১৯৯৬ সালের উইমেন্স উইম্বলডনের ম্যাচ চলছে। জাপানিজ সেনসেশন কিমিকো ডেটের সাথে সর্বকালের অন্যতম সেরা স্টেফি গ্রাফের। কিমিকো ডেটকে সার্ভ করতে যাবেন এমন সময়ে গ্যালারি থেকে একজনের উদ্দাম চিৎকার, ‘স্টেফি, উইল ইউ ম্যারি মি?’
গ্যালারি জুড়ে হাসির রোল। সার্ভ করতে গিয়েও করলেন না গ্রাফ। নিজেও একটু হেসে কয়েক সেকেন্ড পরে বিয়ের প্রস্তাবে জবাব দিলেন, ‘হাউ মাচ মানি ডু ইউ হ্যাভ?’ উত্তরটি যেন স্টেফি গ্রাফের পাওয়ারফুল ফোর হ্যান্ডের মতোনই সুন্দর।
কিমিকো ডেটের বিরুদ্ধে তো জিতেছেনই, পরবর্তীতে টুর্নামেন্টও নিজের করে নেন এই তারকা।
খুব বড়ো কোনো টেনিস ফ্যান আমি নই। টুকটাক খোঁজখবর রাখা হয়। রজার ফেদেরার-রাফায়েল নাদাল দ্বৈরথই আমার টেনিসের জন্যে বরাদ্দ রাখা কিছুটা সময়ের পুরোটাই কেড়ে নিয়েছে। মাঝে আমি হুয়ান মার্টিন ডেলপোতরোর ফ্যান বনে গিয়েছিলাম। ফেদেরারকে হারিয়ে ২০০৯ এর ইউএস ওপেন জয়ী আর্জেন্টাইন এই খেলোয়াড়ের ফোরহ্যান্ড ফেদেরার এবং নাদালের পরেই সেরা।
মাঠের সাফল্য কিংবা গ্ল্যামার – মাউরিন কনোলি, মার্গারেট কোর্ট, ইভোন গুলাগঙ কাউলি, বিলি জিন কিং – এদের হাত ধরে শুরু। ক্রিস এভার্ট, মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা, মনিকা সেলেস, কিম ক্লাইস্টার্স, মার্টিনা হিঙ্গিস, লিন্ডসে ডেভনপোর্ট, গ্যাব্রিয়েলা সাবাতানি, উইলিয়ামস সিস্টার্স লিস্ট করা শুরু করলে উইম্বলডন-ফ্রেঞ্চ ওপেন-ইউ এস ওপেন শুরু হয়ে শেষ হয়ে যাবে কিন্তু লিস্ট চলতে থাকবে জলতরঙ্গের মতোন।
স্টেফি গ্রাফ, এই দু’শব্দের নামটি শুনলে সবার আগে মনে কী আসে?
