কখনও সময় আসে আর জীবন মুচকি হেসে ঠিক এমন কিছু করিয়ে নেয় যে পুরো ইতিহাসটাই বদলে যায়। খেলাধুলোর ক্ষেত্রেও তাই, অমল দত্ত ভবানী রায়কে দিয়ে ডান প্রান্ত বরাবর উঠে নেমে খেলতে বললেন আর ভারতীয় ফুটবলে ওভারল্যাপিং সাইড ব্যাক এক ইতিহাস তৈরি করে ফেলল। ১৭ রানে ৫ উইকেট পড়ে যাবার পর অধিনায়ক কপিলদেব রামলাল নিখাঞ্জ একটা হ্যারিকেন ১৭৫ রানের ইনিংস খেললেন।
আবার ফাইনালে মাত্র ১৮৩ বাঁচাতে নেমে প্রলয় নাচনকারী ভিভ রিচার্ডসের একটা ক্যাচ পিছন দিকে ৩০ গজ দৌড়ে ধরে ফেললেন আর ভারতের ক্রিকেট অন্যান্য সব খেলাকে হারিয়ে পরবর্তী ইয়ত্তাহীন বছরের জন্য এক নম্বর খেলা হয়ে দাঁড়াল। অথবা নিউজিল্যান্ডের ট্যারাবাঁকা মাঠের উপযোগী হিসাবে মার্ক গ্রেটব্যাচকে মার্টিন ক্রো ওপেন করতে পাঠালেন। আর সমগ্র সীমিত ওভারের ক্রিকেটের ইতিহাস পালটে গেল। ১৯৮৫র উইম্বল্ডন ১৭ বছরের বরিস বেকার বুমবুম সার্ভিসের দৌলতে রুপোর ট্রফিটা জিতে নিলেন আর সমগ্র টেনিস পাওয়ার টেনিস হয়ে গেল।
এইরকমই ভারতের মেয়েদের ক্রিকেটের কথা যদি বলি তাহলে সন্ধ্যা আগরওয়ালের ১৯০, মিতালী রাজের দ্বিশতরান বা ঝুলন গোস্বামীর ৬ উইকেট পেরিয়ে যে পারফরম্যান্সটা ভেসে আসে যা মেয়েদের ক্রিকেটকে আপামর ভারতীয় দর্শকের কাছে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে, সেটি হল হারমানপ্রীত কৌরের ২০১৭ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে করা ১৭১।
২০শে জুলাই, ২০১৭। তারিখটা এখন ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। পাঞ্জাবের একটি ছোট্ট শহর, মোগা। সেই মোগার মেয়ে হরমনপ্রীত, ১৭ নম্বরের নীল জার্সি পরে ব্যাট করতে যখন নামলেন, তখন ক্রিকেটদেবী কোথাও না কোথাও হয়তো মুচকি হেসেছিল। বহুদিন ধরে মেয়েদের ক্রিকেটকে ভারতীয় দর্শক এবং শূন্য দশকের পর বিসিসিআই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে রেখে দিয়েছিল। সেই ২০ জুলাই, ২০১৭ থেকে একটু একটু করে পাল্টাতে শুরু করল।
মেয়েদের ক্রিকেট। সেটা খায় না মাথায় মাখে, ট্রাউজার পরা মেয়েদের খেলা দেখব না অন্য কিছু, ছয় মারতে পারে ওগুলো, স্মৃতি মান্দানা তার বিস্ফোরক ব্যাটিং-এর থেকেও সৌন্দর্যের কারণে নেট দুনিয়ায় অধিক সার্চিত। এসবগুলো শুধুমাত্র কিছু মন্তব্য বা তথ্য নয়, অনাদি অনন্ত সময় থেকে চলে আসা বঞ্চনা এবং শুধুমাত্র শারীরিক শক্তির ভিত্তিতে পূর্বনির্ধারিত কিছু বস্তাপচা কনসেপ্টের সোচ্চার বিজ্ঞাপন।
