চেতন শর্মাকে শেষ বলে মারা ঐতিহাসিক ছক্কা নাকি ডেনিস লিলিকে ব্যাট উঁচিয়ে মারতে যাওয়া নাকি কিরণ মোরেকে ব্যঙ্গ করে লাফানো ‘বড়ে মিয়া’কে মনে রাখবেন কীভাবে?
ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার এবং অধিনায়ক রে ইলিংওর্থের একটি অদ্ভুত অভ্যাস ছিল। সে লাঞ্চের ঠিক আগের ওভারটি নিজে করতো। পিচের কী অবস্থা, কেমন টার্ন পাচ্ছে/পাবে এগুলাই যার কারণ। লাঞ্চের আগের ওভারে আউট হতে চায় না কোনো ব্যাটসম্যানই। সেটাও ইলিংওর্থের এই ‘স্পেশাল এক্সপেরিমেন্টাল’ ওভার করার অন্যতম কারণ হিসেবেই গন্য করা হয়।
তো এইরকম এক ওভার করেছিলেন সাসেক্সের বিরুদ্ধে,ব্যাটসম্যান ছিলেন জাভেদ মিয়াঁদাদ, ১৯৭০ এর শেষের দিকে মিয়াদাদ সাসেক্সের হয়ে খেলেছিলেন। ওই ওভারে ইলিংওর্থকে মিয়াদাদ ছক্কা মেরেছেন তিনটি।বেচারা ইলিংওর্থ সাহেবের লাঞ্চ তো মাটি হলোই তিনি ওইদিন আর বোলিংয়েই আসলো না। এই ধরনের ছোটোখাটো কিঞ্চিৎ বৈশিষ্ট্যই মিয়াদাদকে আলাদা করেছে অন্যান্য গ্রেট ব্যাটসম্যানদের থেকে।
আর বাকীসব গ্রেট এশিয়ান ব্যাটসম্যানদের মতোন হোমে মিয়াদাদও ছিলেন বিপজ্জনক ব্যাটসম্যান। কিন্তু একটি ব্যাপার সুস্পষ্ট করে বলা দরকার সেটি হলো অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড কিংবা ফায়ার ইন ব্যাবিলনে মানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তাদের দেশেও কিন্তু বড়ে মিয়া ব্যাটিং করেছেন সগৌরবে, মাথা উঁচু করে।
মিয়াঁদাদ আরেক পাকিস্তানি গ্রেট মুশতাক মোহাম্মদের চোখে পড়েছিলেন খুব অল্প বয়সে। তখন তার ব্যাটিং দেখলেই মনে হতো নিশ্চিত ভালো টেকনিকই নিয়েই জন্মেছেন। সেঞ্চুরি করেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের আগমন জানিয়েছেন নিজের অভিষেক টেস্টেই। নিজের তৃতীয় টেস্টে করেছেন ডাবল সেঞ্চুরি।
ক্রাইস্টচার্চে রিচার্ড হ্যাডলি আর ওয়াকায় রডনি হগের বিরুদ্ধে যখন সেঞ্চুরি করেন তখন তার বয়স বিশের ঘরও অতিক্রম করেনি। ৯২ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সবচেয়ে তারকা ব্যাটসম্যান নি:সন্দেহে জাভেদ মিয়াদাদ। ওই বিশ্বকাপে কমবেশি রান করেছেন প্রতি ম্যাচেই। সেমিফাইনালে অর্ধশতক এবং ফাইনালে ক্যারিসম্যাটিক অধিনায়ক ইমরান খানের সাথে ১৩৯ রানের জুটি করেন যেটিই মূলত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ফাইনাল জয়ের ভিত গড়ে দেয়।
মিয়াঁদাদ যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসেন তখন আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হতে লাগলো ওয়ানডে। তাঁর আনঅর্থোডক্স ব্যাটিং এবং সীমিত ওভারের ক্রিকেট যেন একে অপরের ‘ইয়ার বকশি’। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬-এর মধ্যে হওয়া প্রথম ছয় বিশ্বকাপের ছয়টিতেই খেলেছেন তিনি। এ যেন প্রতিভা এবং স্থায়িত্বের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ছয় বিশ্বকাপ খেলার এই অর্জন শুধু আছে আরেকজন ক্রিকেটারের, হুম শচীন রমেশ টেন্ডুলকারের।
এক-দুই রানের জন্যে গ্যাপ খুঁজে পাওয়ার (ওয়ানডেতে মিডল ওভারে এর গুরুত্বপূর্ণ অপরিসীম) পাশাপাশি মিয়াঁদাদ ছিলেন কুইক অন ইজ ফিট। দেরিতে শট খেলার প্রবণতা ছিলো তার। বলের পেসকে ব্যবহার করে নিখুঁত গ্যাপশট খেলতেন অনায়াসে। চাইলেই মিয়াঁদাদকে বলা যায় ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম দিককার সেরা ‘ফিনিশার’।
তাঁর ওয়ানডে রেকর্ড বর্তমান দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করলে কদাচিৎ ‘স্ট্রাইকিং টু আই’ মনে হবে। ১৯৯৬ সালে যখন তিনি অবসরে যান তখন শুধু ডেসমন্ড হেইন্সের তার থেকে বেশি রান ছিল এবং হাতেগোনা কয়েকজনের তার গড় ৪১.৭০ থেকে ভালো ছিল। যে ব্যাপারটা আলাদা করে না বললেই নয় সেটি হলো বিপক্ষের রান তাড়া করে পাকিস্তানের জেতা ম্যাচগুলোতে তার ব্যাটিং গড় ‘whopping’ ৬৬.২৪ এবং প্রায় অর্ধেক ম্যাচেই তিনি ছিলেন নট-আউট। এই প্রসঙ্গে শারজার সেই বিখ্যাত ম্যাচের কথা না বললে পাপ হবে।
চেতন শর্মাকে মারা সেই ছক্কার অনেক গপ্প শুনেছেন। এইবার একটা শুনুন একটি ছড়া। ছক্কা হাঁকানোর পর ছড়াটি পাকিস্তানের স্কুলে বেশ প্রচলিত ছিল।
The desert was burning
Chetan was bowling
Javed was batting
Runs required: four
This had never happened before
Chetan bowled a strange ball
It never touched the ground at all
You know what happened to that ball?