শৃঙ্খলা, পেশাদারিত্ব,সাহস,সম্মান,দৃঢ়প্রত্যয় নাকি সবগুলো একইসাথে। স্টেফি গ্রাফ আগে তো ছিলেনই, সম্ভবত এখনো তিনি একমাত্র টেনিস খেলোয়াড় যিনি তার সহজাত গুনের সাথে মানসিক দৃঢ়তার সঠিক সমন্বয় করেছিলেন।
গ্রাফের টেনিস গপ্পোর শুরু তিন বছর বয়স থেকেই। নিজেদের থাকার ঘরেই বাপের দেয়া টেনিস র্যাকেট ঘুরিয়েছেন। বাপ-বেটি দুইজনেই বুঝেছিলেন টেনিসই হবে স্টেফির পরশমণি। স্টেফির প্রথমদিককার অন্যতম টেনিসগুরু ছিলেন স্লোভেনিয়ান কোচ বরিস ব্রেস্কাভার, যিনি আবার শৃঙ্খলাকে দিতেন অনেক গুরুত্ব।
বরিস বেকারেরও গুরু ছিলেন এই কোচ। বরিস বেকারকে সবসময় বলতেন নিজের খেলায় এবং জীবনে আরো শৃঙ্খল হতে। কিন্তু তিনি যখন গ্রাফের কোচ হলেন তখন স্টেফি গ্রাফের নিয়মানুবর্তিতা দেখে স্বয়ং বরিস ব্রেস্কাভারই চমকে গেলেন। এতটাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো স্টেফি।
অনুর্ধ ১২ ইউরোপীয় ট্রফি জিতেই শুরু হয় তার সাফল্যের। মাত্র তের বছর বয়সেই হন প্রো টেনিস প্লেয়ার। নিজের প্রথম মেজর ট্রফি আসে ১৭ বছর বয়সে, হিল্টন হেড টুর্নামেন্টে। ফাইনালে হারিয়েছিলেন ক্রিস এভার্টকে। এই ১৯৮৬ সালেই জিতেছেন মোট ছয়টি শিরোপা।
এর দু’বছর পরে আসলো মাহেন্দ্রক্ষণ। যেকোন টেনিস খেলোয়াড়ের জন্যেই গ্র্যান্ডস্ল্যাম জেতা স্বপ্নের।এই স্বপ্নকে সত্যি করার উদ্দেশ্যেই র্যাকেট হাতে দিন-রাত, মাস-বছর অক্লান্ত পরিশ্রম। ১৯৮৮ সালে স্টেফি গ্রাফ জিতলেন ১/২টি নয় পুরো চারটিই গ্র্যান্ডস্ল্যাম। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ইউএস ওপেন, ফ্রেঞ্চ ওপেন এবং উইম্বলডন।
সে বছর দেশের হয়ে জিতেছেন অলিম্পিকে সোনাও। স্টেফি নিজে এই অর্জনকে বলেন ‘গোল্ডেন স্ল্যাম’ নামে। মোট জিতেছেন বাইশটি গ্র্যান্ডস্ল্যাম। ৩৭৭ সপ্তাহ ছিলেন নারী টেনিসের এক নম্বর র্যাংকিংয়ে, যার মধ্যে ১৮৬ সপ্তাহ ছিলেন একটানা। ক্যারিয়ারে একক ১০৭ এবং দ্বৈত ট্রফি জেতার সংখ্যা ১১।
স্টেফি গ্রাফকে টেনিসের অলরাউন্ডার বলেন কিংবদন্তি ক্রিস এভার্ট। ফাস্ট-স্লো-ক্লে সবখানেই স্টেফি অসাধারণ খেলেছেন। ১৯৯৯ সালে বিলি জিন কিং স্টেফি গ্রাফকে সর্বকালের সেরা প্রমীলা টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে অভিহিত করেন।
১৯৯৯ সালে টেনিস র্যাকেট তুলে রাখলেন শোকেসে, সাথে ৯০০ একক ম্যাচ জেতার রেকর্ড (পিছিয়ে আছেন ১৩০৯ ম্যাচ জেতা ক্রিস এভার্ট এবং ১৪৪২ ম্যাচ জেতা মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা থেকে)। আর একই বছরে চারটি গ্র্যান্ডস্ল্যাম এবং অলিম্পিক গোল্ড মেডেল জেতা একমাত্র প্লেয়ার হবার অনন্য রেকর্ড।
২০০১ সালে বিয়ে করেন আরেক বিখ্যাত টেনিস তারকা আন্দ্রে আগাসিকে। বিখ্যাত সংবাদ সংস্থা এপির একটি জরিপ প্যানেল গ্রাফকে বিংশ শতাব্দীর সেরা নারী খেলোয়াড় হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে টেনিস.কম ‘সর্বকালের সেরা নারী খেলোয়াড় কে?’ এই প্রশ্নে তাঁদের পাঠকদের উদ্দেশ্যে একটি পোল করেন সেখানেও এক নম্বর হন স্টেফি গ্রাফ।