২০ জুলাই, ২০১৭ মোগার ওই লম্বা রোগা কালোমতো মেয়েটা সব বঞ্চনা, সব অবিচারের জবাব দিতে যেন ধার করা ব্যাট নিয়ে নেমেছিলেন। কাঁধে চোট, হাতের আঙুলে চোট, কিন্তু মাথাটা পরিষ্কার তাঁর। কী করতে হবে সে বিষয়ে।
প্রতিটি অ্যাড্রেনালিন ফ্লোর ক্ষেত্রে একটা ট্রিগার থাকে, সেই ট্রিগার যথাযথ সময়ে চাপ দিলেই মেশিনগানের মতো অ্যাড্রেনালিন বইতে থাকে ধমনী ধমনী, শিরায় শিরায়।
একটা নো বল, ফ্রি হিট, ছয়! এর আগেও ছয় মারা হয়েছে, যারা ওই ফালতু বৈষম্যমূলক প্রশ্নটি করে তাদের জন্য সপাৎ উত্তর, হ্যাঁ মেয়েদের ক্রিকেটে এর আগেও ছয় মারা হয়েছে। কিন্তু তাতে কিছু পাল্টায়নি। মেয়েদের ক্রিকেটের ফ্যান, দর্শক, স্পনসরশিপ, এমন কি নিয়ামক সংস্থা বিসিসিআইএর দৃষ্টিভঙ্গীও।
বৃহস্পতিবার, ২০ জুলাই, ২০১৭। বিশ্বকাপ সেমি ফাইনাল, বিপক্ষে ৬ বারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। হরমনপ্রীতের ব্যাটে বলে হচ্ছিল। ফুটওয়ার্ক ঠিকঠাক হচ্ছে। ২ উইকেট দ্রুত পড়ে যাবার পরে বৃষ্টি বিঘ্নিত ৪২ ওভারের ম্যাচের জন্য ভারত মোটামুটি একটা টার্গেট রেখেছিল, কোচ তুষার আরোঠে থেকে অধিনায়ক মিতালী রাজ সবাই জানতেন যে ২৫০ করলে চাপে ফেলা যাবে।
বেশ কিছু বছর ধরে ভারতের ব্যাটিং মিতালী রাজকে ঘিরেই। আগের বাঁচামরার শেষ গ্রুপলিগ ম্যাচে মিতালী রাজের সেঞ্চুরির উপর ভিত্তি করেই জেতে ভারত। কিন্তু সেখানেও হরমনপ্রীত একটি দায়িত্বপূর্ণ ৯০ বলে ৬০ রানের ইনিংস খেলেছেন। টাচেই আছেন হরমনপ্রীত। কয়েকদিন আগেই অধিনায়ক মিতালী রাজ সাংবাদিক সম্মেলনে বিস্ফোরণ ঘটালেন। জুনিয়র ক্রিকেটারদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। হারমানপ্রীত সেই দায়িত্ব নিতে শুরু করেছেন।
২০ ওভারে ৭০ রানে ২ উইকেট। দেখে খেলছেন হারমানপ্রীত, মিতালী রাজের সঙ্গে। ব্যবহার করছেন স্মৃতি মন্দানার ব্যাট। আগের দিন প্র্যাকটিসে নেট থেকে বেরিয়ে আসার পর স্মৃতির ব্যাটগুলো হাতে নিয়ে নাড়তে চাড়তে গিয়ে হঠাৎ একটা ব্যাট যেন হাতে সেট করে গেল। এখনকার সুপারস্টাররা ব্যাট নিয়ে সুপারস্টিসাস, খুঁতখুঁতে। স্মৃতির কিন্তু নিজের সহঅধিনায়ককে নতুন ব্যাট দিয়ে দিতে অসুবিধা হল না।
কিন্তু ব্যাট ধরা? বিশ্বকাপের মাস দশেক আগে একটা আঘাত আসে বাঁ হাতে। মধ্যমা এবং অনামিকার মধ্যের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। সেরেছে বটে, কিন্তু ঠিকভাবে সারার সময় পায়নি। ফলে দীর্ঘ বিশ্বকাপের শেষ পর্যায়ে ব্যাট ধরতে অসুবিধা হচ্ছে। বাঁ হাত থেকে ব্যাটের গ্রিপ সরালে গ্লাভস খুলে ব্যাটের হাতল ধরে সেই অবস্থায় ব্যাট সরিয়ে গ্লাভস পরে ব্যাটের হাতল ঢুকিয়ে ডান হাতে নিচে ধরতে হচ্ছে। এতটাই অসাড় হয়ে আছে বাঁ হাত। তবু হরমনপ্রীতের মনে হচ্ছে ছন্দেই আছেন।
