১৯৮১) বা জীবনে একবারই অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে অংশ নিয়ে তৃতীয় রাউন্ডে হেরে যাওয়া দিয়েও।

২৬ বছর এবং ২৭ বছরের মাঝামাঝি আচমকা অবসর ঘোষণা, প্রধান প্রতিদ্বন্দী ম্যাকেনরোর কথাতেও ফিরে না আসা, ব্যবসায়িক ব্যর্থতায় প্রায় দেউলিয়া হতে হতে বেঁচে যাওয়া বা ১৯৯১-১৯৯৩ সার্কিটে ফিরে আসার ব্যর্থ চেষ্টা দিয়েও তাকে মাপার চেষ্টা করা ভুল।

বরং তাঁর বরফশীতল খেলার স্টাইল তাকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে টেনিসের ইতিহাসে। প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে তার তূণে ছিল দুই হাতের ব্যাকহ্যান্ড স্ট্রোক, যাতে ডানহাতের ব্যবহার বেশি থাকত। বেসলাইন থেকে শক্তিশালী গ্রাউন্ড স্ট্রোক, কোর্টের পিছন দিক থেকে জোরালো টপস্পিন এসবের সমাহারেই এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য সৃষ্টি হত।

যার আগুন পুড়িয়ে দিত তার প্রতিদ্বন্দীরা সমেত ভালো খেলার চাতক টেনিস দর্শককুলকে। যার সাক্ষী ছিল সত্তর দশকের শেষার্ধর আন্তর্জাতিক টেনিস। কাঁধ অবধি লম্বা চুল, হেডব্যান্ড, খেলার স্টাইল, নম্র ব্যবহার আর আকর্ষণীয় উপস্থিতি, সব মিলিয়ে এক ‘অপ্রতিরোধ্য আইকন’ হয়ে গিয়েছিলেন তখন তিনি।

আজও টেনিসের এই উদাসীন সন্ন্যাসীকে সশ্রদ্ধ সম্মান দেওয়া হয় বিশ্ব টেনিসের আঙ্গিনায় তার ঐ স্টাইল এবং শান্ত, সমাহিত টেনিসের জন্য, যার প্রথম বড় টেনিস আসরে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল মাত্র ১৭ বছর বয়সে সুইডেনের হয়ে ডেভিস কাপে জয়ের মধ্য দিয়ে এবং যিনি প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছিলেন মাত্র ১৮ বছর বয়সে।

১৯৮০ সালে, ২৪ বছর বয়সে তার আত্মজীবনী ‘বিয়ন বর্গ, মাই লাইফ অ্যান্ড গেম’ প্রকাশিত হয়েছিল, অনুলেখক ছিলেন ইউজিন স্কট। ১৯৮৭ সালে তিনি স্থান পেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক টেনিসের ‘হল অফ ফেম-এ। প্রায় দেউলিয়া অবস্থায় ২০০৬ সালে একটি ব্রিটিশ নীলামাগার বনহ্যাম অকশন হাউসে তাঁর সব উইম্বলডন ট্রফি ও দুটি র‌্যাকেট তিনি নিলামে তোলেন।

কিন্তু, শেষ অবধি তা নিজেই কিনে নেন, যার পিছনে প্রধান কারণ ছিল জন ম্যাকেনরো, জিমি কোনর্স ও আন্দ্রে আগাসি সহ আরো অনেকের ওই নিলামের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া। ২০০৬ সালেরই ১০ ডিসেম্বর বিবিসি-র পক্ষ থেকে তাকে একটি জীবনকৃতী সম্মান পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল, যা তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন বরিস বেকার। ২০১৪ সালে ‘ডাগেনস নাইহেটার’ পত্রিকা তাঁকে সুইডেনের সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে চিহ্ণিত করে। তবু, টেনিস কাব্যে তিনি বরাবরই উপেক্ষিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link