It went straight into the VIP hall.
টেস্ট ক্রিকেটেও তার ব্যাট কথা বলেছে সমান তালে। ১২৪ ম্যাচে ৫২.৫৭ গড়ে রান ৮৮৮২। আশির দশকটাকে বোলারদের সাম্রাজ্য বললেও ভুল কিছু হবে না। রান করা তখন পারতপক্ষে কঠিনই ছিল। সে সময়ে আড়াইশোর্ধ্ব রানের ব্যক্তিগত ইনিংস ছিলো মাত্র চারটি। এর মধ্যে জাভেদ মিয়াদাদেরই ছিল তিনটি।
১৯৮৭ সালে ওভাল টেস্টে তার বিখ্যাত ‘দশঘণ্টা’ ব্যাপী ২৬০ রান ইংল্যান্ডের সিরিজে ফেরার সম্ভাবনাকে একেবারে খুন করেছে। তখনকার সময়ের ক্রিকেট পাওয়ার হাউজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তাঁর পারফরম্যান্স ভালো-মন্দের মিশেলে গড়া।
১৯৮৮ সালের এক এপিক সিরিজে তাঁর অবদান ছিলো অনেক। সেই সিরিজে প্রথমবারের মতোন কোনো সফরকারী দল ক্যারিবিয়ানদের দেয়নি টেস্ট সিরিজ জিততে, ১-১ এ ড্র হওয়া সিরিজে গায়ানা টেস্টে মিয়াঁদাদ করেন সেঞ্চুরি, টেস্টও জিতে পাকিস্তান। ত্রিনিদাদ টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে করেন আরেকটি সেঞ্চুরি। যেখানে পাকিস্তান ১২৯ ওভার ব্যাট করে ড্র নিশ্চিত করে। ম্যাচ যখন ড্র ঘোষণা করা হয় পাকিস্তান তখন জয় থেকে ৩১ রান দূরে ছিলো আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ মাঠ ছেড়েছে এক উইকেট না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে।
অধিনায়ক হিসেবেও বড়ে মিয়া কম যান না। ১৯৮৭ সালে ফয়সালাবাদ টেস্টে মাইক গ্যাটিং আম্পায়ার শাকুর রানার সাথে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে এবং মিয়াদাদ সেখানেও ‘Hue & cry’ ঘটাতে ছিলেন তৎপর। এই টেস্টের সম্পূর্ণ একদিন নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো এই ঘটনায়। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ইংল্যান্ড সফরে যায় পাকিস্তান। বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগে দল তখন কিছুটা হলেও বিপর্যস্ত। কিন্তু বড়ে মিয়া ছিলেন তার মতোনই।
ডেভিড গাওয়ার বলেছিলেন, ‘If trouble was in the air, he could generally be counted on to get involved and I’m sure it was a deliberate ploy. He was a big competitor with a combative spirit, who likened cricket to war.’
পাকিস্তানের অন্যতম সেরা অধিনায়কের স্বীকৃতিরও সে দাবিদার। ইমরান খানের অনুপস্থিতিতে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন যোগ্য হাতে। অধিনায়ক হিসেবে জিতেছেন তারই সমান সংখ্যক টেস্ট। ইমরান খান যদি আশির দশকে পাকিস্তান ক্রিকেট উত্থানের মূল সৌধশিল্পী হন তাহলে জাভেদ মিয়াদাদ তা থেকে খুব দূরে ছিলেন না।