বার বার মিতালীকে বলছেন অবশ্য, ‘দিদি ঢাইশো সে নেহি হোগা!’ আসলে অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাস লিগে খেলেন হরমনপ্রীত। মেয়েদের বিগব্যাস ডব্লিউবিবিএল। খুব ভালো করে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইনআপকে চেনেন। জানেন যে ৯ নম্বর ব্যাট পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার সেঞ্চুরি করার ক্ষমতা আছে। ‘কামসে কাম অউর বিশ তিশ রান চাহিয়ে। মুঝে খুলকে খেলনে দো দিদি!’ মিতালী ভয় পাচ্ছেন। হরমনপ্রীতের উপরই ভরসা করা যায়। কিন্তু হরমনপ্রীত আউট হয়ে গেলে? শেষে ২৫ ওভারের শেষ বলে মিতালীই আউট হলেন। যাবার সময় হরমনপ্রীতকে বলে গেলেন, বলের মেরিট অনুযায়ী খেলতে। অর্থাৎ যেমন কুকুর তার তেমন মুগুর।
আসলে মেয়েদের ক্রিকেটে এখনও ভিডিও অ্যানালিস্ট আসেনি সেভাবে। বিপক্ষের প্রতিটি ব্যাটসম্যানকে নিয়ে কাটাছেঁড়া হয় না। সাম্প্রতিক ভিডিওও পাওয়া যায় না। কিন্তু ডব্লিউবিবিএল অন্যরকম। আর হরমনপ্রীত প্রথম ভারতীয় যিনি বাইরের টি-টোয়েন্টি লিগ খেলেছেন। ডব্লিউবিবিএল-এ সকলের ভিডিও অ্যানালিসিস হয়। হরমনপ্রীত তাই জানতেন যে আড়াইশ যথেষ্ট নয়।
আড়াইশ যথেষ্ট নয়,আরেক ওভার গেল, হারমানপ্রীত অপেক্ষা করছেন। সাতাশতম ওভার কার্স্টেন বিমস ডান হাতি লেগব্রেক করছেন। প্রথম তিনটে বলে হারমানপ্রীত কিছু করতে পারলেন না। দ্বিতীয় বলে সামান্য পুস করেছিলেন এক রানের জন্য, হয়নি। চতুর্থ বলটি হঠাৎ কার্স্টেনের হাত ফসকে হরমনের মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। নো বল। ফ্রি হিট!
এই সেই ট্রিগার। হরমনপ্রীত বলেন যে সারা ম্যাচে একটা ছয় না মারলে যেন মনে হয় খাইনি কিছু। ঠিক যেন চর্বচোষ্য গিলে উঠে যদি একটা কাঁচাগোল্লা টপ করে মুখে না ফেললাম তাহলে জনম গেল বৃথা টাইপ হয়ে গেল। হরমনপ্রীত নো বলটায় সিঙ্গল নেননি। ভারতের কপাল!
প্রাক্তন ইংল্যন্ড অধিনায়ক শার্লোট এডওয়ার্ডস ধারাভাষ্য দিতে গিয়েই যেন আঁচ করলেন। ফ্রি হিটের বলটা হবার আগেই বললেন সেই কথা, ‘কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে, যা ভবিষ্যতের সংজ্ঞা নিয়ে আসে। মনে হয় এটাই সেরকম কিছু হতে পারে!’ ঠিক সময়ে হারমানপ্রীত স্টেপ আউট করলেন আর বল জায়গা নীল লঙ অনের গ্যালারিতে। নো বলটার আগে পর্যন্ত হরমনপ্রীতের রান ছিল ৬০ বলে ৪১। আর তারপরে?
মেয়েদের ক্রিকেটে দর্শক নেই! মেয়েদের ক্রিকেট অনুত্তেজক, বোরিং! এসব কথা ওই লঙ অনে ফেলে দেওয়া হল। তারপরের বলটা তিরবেগে এক্সট্রা কভার আর মিডঅফের মাঝখান দিয়ে চলে গেল সীমানার বাইরে।
প্রতিটি অবিশ্বাস্য ঘটনাই যেন অকিঞ্চিৎকর জায়গায় ঘটে থাকে। অন্তত: ভারতীয় ক্রিকেটে। অন্ততঃ প্রথম দিকে তো বটেই। টানব্রিজ ওয়েলসের নাম কেউ কখনও শুনবে না, আগেও শোনেনি। কিন্তু ওই ১৭৫টা রান তাকে অমর ইতিহাসে জায়গা করে দিয়ে চলে গেল। তেমনই, ডার্বি ইংল্যন্ডের শহরগুলির তুলনাতেও খুবই ছোট্ট শহর। কিন্তু সেখানেই ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের ইতিহাস বদলে গেল। নাহ ওই ইনিংসে ভারত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় নি। কিন্তু টিভি ভিউয়ারশিপ, স্পনসরশিপ আর সার্বিকভাবে নারী ক্রিকেটের বাণিজ্যিকরণ এবং প্রচারের কথা চিন্তা করলে ওই ইনিংসটা অতুলনীয়। আর ইনিংসের কথা চিন্তা করলে ওই লঙ অনের উপর দিয়ে ছয়টার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
অথচ সেমিফাইনাল খেলার দিন ভারতীয় দলের বাহ্যিক অবস্থা একদম স্বস্তিদায়ক ছিল না। এক মাস ব্যাপী বিশ্বকাপ আর তার আগের লম্বা লম্বা ট্যুর ইতিমধ্যেই খেলোয়াড়দের শরীরে হানা দিতে শুরু করেছে। ফিজিও ট্রেসি ফার্নান্ডেজ প্রতিদিন সকালে প্রচুর পরিশ্রম করে তবে সবাইকে ম্যাচ ফিট করে তুলতে পারছেন।
২০ জুলাই, ২০১৭, ডার্বি শহরে ফিজিওর টেবিলে এতটাই দেরি হয়ে গেছিল যে ভালো করে সকলে ব্রেকফাস্টও করে উঠতে পারেননি। মাঠে এসে ভারতীয় দর্শকদের থেকে আপেলটা কলাটা মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিঙাড়া কচুরিও পড়েছিল পেটে। ট্রেসি ভয় পেয়ে গেছিলেন, শিঙাড়া খেলোয়াড়দের জন্য বিষ। তাও আবার ঠাণ্ডা শিঙাড়া। কিন্তু খেলা চলাকালীন ট্রেসি মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন যে অন্তত: পেটে শিঙাড়া তো পড়েছিল। সামান্য মাঠ, ছোট্ট শহর, একটা খাবার দোকান নেই। নারী ক্রিকেটের হাই ভোল্টেজ সেমি ফাইনাল হচ্ছে বিশ্বকাপের।
কোচ তুষার আরোঠে মাঠে আসার আগেই অবশ্য দেখে নিয়েছেন সেদিনকার আবহাওয়ার পূর্বাভাস। অংশত মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি। এসব করেই সময় কেটে যাচ্ছে আর টেনশনের পারা চড়ছে। কিন্তু ভারতীয়রা তো টেনশন করতে মাঠে আসেননি, তাঁরা সকালের হাসিখুশি মুড মাঠেও নিয়ে চলে এসেছেন। ড্রেসিংরুম জুড়ে তখন ম্যানেজার তৃপ্তি ভট্টাচার্যের মোবাইলের একের পর এক হিন্দি চটুল গান ভেসে চলেছে আর হারমানপ্রীত, স্মৃতি, ,বেদা, মোনা মেশ্রামরা উদ্দাম নেচে চলেছেন। শিখা পাণ্ডে চুপচাপ টাইপের মেয়ে। বাইরে বসে, দর্শকাসন থেকে জিজ্ঞাসা করা হল যে ভিতরে কী হচ্ছে? শিখা জানালেন, ‘প্রস্তুতি চলছে!’
অস্ট্রেলিয়ার প্রস্তুতি বরং অনেক বেশি সিরিয়াস। চ্যাম্পিয়ন দল অস্ট্রেলিয়ার। কে নেই! অধিনায়ক মেগ ল্যানিং, বেথ মুনি, এলিস পেরি, এলিসা হিলি (অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন উইকেট রক্ষক ইয়ান হিলির বোন এবং বর্তমান পেস বোলার মিশেল স্টার্কের সহধর্মিনী)। বাঘা বাঘা সব পারফর্মার। সীমিত ওভারের শের। তাঁরা চুপচাপ মন:সংযোগ করছেন। ভারতীয় দলের ম্যানেজার তৃপ্তি ভট্টাচার্য প্রার্থনা করে যাচ্ছেন যেন ভাঙাচোরা ম্যাচ না হয়। অন্য দিকে হারমানপ্রীত।
হল্লার মধ্যেও মনে মনে প্রার্থনা করে যাচ্ছেন, ‘যা হবে আজই হোক। আজই রফাদফা করে দিতে হবে!’
ম্যাচ শুরু হতে দেরি হল, ম্যাচ ৪২ ওভারের। প্রথম ওভারেই স্মৃতি আউট। প্রতিভাসম্পন্ন খেলোয়াড় স্মৃতি, এই বিশ্বকাপেই সেঞ্চুরি ছিল। মিতালী আর পুনম ধরে খেলে দশম ওভার অবধি টানার পরে পুনমও।
হরমনপ্রীতের প্রিয়তম ব্যাটিং অর্ডার চার নম্বর। কিন্তু চার নম্বরে বেশ কিছুদিন হল নামছেন না তিনি। টিম ম্যানেজমেন্টের মনে হয়েছিল যে শেষের দিকে বড় শট নেওয়ার এবং টেল এন্ডারদের সঙ্গে খেলার লক নেই। তাই পাঁচ কিংবা ছয়। বিশ্বকাপের প্রথম দিন ছাড়া এইই চলছিল। কিন্তু গ্রুপের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তুষার আরোঠে আর মিতালী রাজ সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘নাহ, হরমনকে তাঁর পুরনো জায়গাই ফিরিয়ে দিতে হবে’। দ্রুত ফল পাওয়া গেল। বাঁচা মরার নিউজিল্যাণ্ড ম্যাচে ৬০ রান।
যদিও তুষার আরোঠে বলে রেখেছিলেন হারমানপ্রীতকে খেলা যদি মাত্র ২০ ওভারের হয় তবে হরমনকেই স্মৃতির সঙ্গে ওপেন করতে হবে। কিন্তু খেলা মোটামুটি দ্রুতই শুরু হল আর হরমন নামলেন চার নম্বরে। দশম ওভার, অ্যাশলে গার্ডেনারের বলে বেথ মুনির হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে এসেছেন পুনম। হরমন নামলেন, কাঁধে ব্যান্ডেজ, কনুইয়ের উপরে ব্যান্ডেজ। কিন্তু হরমন প্রস্তুত। বাঁ হাতটা প্রতিটি শটে টনটন করে উঠছে। কিন্তু হরমন প্রস্তুত। বল করতে এলেন মেগান শ্যুট। মেয়েদের ক্রিকেটে অন্যতম দ্রুততম বোলার। প্রথম বল্টাই ঝনঝন করে উঠল ডিফেন্স করতেই। গ্লাভস খুলে বাঁ হাতের মধ্যমা আর অনামিকাতে হালকা ম্যাসাজ করে নিয়ে আবার গ্রিপ তৈরি করে গ্লাভস পরে তৈরি হলেন হরমন।
এভাবেই পঁচিশ ওভার। মিতালী আউট। যদিও ভারতের মিডল অর্ডার মন্দ নয়। তবু হরমনপ্রীত জানেন আরেকটা উইকেট পড়ে গেলে অস্ট্রেলিয়া চালকের আসনে বসে যাবে। আরোঠে তাই বেদার আগে পাঠালেন দীপ্তিকে। ২০ বছরের দীপ্তি শর্মা, ঝুঁকিহীন ব্যাটিং করতে সক্ষম। তার উপর বাঁ হাতি ফলে দুই বাঁ হাতি স্পিনার জেস জোনাসেন আর কার্স্টেন বিমস আর লেগস্পিনার গার্ডনারকে সামলাতে সক্ষম হবেন দীপ্তি, এই ছিল ভাবনা।
হরমন দীপ্তিকে বোঝালেন যে বল স্পিন করছে না এবং ব্যাটে সুন্দর আসছে। অতএব সিঙ্গল নিয়ে হারমানকে স্ট্রাইক দিতে নির্দেশ দিলেন। কারণ, ততক্ষণে হারমানের অধিনায়ক লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছেন, বল দেখে হাত খোলার।
ছয়টা তখনই এল। বাঁ হাতি স্পিনারের টেনে দেওয়া বল লম্বা হরমন স্টেপ আউট করতেই ব্যাটের ডগায় পেয়ে গেলেন। ব্যাটে বলে সঙ্গোগের পরেই আর তাকাননি বলের দিকে। লং অন মাথা উঁচু করে দেখল যে সাদা বল উড়ে যাচ্ছে মেঘলা আকাশের বুক চিরে। বকের উড়ে যাওয়া যদি নান্দনিক হয় ক্রিকেট পাগলদের কাছে মাথার উপর দিয়ে বল উড়ে যাওয়াটাও।
খেলাটাই যেন পালটে গেল তারপর, বীরেন্দ্র শেবাগ হারমানপ্রীতের প্রিয়তম ক্রিকেটার। কিন্তু তারপর যে তাণ্ডব চলল তাতে সেহবাগও গর্বিত বোধ করতে পারতেন। ওই ছয় দিয়ে শুরু, অস্ট্রেলিয়ার বিচিত্র বন্য রুক্ষ্ম জান্তব শ্রেষ্ঠত্বকে পোষ মানানো চলতে থাকল পরের ওভারগুলোতে।
জেস জোনাসেন সেই সেমি ফাইনাল পর্যন্ত সবথেকে কার্যকরী বোলার ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার। যখনই দরকার পড়েছে অধিনায়ক মেগ ল্যানিং বল তুলে দিয়েছেন জেসের হাতে। জেস নিরাশ করেননি। নতুন হোক বা পুরনো বল, উইকেট তুলে নিয়েছেন তিনি।
২০ জুলাই, ২০১৭, জেসের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল হারমানপ্রীতের ব্যাটে। তারপর জেসের ২০টা বলে ৪৫ রান করেন হরমনপ্রীত। স্টেপ আউট করলেই ব্যাটে বলে হচ্ছে যেখানে সেখানে জেস বা কার্স্টেন বা গার্ডনারের মতো সামান্য নশ্বর মানুষ কী করবেন!
বিশ্বকাপের আগে, নেটে, হরমনপ্রীত বিশেষ করে স্পিনারদের বিরুদ্ধে অনুশীলন করে জলভাত করে রেখেছেন। আর যেদিন সবকিছুই সোনা হয়ে যাচ্ছে, সেদিন তো জলভাতও পায়েসের মতো সুস্বাদু হয়।
সময় যত এগোচ্ছে সেঞ্চুরি যত কাছে আসছে টেনশনের জায়গায় একাগ্রতা মনোসংযোগ আর অদম্য আবেগ জায়গা করে নিচ্ছে মস্তিস্ক জুড়ে। ছয় চার আর আবেগের মুঠো ভরা প্রকাশ। কিন্তু বিস্ফোরণ ঘটল সেঞ্চুরির বলটায়। কার্স্টেনের বলে মিড উইকেটে ঠেলে ছুটলেন হরমনপ্রীত, একের পরে দুই, স্বচ্ছন্দে পূরণ করে ফিরে দেখলেন ছুটে আসা বল গ্লাভস খুলে ধরে ডান হাতে ছুঁড়ে দিচ্ছেন হিলি আর কার্স্টেন যখন বল ধরে উইকেট ভাংছেন তখন দীপ্তি ঝাঁপ দিয়ে রান আউট বাঁচাচ্ছেন। দুই রানের ক্ষেত্রে দোনামনা করছিলেন দীপ্তি। বিস্ফোরণ হল। সেঞ্চুরি হয়েছে কি হয়নি হরমনের মনে নেই। তার মাথার মধ্যে ২৭০ চলছে। এই সময় একটা সামান্য দুর্ঘটনা সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেবে।
পাঞ্জাবি, হরিয়ানভি আর চলতি মুম্বাইয়া মিলিয়ে বাছাবাছা শব্দগুলো জলোচ্ছ্বাসের মতো ফেটে পড়ল দীপ্তির কানে। প্রায় চার বছর পরে করা সেঞ্চুরির মাহাত্ম তখন সেই ঝঞ্ঝাবাতের পিছনে মুখ লুকিয়েছে। সেঞ্চুরি পরে হবে, আগে ২৭০। সেই লক্ষ্য যেন বিচ্যুত না হয়। দীপ্তি ভয়ে, দু:খে কেঁদে ফেললেন। কিন্তু ঝড় এসে ফিরে গেছে সমুদ্রাভিমুখে। তারপরেই কাঁধে হাত দিয়ে দীপ্তিকে সান্ত্বনা দিলেন হারমানপ্রীত, যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে। এখন শত্রু শিবিরে লড়াইটা পোউঁছে দিতে হবে।
দীপ্তি বুঝতে পারলেন এরপর সত্যিই বোধহয় কিছু একটা হতে যাচ্ছে। হলও। সকালে অভুক্ত থাকার ফল আসতে শুরু করেছে। হ্যামস্ট্রিং জবাব দিতে শুরু করেছে। ট্রেসি আর অতিরিক্ত ক্রিকেটার মোনা ছুটে গেলেন মাঠে। স্ট্রেচিং, প্রয়োজনীয় ম্যাজিক স্প্রে। নার্ভ শান্ত করতে দরকার পড়ল। আর তারপর? তারপর সেঞ্চুরির সময় ১১১.১১ স্ট্রাইক রেট শেষ ২৫ বলে লাফ দিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো ২৮৪-তে। স্পিনার পেসার কেউ কোনও পাত্তা পেল না। শেষ ২৫ বলে ৭১, আটটা চার আর পাঁচটা ছয়। মিড উইকেট বাউন্ডারির ফিল্ডাররা সামান্য বলগার্লে পরিণত হয়েছেন। বাউণ্ডারির বাইরে থেকে বল তুলে নিয়ে আসা ছাড়া বিশেষ করণীয় কিছু নেই তাঁদের। ৪০ ওভারে ছিল ২৪৯। শেষ করল ভারত ৪২ ওভারে ২৮১ রানে। শেষ ১০ ওভারে ১১৯। সেই বিশ্বকাপের সেরা স্লগ ওভার ব্যাটিং।
১৫০ করে প্রথম ব্যাট তুলে মাইলফলককে অভিবাদন জানালেন। লক্ষ্যের আগে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বিশ্বকাপের সেরা চামারি আটাপাট্টুর ১৭৮ অপরাজিতর রেকর্ড বেঁচে গেল শুধু শেষ ওভারের শেষ চারটে বলের মাত্র একটা খেলতে পারলেন হরমন। ১৭১ অপরাজিতা।
আর অপরাজিতা হরমন ভঙ্গুর শরীরে এক ঝটকায় ভারতীয় নারী ক্রিকেটকে তারাদের দেশের আশেপাশে পৌঁছিয়ে দিলেন। খেলাটা অবশ্যই ভারত জেতে তবে অস্ট্রেলিয়া লড়াই করতে ছাড়েনি। অ্যালেক্স ব্ল্যাকওয়েলের ৯০এর উপর ভর করে ২৪৫ অবধি পৌঁছয় তারা। হরমনপ্রীত ঠিকই বলেছিলেন। ২৫০ হলে হয়ত হত।
যদিও ফাইনাল হারে ভারত ৯ রানে। মাত্র। তবুও সে হার তো হার নয়। এতদিনের বঞ্চনা, সংস্কার এবং তাচ্ছিল্যের বিরুদ্ধে এক সোচ্চার প্রতিবাদের পর সত্যিকারের জয়।
দর্শক এসেছে মেয়েদের ক্রিকেটে। ফেসবুকে ঘটা করে ফ্যানক্লাব শুরুহয়ে গেছে। হরমনপ্রীতের ছবি আজকাল ছোটছোট ছেলেমেয়েদের দেওয়ালে পোস্টার। ঝুলন, মিতালী রাজ, শেফালী ভার্মা, স্মৃতি মন্দানাদের এখন ছেলে মেয়ে বুড়ো ছুঁড়ি এক ডাকে চেনে। মেয়েদের আইপিএল হবার কথা হচ্ছে। তিন দল নিয়ে চ্যালেঞ্জার্স ট্রফি হয়েছে। স্পনসর আসছে, বর্তমান প্রশাসকরা গুরুত্ব দিয়ে মেয়েদের ক্রিকেটকে লালনপালন করছেন আর সর্বোপরি বিশ্বাসটা জন্মেছে। ২০১৮’র টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মিতালী রাজকে বাদ দেওয়া নিয়ে ম্যানেজার ও অধিনায়কের সঙ্গে মনোমালিন্য পর্ব পেরিয়ে ২০২০’র প্রাক লকডাউন সময়ে বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টির ফাইনাল খেলাও হয়েছে। এবারে অস্ট্রেলিয়া, হেরে গেছে ভারত। কিন্তু তবু বিশ্বাসটা এসেছে।
আর এসেছে একটা সংস্কৃতিও। ভারতের ক্রীড়া সংস্কৃতি যদিও তলানিতে। তবুও বাবা মায়েরা বাচ্চা মেয়েগুলোকে খেলতে পাঠালে আজকের দিনে শুধু ব্যাডমিন্টন র্যাকেট, সুইমিং কস্টিউম বা অ্যাথলেটিক শ্যুই কিনে দিচ্ছেন না। দাশগুপ্ত স্পোর্টস থেকে ভ্যাম্পায়ার বা এসএসএর কীটও কিনে দিচ্ছে। সক্কালবেলা উঠে বাড়ির মেয়েটাকে শরীর চর্চা করতে পাঠাচ্ছে। নিশ্ছিদ্র অনুশীলনের জন্য নিরন্তর উৎসাহ দিয়ে চলেছে। সারা দেশ জুড়ে হয়তো ১৯৮৩’র বিশ্বকাপ পরবর্তী সময়ের আবেগ নয় তবু ছোটখাটো একটা ঢেউ এসেছে। যে ঢেউয়ের উপরে বসে ক্রীড়া সমুদ্র পেরিয়ে কিছুটা সাবালিকা হয়ে উঠবে ভারতের মেয়েরা। খেলার মাঠে, বাইশ গজে। আর সেই ঢেউয়ে ব্যাট হাতে যে কাণ্ডারির কথা প্রতিবার মনে পড়বে তার নাম হরমনপ্রীত কৌর। পাঞ্জাবের অখ্যাত মোগা গ্রামে এক অবিস্মরণীয় কীর্তিকারী ঘরের মেয়ে।
এবারে তাচ্ছিল্য করতে গেলে মনে পড়বে হারমানের সেই রুদ্রমূর্তি। সিরিয়াস দর্শকদের কাছে মেয়েদের ক্রিকেটও সিরিয়াস হয়ে গেছে, এটাই পরম পাওয়া। আর তার জন্য মাইলফলকের মতো দায়ী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ডার্বির সেই দিন ২০ জুলাই, ২০১৭। অবিস্মরণীয় দিন, শেকল ছেঁড়ার দিন।
কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক